আহলে সুন্নাত ও ইমাম সাদেক (আ.)
আহলে সুন্নাত ও ইমাম সাদেক (আ.)
ইমাম সাদেক (আ.) এর মর্যাদা সম্পর্কে শুধুমাত্র শিয়ারাই অনেক কথা বলেছে এমনটি নয় বরং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনেক চিন্তাবিদ ও মহান ব্যক্তিত্বরাও এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। সুন্নি মাযহাবের ইমামগণ, গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আলেমরা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গরা পথপ্রদর্শক এই ইমাম অর্থাৎ ইমাম জাফর সাদেক (আ.) এর জ্ঞানগত, কর্মতৎপরতা, আখলাকি বা চারিত্রিক ও মর্যাদা সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন। আমরা এখানে কয়েকজনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করবো।
ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম সাদেক (আ.)
হানাফি মাযহাবের ইমাম "নোমান বিন সাবেত বিন যাউতি" (৮০ -১৫০ হি:) যিনি "আবু হানিফা" নামে বিখ্যাত ইমাম সাদেক (আ.) এর সমকালীন বসবাস করতেন, তিনি ইমাম সাদেক (আ.) এর মহত্ত্ব সম্পর্কে কিছু কথা স্বীকার করেন। ইমাম সাদেক (আ.) সম্পর্কে তিনি যা কিছু বলেন তার মধ্যে একটি হচ্ছে এই যে:
« مارایت افقه من جعفر بن محمد و انه اعلم الامه »
আমি জাফর বিন মোহাম্মদের মত ফিকাহবিদ ও জ্ঞানী ব্যক্তি এখনো দেখিনি। তিনি এ উম্মতের সর্বজ্ঞানী ব্যক্তি।(১)
ইমাম সাদেক (আ.) এর যুগে মানসুর দাওয়ানেকি ছিল আব্বাসীয়দের খলিফা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার দায়িত্বও ছিল তারই হাতে। সে সর্বদা ইমাম আলী (আ.) ও হযরত ফাতেমার (সা.) বংশধর বিশেষ করে ইমাম সাদেক (আ.) এর মহত্ত্ব, সম্মান ও পদমর্যাদা হতে কষ্ট ভোগ করতো। আর এ কষ্ট লাঘব করার জন্য কখনও কখনও আবু হানিফাকে ইমাম সাদেক (আ.) এর মোকাবেলায় আসার জন্য উৎসাহ দিত;মানসুর দাওয়ানেকি একজন বিশিষ্ট আলেম হিসেবে তাকে সম্মান করতো যাতে করে হয়তো একদিন ইমাম সাদেক (আ.) জ্ঞানগত মহত্ত্ব ও পদমর্যাদার উপর সফলতা অর্জন করতে পারে। এ বিষয়ে স্বয়ং আবু হানিফা বর্ণনা করে বলেন: মানসুর দাওয়ানেকি একদিন একজনকে আমার কাছে পাঠালো এবং বললো: হে আবু হানিফা ! জনগণ জাফর বিন মোহাম্মদের (আ.) প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে, সামাজিক দিক দিয়ে জনগণের মাঝে তাঁর মর্যাদা অনেক, তাঁর এ মর্যাদা নিষ্ফল করার জন্য এবং জনগণের মাঝে তাঁর মর্যাদা -বিশেষ করে জ্ঞানগত- কমানোর লক্ষ্যে কয়েকটি জটিল ও দুর্বোধ্য প্রশ্ন তৈরি কর এবং সুযোগ বুঝে তাঁর কাছে জিজ্ঞেস কর বরং যখন জাফর বিন মোহাম্মদ এ প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারবে না তখন তাঁকে অপমান করবে যাতে জনগণ আর তাঁর প্রতি আকৃষ্ট না হয় এবং তাঁর থেকে দুরে সরে যায়। তাই আমিও এ সম্পর্কে চল্লিশটি কঠিন প্রশ্ন তৈরি করলাম এবং কোন এক দিনে যখন মানসুর "হাইরা"তে ছিল এবং আমাকে ডেকে পাঠালো, আমি তার কাছে গিয়ে হাজির হলাম। প্রবেশ করার সাথে সাথেই দেখি জাফর বিন মোহাম্মদ তার ডানদিকে বসে আছেন, তাঁর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করার সাথে সাথেই তাঁর গাম্ভীর্য ও মর্যাদাপূর্ণ উপস্থিতি দেখে এমনই প্রভাবিত হলাম যে, বর্ণনা করা দুষ্কর। যা খলিফা মানসুর আব্বাসিকে দেখে আমি এতোটা প্রভাবিত হইনি। যদিও মানসুর ছিল খলিফা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী থাকার কারণে সবাইকে প্রভাবিত করতে পারে। সালাম করে তাদের পাশে বসার জন্য অনুমতি চাইলাম; খলিফা ইশারার মাধ্যমে বসার অনুমতি দিলে আমি তাদের পাশে গিয়ে বসলাম। তখন মানসুর আব্বাসি জাফর বিন মোহাম্মদের প্রতি তাকিয়ে বললো: আবু আব্দিল্লাহ ! ইনি হচ্ছেন আবু হানিফা। উত্তরে তিনি বললেন: হ্যাঁ আমি তাকে চিনি।
অত:পর মানসুর আমার দিকে তাকিয়ে বললো: আবু হানিফা ! তোমার যদি কোন প্রশ্ন থেকে থাকে তা আবু আব্দিল্লাহ জাফর বিন মোহাম্মদের কাছে জিজ্ঞেস করতে পারো। আমি বললাম: ঠিক আছে। সুযোগ বুঝে চল্লিশটি প্রশ্ন যা প্রথম থেকে তৈরি করে রেখেছিলাম একের পর এক তাঁর কাছে জিজ্ঞেস করলাম। প্রত্যেকটি প্রশ্ন বর্ণনা করার পর তার জবাবে ইমাম সাদেক (আ.) বলতেন: এ সম্পর্কে তোমার দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে এই আর মদীনাবাসী আলেমগণের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে এই এবং আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে এরূপ।
কিছু বিষয়ে তিনি আমাদের সাথে একমত ছিলেন। আবার কোন কোন বিষয়ে মদিনাবাসী আলেমদের সাথে একমত ছিলেন এবং কখনও আমাদের দু'পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করতেন এবং নিজে এক তৃতীয় দৃষ্টিভঙ্গি বেছে নিতেন ও তা বর্ণনা করতেন।
আমি সমস্ত চল্লিশটি কঠিন প্রশ্ন নির্বাচন করেছিলাম একের পর এক তাঁর কাছে জিজ্ঞেস করলাম এবং জাফর বিন মোহাম্মদও যেভাবে বর্ণনা করা হল খুব শান্তভাবে ও দক্ষতার সাথে সবকটির উত্তর দিলেন। অত:পর আবু হানিফা বর্ণনা করলো:
« ان اعلم الناس اعلمهم باختلاف الناس »
নিশ্চয়ই জনগণের মধ্যে সর্বজ্ঞানী হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে, বিভিন্ন জ্ঞানী ব্যক্তিদের জ্ঞানগত দৃষ্টিভঙ্গির উপর দক্ষতা ও আধিপত্য রাখে। আর যেহেতু জাফর বিন মোহাম্মদ এ দক্ষতার অধিকারী, তাই তিনিই হচ্ছেন সর্বজ্ঞানী ব্যক্তি।(২)
অনুরূপ ইমাম সাদেক (আ.) এর জ্ঞানগত পদমর্যাদা সম্পর্কে বর্ণনা করেন:
« لولا جعفر بن محمد ما علم الناس مناسک حجهم. »
যদি জাফর বিন মোহাম্মদ না হতেন জনগণ তাদের হজ্বের হুকুম আহকাম জানতো না।(৩)
মালেক বিন আনাস ও ইমাম সাদেক (আ.)
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের চার মাযহাবের একটির ইমাম মালেক বিন আনাস (৯৭ -১৭৯ হি:) এবং মালেকি ফের্কার প্রধান। যিনি ইমাম জাফর সাদেক (আ.) এর কাছে কিছুদিন শিষ্যত্বের সৌভাগ্য অর্জন করেছেন।(৪)
তিনি ইমাম জাফর সাদেক (আ.) এর জ্ঞানগত ও আখলাকি ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে বলেন:
« و لقد کنت آتى جعفر بن محمد و کان کثیر المزاح و التبسم، فاذا ذکر عنده النبى (ص) اخضر و اصفر، و لقد اختلفت الیه زمانا و ماکنت إراه الا على ثلاث خصال: اما مصلیا و اما صأما و اما یقرإ القرآن. و ما رإیته قط یحدث عن رسول الله (ص) الا على الطهاره و لا یتکلم فى ما لا یعنیه و کان من العلمإ الزهاد الذین یخشون الله و ما رإیته قط الا یخرج الوساده من تحته و یجعلها تحتى. »
"এক সময় জাফর বিন মুহাম্মদের কাছে আমি যেতাম তিনি হাসি ঠাট্টা পছন্দ করতেন। তাঁর ঠোটে সর্বময় মুচকি হাসি থাকতো। যখনই তাঁর সামনে নবী করিমের (সা.) এর নাম নেয়া হত, জাফর বিন মোহাম্মদের গালের রং সবুজ ও হলুদ হয়ে যেত। যখন তাঁর বাসায় আসা যাওয়া করতাম, তিনটি অবস্থা ছাড়া তাঁকে অন্য কোন অবস্থাতে দেখিনি। হয় তাঁকে নামায পড়তে দেখেছি অথবা রোজা রাখতে দেখেছি অথবা কোরান পড়তে দেখেছি। আমি কখনও জাফর বিন মোহাম্মদকে ওজু ও পাক -পবিত্রতা ছাড়া রাসুল (সা.) এর হাদীস বর্ণনা করতে দেখিনি। আমি তাঁকে লাভ ছাড়া অহেতুক কথা বলতে শুনিনি। তিনি হচ্ছেন একজন পরহেযগার ও খোদাভীরু আলেম। যখনই তাঁর কাছে গেছি যে গালিচাতে তিনি বসে থাকতেন তা বেড় করে আমার জন্য পেতে দিতেন।"(৫)
মালেক বিন আনাস ইমাম সাদেক (আ.) এর পরহেযগারী, ইবাদত ও আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে বলেন: মদীনা থেকে ইমাম সাদেক (আ.) এর সাথে হজ্বব্রত পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে রওয়ানা হলাম। মদীনাবাসীদের মিকাত (যেখানে হজ্বের জন্য এহরাম বাঁধা হয়) অর্থাত মসজিদে শাজারাতে পৌঁছুলাম। আমরা এহরামের লেবাস পরিধান করলাম। এহরামের লেবাস পরিধান করার সময় তালবিয়্যা (লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক) পড়তে হয়। সবাই এ যিকির মুখে মুখে আওড়ালো এবং পড়লো।
মালেক আরো বলেন: আমি ইমামের (আ.) দিকে তাকালাম দেখি তাঁর চেহারার রং পাল্টাচ্ছে। ইমাম সাদেক (আ.) লাব্বাইক বলতে চাচ্ছেন কিন্তু তাঁর গালের রং পাল্টাচ্ছে। ইমাম উদ্বেলিত হয়ে উঠছেন এবং তাঁর গলার আওয়াজ কেঁপে উঠছে। এমন অবস্থা যে, নিজেকে সংযত করতে পারছেন না অনিচ্ছাকৃত হয়তো বাহন থেকে মাটিতে পড়ে যাবেন। মালেক বলেন: আমি সামনে এগিয়ে এসে বললাম: ইয়াবনা রাসুলিল্লাহ ! কোন উপায় নেই এ যিকির পড়তেই হবে। যে করেই হোক এ যিকিরকে মুখে মুখে আওড়াতে হবে। ইমাম (আ.) বললেন:
« یا بن ابى عامر ! کیف اجسر ان اقول لبیک اللهم لبیک و اخشى ان یقول عزوجل لا لبیک و لا سعدیک »
হে আবি আমেরের সন্তান ! লাব্বাইক বলার জন্য আমার সাহস হচ্ছে না, কি করে লাব্বাইক বলবো ? লাব্বাইক বলার অর্থ হচ্ছে এই যে, হে খোদা ! তুমি আমাকে যে কাজের জন্য আহবান করবে দ্রুততার সাথে তা আঞ্জাম দেবো এবং সব সময় তা আঞ্জাম দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবো। কি নিশ্চয়তা আছে ? খোদার সাথে আমি কিভাবে এ রকম ধৃষ্টতা দেখাতে পারি এবং নিজেকে খোদার খেদমত করার জন্য প্রস্তুতকারী হিসেবে পরিচয় করাতে পারি ? যদি আমার জবাবে বলা হয় "লা লাব্বাইক ও লা সা'দাইক" তখন আমি কি করবো?(৬)
অনুরূপ ইমাম সাদেক (আ.) এর ফজিলত ও মর্যাদা সম্পর্কে বলেন:
« ما رإت عین و لا سمعت اذن و لا خطر على قلب بشر افضل من جعفر بن محمد »
"কোন চোখই এ পর্যন্ত দেখেনি এবং কোন কানই এ পর্যন্ত শোনেনি এবং কোন ব্যক্তির মনে এ চিন্তা আসেনি যে, এমন এক লোক যে, জাফর বিন মোহাম্মদের (আ.) চেয়ে বেশি মর্যাদাবান হবে।"(৭) মালেক বিন আনাসের জন্য বলা হয়ে থাকে:
« و کان مالک بن انس یستمع من جعفر بن محمد و کثیرا مایذکر من سماعه عنه و ربما قال حدثنى الثقه یعنیه »
মালেক বিন আনাস জাফর বিন মোহাম্মদ (আ.) থেকে হাদীস শোনতেন এবং তাঁর থেকে যে সব হাদীস শুনেছেন তার বেশিভাগ বর্ণনা করেছেন। অনেক সময় বলতেন: এ হাদীসটি আমাকে একজন বিশ্বস্ত লোক শিখিয়েছে, তাঁর এ কথার উদ্দেশ্য ছিল জাফর বিন মোহাম্মদ (আ.)।(৮)
হুসাইন বিন ইয়াযিদ নৌফেলি বলে:
« سمعت مالک بن انس الفقیه یقول و الله ما رإت عینى افضل من جعفر بن محمد (ع) زهدا و فضلا و عباده و ورعا. و کنت اقصده فیکرمنى و یقبل على فقلت له یوما یا ابن رسول الله ما ثواب من صام یوما من رجب ایمانا و احتسابا فقال ( و کان و الله اذا قال صدق ) حدثنى ابیه عن جده قال قال رسول الله (ص) من صام یوما من رجب ایمانا و احتسابا غفرله فقلت له یا ابن رسول الله فى ثواب من صام یوما من شعبان فقال حدثنى ابى عن ابیه عن جده قال قال رسول الله (ص) من صام یوما من شعبان ایمانا و احتسابا غفرله. »
ফকিহ মালেক বিন আনাসের কাছে শুনেছি তিনি বলেছেন: খোদার কসম ! আমি এ পর্যন্ত কোন পরহেযগারী, জ্ঞান, ফজিলত, ইবাদত ও তাকওয়ার দিক থেকে জাফর বিন মোহাম্মদের চেয়ে উত্তম লোককে দেখিনি। আমি তাঁর কাছে যেতাম, তিনি আমাকে সম্মান করতেন এবং স্বাগত জানাতেন।
একদিন তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম: ইয়াবনা রাসুলিল্লাহ ! রজব মাসে রোজা রাখার সওয়াব কতটুকু ? উত্তরে তিনি নবী করিমের (সা.) একটি হাদীস পড়ে শোনালেন। খোদার কসম যখন তিনি যখন কোন কিছু বর্ণনা করতেন সঠিক ও সত্য কথাটিই বর্ণনা করতেন। তিনি বললেন: আমার বাবা তাঁর বাবার কাছ থেকে এবং তিনি দাদার কাছ থেকে এবং তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রজব মাসে রোজা রাখার সওয়াব হচ্ছে রোজাদার লোকের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। অত:পর এ প্রশ্নটি শাবান মাসের রোজা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম এবং তিনি সে উত্তরটিই দিলেন।(৯)
ইবনে শাবরামা ও ইমাম সাদেক (আ.)
আব্দুল্লাহ বিন শাবরামা বিন তুফাইল দাবাবাবি যিনি ইবনে শাবরামা নামে বিখ্যাত (৭২ -১৪৪ হি:) কুফার বিখ্যাত ফকিহ ও কাজি ছিলেন। তিনি ইমাম সাদেক (আ.) সম্পর্কে বলেন:
« ما ذکرت حدیثا سمعته من جعفر بن محمد (ع) الا کاد ان یتصرع له قلبى سمعته یقول حدثنى ابى عن جدى عن رسول الله (ص). »
আমার মনে নেই যে, জাফর বিন মোহাম্মদের (আ.) কাছে এমন কোন হাদীস শুনেছি যা আমার প্রাণে প্রভাব ফেলেনি। যখন তিনি হাদীস বর্ণনা করতেন তাঁকে বলতে শুনেছি তিনি বলতেন যে, এ রেওয়ায়েতটি আমি আমার বাবা থেকে এবং তিনি দাদা থেকে এবং তিনি আল্লাহর রাসুলের (সা.) কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন।(১০)
তদ্রূপ সে বলে:
« و اقسم بالله ما کذب على ابیه و لا کذب ابوه على جده و لا کذب جده على رسول الله (ص) . »
আল্লাহর কসম ! জাফর বিন মোহাম্মদ (আ.) কখনই তাঁর বাবা থেকে হাদীস বর্ণনা করার সময় মিথ্যা কথা বলেননি এবং তাঁর বাবাও তাঁর দাদা থেকে কোন মিথ্যা কথা বলেননি এবং তিনিও আল্লাহর রাসুল (সা.) থেকে কোন মিথ্যা কথা বর্ণনা করেননি। তার অর্থ হচ্ছে জাফর বিন মোহাম্মদের (আ.) হাদীস বর্ণনাকারীদের সিলসিলাতে সবাই সঠিক ব্যক্তি (হাদীসটি সহীহ হাদীস)।(১১)
ইবনে আবি লাইলা ও ইমাম সাদেক (আ.)
শেখ সাদুক থেকে একটি রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে যে, মোহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান যিনি "ইবনে আবি লাইলা" (৭৪ -১৪৮ হি:) নামে বিখ্যাত ছিলেন ফকিহ, মোহাদ্দেস এবং কুফা শহরের একজন বিখ্যাত বিচারক ইমাম সাদেক (আ.) এর নিকট গেল এবং তাঁর কাছে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন যার যুক্তি সঙ্গত সুন্দর জবাব পেলেন। অত:পর ইমামকে (আ.) সম্বোধন করে বলেন:
« اشهد انکم حجج الله على خلقه. »
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি বান্দাদের উপর খোদার হুজ্জত।(১২)
আমর বিন ওবাইদ মোতাযালি ও ইমাম সাদেক (আ.)
"আমর বিন ওবাইদ মোতাযালি" একদিন ইমাম জাফর সাদেকের (আ.) শরণাপন্ন হল এবং পৌঁছার সাথে সাথে এ আয়াতটি তেলাওয়াত করলো:
«الذین یجتنبون کبأر الاثم و الفواحش »(১৩)
অত:পর চুপ করে রইল। ইমাম সাদেক (আ.) বললেন: কেন চুপ হয়ে গেলে ? বললো: আমি চাচ্ছিলাম আপনি কোরান থেকে কবিরা গুনাহগুলো একের পর এক আমর জন্য বর্ণনা করবেন। ইমাম (আ.) শুরু করলেন এবং সবচেয়ে বড় গুনাহ থেকে একের পর এক বর্ণনা করলেন। ইমাম (আ.) এতো সুন্দর করে "আমর বিন ওবাইদ মোতাযালি"র প্রশ্নর জবাব দিচ্ছিলেন যে, সব শেষে "আমর বিন ওবাইদ" অনিচ্ছাকৃত কেঁদেই ফেললো এবং চিৎকার দিয়ে বললো:
« هلک من قال برإیه و نازعکم فى الفضل و العلوم. »
যে ব্যক্তি নিজের চিন্তায় কথা বলে এবং ফজিলত ও জ্ঞানের দিক দিয়ে আপনার মোকাবেলা করবে, সে হালাক হয়ে যাবে।(১৪)
জাহেয ও ইমাম সাদেক (আ.)
আবু বাহর জাহেয নাসরি (১৬০ -২৫৫ হি:) যিনি তৃতীয় শতাব্দীর একজন বিখ্যাত চিন্তাবিদ ছিলেন, ইমাম সাদেক (আ.) সম্পর্কে বলেন:
« جعفر بن محمد الذى ملاا لدنیا علمه و فقهه و یقال ان ابا حنیفه من تلامذته و کذلک سفیان الثورى و حسبک بهما فى هذا الباب. »
জাফর বিন মোহাম্মদ (আ.) এমন এক ব্যক্তি ছিলেন, যার জ্ঞান ও ফিকাহ শাস্ত্রের মাধ্যমে বিশ্ব ভরে গিয়েছিল এবং বলা হয়ে থাকে যে, আবু হানিফা ও সুফিয়ানে সাওরি তাঁরই শিষ্য ছিলেন। আর তাঁর জ্ঞানগত মর্যাদার জন্য এতোটুকুই যথেষ্ট।(১৫)
ওমর বিন মেকদাদ ও ইমাম সাদেক (আ.)
ওমর বিন মেকদাদ ইমাম সাদেক (আ.) এর সমকালীন আলেমদের মধ্যে একজন ছিলেন এবং ইমাম সাদেক (আ.) সম্পর্কে বলেন:
« کنت اذا نظرت الى جعفر بن محمد علمت انه من سلاله النبیین و قد رإیته واقفا عند الجمره یقول سلونى، سلونى. »
যখন জাফর বিন মোহাম্মদকে (আ.) আমি দেখতাম, বোঝা যেত যে তিনি নবী করিমের (সা.) বংশধর। আমি নিজেই দেখেছি যে, মেনাতে জামারার (যেখানে শয়তানের উদ্দেশ্যে পাথর নিক্ষেপ করা হয়) পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং জনগণকে প্রশ্ন করার জন্য আহবান জানাচ্ছিলেন যাতে তাঁর জ্ঞান হতে উপকৃত হতে পারে ...।(১৬)
শাহরিস্তানি ও ইমাম সাদেক (আ.)
আবুল ফাতহ মোহাম্মদ বিন আবিল কাসেম আশারি যিনি "শাহরিস্তানি" (৪৭৯ -৫৪৭ হি:) নামে প্রসিদ্ধ। তাঁর মূল্যবান গ্রন্থ "আল মিলাল ওয়াল নাহল" -এ ইমাম সাদেক (আ.) এর মর্যাদা সম্পর্কে লিখেছেন:
« و هو ذو علم عزیز فى الدین و ادب کامل فى الحکمه و زهر بالغ فى الدنیا و ورع تام عن الشهوات. »
ইমাম সাদেক (আ.) ধর্মীয় বিষয়ে অফুরন্ত জ্ঞানের অধিকারী এবং হিকমতে পরিপূর্ণ আদব এবং দুনিয়া ও তার বাহ্যিক জাঁক জমক বিষয় সম্পর্কে একজন শক্তিশালী পরহেযগার ছিলেন এবং আত্মিক ও চাহিদা থেকে অনেক দুরে থাকতেন।(১৭)
ইবনে খাল্লাকান ও ইমাম সাদেক (আ.)
ইবনে খাল্লাকান ইমাম সাদেক (আ.) সম্পর্কে লিখেছেন:
« احد الأمه الاثنى عشر على مذهب الامامیه و کان من سادات اهل البیت و لقب بالصادق لصدق مقالته و فضله اشهر من ان یذکر. »
তিনি হচ্ছেন ইমামিয়্যা (শিয়া) -দের বারো ইমামদের মধ্যে এবং আল্লাহর রাসুলের (সা.) আহলে বাইতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। কথা বার্তায় সত্যবাদিতার জন্য তাঁকে সাদেক (সত্যবাদী) উপাধি দেয়া হয় এবং তাঁর ফজিলত সম্পর্কে বর্ণনার কোন প্রয়োজন নেই।
ইবনে খাল্লাকান আরো উল্লেখ করেন: ইমাম সাদেক (আ.) কিমিয়া বা রাসায়নিক শিল্পে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন, "আবু মুসা জাবের বিন হাইয়ান তারতুসি" ছিলেন তারই শিষ্য। জাবের প্রায় এক হাজার পাতা বিশিষ্ট একটি বই রচনা করেন যেখানে জাফর বিন সাদেকের (আ.) শিক্ষাকেই তুলে ধরা হয়েছে এবং যা পাঁচ'শ এর বেশি রেসালা বা চিঠি সম্বলিত।(১৮)
ইবনে হাজার আসকালানি ও ইমাম সাদেক (আ.)
শাহাবুদ্দিন আবুল ফযল আহমাদ বিন আলী মেসরি শাফেয়ি যিনি "ইবনে হাজার আসকালানি" (৭৭৩ -৮৫৩ হি:) নামে মশহুর ছিলেন ইমাম সাদেক (আ.) সম্পর্কে বলেন:
« جعفر بن محمد بن على بن حسین بن على بن ابى طالب فقیهى است بسیار راست گفتار. »
জাফর বিন মোহাম্মদ বিন আলী বিন হুসাইন বিন আলী বিন আবি তালিব হচ্ছেন একজন সত্যবাদী ফকিহ।(১৯)
ইবনে হাজার তার বই "তাহযিবুত তাহযিব" এ লিখেছেন: আবি হাতেম বর্ণিত এবং তিনি তার বাবা থেকে বর্ণনা করেছেন যেখানে ইমাম সাদেক (আ.) সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছিল: ( لا یسإل عن مثله. ) এবং আরো বলেছেন: ইবনে আদি উল্লেখ করেছেন:
« و لجعفر احادیث و نسخ و هو من ثقات الناس ... و ذکره ابن حبان فى الثقات و قال کان من سادات اهل البیت فقها و علما و فضلا ... و قال النسایى فى الجرح و التعدیل ثقه. »
জাফর ইবনে মোহাম্মদের (আ.) অনেক হাদীস ও লিখিত বই রয়েছে। তিনি হচ্ছেন বিশ্বস্ত লোকদের মধ্যে একজন। ইবনে হাইয়ান তাঁকে বিশ্বস্ত বলে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন: জাফর বিন মোহাম্মদ হচ্ছেন আহলে বায়তে রাসুলদের (সা.) মধ্যে একজন মহান ব্যক্তি এবং ফিকাহ, জ্ঞান এবং ফজিলতের দিক দিয়ে একজন সর্বোত্তম ব্যক্তি। নেসায়ি তার "জরহ ওয়া তাদিল" গ্রন্থে ইমাম সাদেককে (আ.) বিশ্বস্ত লোকদের মধ্যে একজন বলে পরিচয় করিয়েছেন।(২০)
মূল: হাসান আশুরি লংরুদি।
সূত্রসমূহ:
১। শামসুদ্দিন যাহাবি, সিয়ারু আ'লামুন নোবালা, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা: ২৫৭; তারিখুল কাবির, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা: ১৯৮ ও ১৯৯, হা: ২১৮৩।
২। সিয়ারু আ'লামুন নোবালা, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা: ২৫৮; বিহারুল আনওয়ার, ৪৭তম খন্ড, পৃষ্ঠা: ২১৭।
৩। শেখ সাদুক, মান লা ইয়াহযুরুহুল ফাকিহ, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা: ৫১৯, ইসলামী প্রকাশনী, কোম।
৪। সিয়ারু আ'লামুন নোবালা, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা: ২৫৬।
৫। ইবনে তাইমিয়্যা, আত তাওয়াস্সুল ওয়াল ওয়াসিলা, পৃষ্ঠা: ৫২; জাফারিয়ান, হায়াতে ফেকরি ওয়া সিয়াসিয়ে ইমামানে শিয়া, পৃষ্ঠা: ৩২৭।
৬। শেখ সাদুক, আল আমালী, পৃষ্ঠা: ১৪৩, হা: ৩।
৭। শহীদ মোতাহারী, সেইরি দার সিরেয়ে আয়েম্মায়ে আতহার, পৃষ্ঠা: ১৪৯।
৮। শরহুল আখবার ফি ফাযায়েলিল আয়েম্মাতিল আতহার, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা: ২৯৯, হা: ১২০৩।
৯। শেখ সাদুক, আল আমালী, পৃষ্ঠা: ৪৩৫ ও ৪৩৬, হা: ২।
১০। শেখ সাদুক, আল আমালী, পৃষ্ঠা: ৩৪৩, হা: ১৬।
১১। শেখ সাদুক, আল আমালী, পৃষ্ঠা: ৩৪৩, হা: ১৬।
১২। সাদুক, মান লা ইয়াহযুরুহুল ফাকিহ, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা: ১৮৮, হা: ৫৬৯।
১৩। সুরা নাজম, আয়াত: ৩২।
১৪। কুলাইনি, কাফি, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা: ২৮৫ -২৮৭।
১৫। রাসায়েলু জাহেয, পৃষ্ঠা: ১০৬; হায়াতে ফেকরি ওয়া সিয়াসিয়ে ইমামানে শিয়া, পৃষ্ঠা: ৩২৮।
১৬। সিয়ারু আ'লামুন নোবালা, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা: ২৫৭।
১৭। আল মিলাল ওয়ান নাহল, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা: ১৪৭; হায়াতে ফেকরি ওয়া সিয়াসিয়ে ইমামানে শিয়া, পৃষ্ঠা: ৩৩০।
১৮। ওয়াফিয়াতুল আ'য়ান, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা: ৩২৭; সিরেয়ে পিশওয়া, পৃষ্ঠা: ৩৫৩; হায়াতে ফেকরি ওয়া সিয়াসিয়ে ইমামানে শিয়া, পৃষ্ঠা: ৩৩০।
১৯। তাকরিবুত তাহযিব, পৃষ্ঠা: ৬৮।
২০। তাহযিবুত তাহযিব, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা: ১০৪।
সূত্রঃ ইন্টারনেট
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন