মাবিয়া বিন ইয়াযিদ কেন খেলাফতকে ত্যাগ করেন?
মাবিয়া বিন ইয়াযিদ কেন খেলাফতকে ত্যাগ করেন?
এস, এ, এ
কারবালাতে ইমাম হুসাইন (আ.)এর শাহাদতের ঘটনার পরে আলোচিত ঘটনাসমূহের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মাবিয়া বিন ইয়াযিদের খেলাফত ত্যাগ। ইবনে হাজার আসকালানী তার গ্রন্থে মাবিয়া বিন ইয়াযিদের খেলাফত ত্যাগের ঘটনাটি এরূপভাবে বর্ণনা করেছেন:
ইয়াযিদ বিন মাবিয়া সন ৬৪ হিজরীতে মারা যায়। তার সন্তানের নাম ছিল মাবিয়া। সে ছিল একজন ধার্মিক এবং সুযোগ্য ব্যাক্তি। কিন্তু সে অসুস্থ ছিল। সে বণী উমাইয়ার অবৈধ রাজতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠার জন্য কোন প্রকারের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নি। কিন্তু তারপরেও তাকে জোরপূবর্ক অবৈধ রাজতন্ত্রের রাজা নির্বাচন করা হয়। কিন্তু তিনি বিভিন্ন মত অনুযায়ী ৪০ দিন, দুই মাস অথবাতিন মাস অবৈধ রাজতন্ত্রের রাজা ছিলেন। তিনি ছিলেন বণী উমাইয়ার তৃতীয় রাজা এবং রাসুল (সা.)এর অষ্টম অনির্বাচিত খলিফা।
যেহেতু মাবিয়া বিন ইয়াযিদের হুকুমতকাল এবং আয়ু ছিল অল্প সেহেতু ইতিহাসে তার সম্পর্কে তেমন কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। ইয়াযিদ তার পিতা মাবিয়ার ন্যায় তার সন্তানের খেলাফত অর্জনের জন্য জনগণের কাছ থেকে বাইয়াত নেয়। যদিও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মাবিয়া বিন ইয়াযিদের খেলাফত তার জিবনী এবং মৃত্যু সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন তিনি ইয়াযিদের মৃত্যুর ৪০ দিন পরেই মারা যায়। আবার কেউ মনে করেন তিনি মাত্র ৪০ দিন শাষন ক্ষমতা পরিচালনা করেন পরে তিনি খেলাফত পদ থেকে নিজেকে অব্যাহতি দেন। (তাবাকাতুল কুবরা, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ১৬৯, তারিখে খালিফা ইবনে খাইয়াত, পৃষ্ঠা ১৯৬, ইবনে কুতাইবা, পৃষ্ঠা ৩৫২)
মাবিয়া বিন ইয়াযিদের খেলাফত ত্যাগের কারণ:
মাবিয়া বিন ইয়াযিদের খেলাফত ত্যাগের কারণ সম্পর্কেও একাধিক মতামত বর্ণিত হয়েছে:
১- তার খেলাফত ত্যাগের যে কারণগুলো বর্ণিত হয়েছে তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তিনি শাষন ব্যাবস্থা বা পরিচালনাকে পছন্দ করতেন না এবং আহলে বাইত (আ.)কে ভালবাসতেন।
২- আবার কেউ মনে করেন যে তিনি অসুস্থ থাকার কারণে খেলাফতকে ত্যাগ করেন। কেননা যখন তাকে খেলাফতের পদে আসীন করা হয় তখন তিনি অসুস্থ ছিলেন এবং উক্ত অসুখের কারণে তিনি মারা যান। (তারিখে খালিফা ইবনে খাইয়াত, পৃষ্ঠা ১৯৬)
তবে তার খেলাফত ত্যাগের যে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি উল্লেখ করা হয়েছে তা হচ্ছে তিনি আহলেবাইত (আ.)কে ভালবাসতেন। মুসলিম জাহানের খলিফাদের মধ্যে তিনি প্রথম খলিফা ছিলেন যিনি আহলে বাইত (আ.)কে তাঁদের প্রাপ্য খেলাফত ফিরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং নিজেকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে নেয়। “কামুসুর রেজাল” নামক গ্রন্থে “মাজালিসুল মুমিনিন” নামক গ্রন্থ হতে বর্ণনা করেছে যে, মাবিয়া বিন ইয়াযিদ আহলে বাইত (আ.)কে ভক্তি করার কারণে খেলাফতকে ত্যাগ করেন। কারণ বণী উমাইয়ার মধ্যে তিনি ছিলেন মুমিনে আলে ফেরাউনের ন্যায়। (নাযারিয়াতে খালিফাতাইন, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ১৫৫, কামুসুর রেজাল, খন্ড ১০, পৃষ্ঠা ১৪৪)
মাবিয়া বিন ইয়াযিদ আহলে বাইত (আ.)কে ভালবাসতো তার অন্যতম কারণ হচ্ছে তার উস্তাদ। তিনি মাবিয়াকে মাবিয়া বিন আবু সুফিয়ান এবং আহলে বাইত (আ.)সম্পর্কে পরিচিতি জ্ঞান দান করেন। অতঃপর তিনি মাবিয়া তার পিতা এজিদের প্রতি অভিসম্পাত করতো এবং খেলাফত থেকে নিজেকে দূরে রাখে। তখন বণী উমাইয়ারা তার উস্তাদকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং তাকে জিবীত মাটিতে পুঁতে দেয়। (ফালাকুন নেজাত ফি ইমামাতি ওয়াস সালাত, পৃষ্ঠা ৯৫)
মাবিয়া বিন ইয়াযিদ কিভাবে খেলাফতকে ত্যাগ করেন:
মাবিয়া বিন ইয়াযিদ ২০ বছর বয়সে মেম্বারে আরোহণ করে বলেন: খেলাফত হচ্ছে আল্লাহর রুজ্জু। যদিও তা ছিল হজরত আলী (আ.)এর প্রাপ্য অধিকার কিন্তু আমার পিতামহ অবৈধভাবে অর্জন করেছিল। যখিন আমার পিতামহ মারা যায় তখন খেলাফত আমার পিতা অবৈধভাবে অর্জন করে। যদিও উক্ত গুরুত্বপূর্ণ পদের প্রকৃত হওয়ার অধিকারী ছিলেন রাসুল (সা.)এর সন্তানরা। অতঃপর তিনি ক্রন্দন করতে থাকেন এবং বলেন: আমার বাবার সবচেয়ে বড় এবং ভয়ানক পদক্ষেপ ছিল রাসুল (সা.)এর নাতীকে কারবালাতে শহীদ করা, কাবাগৃহে হামলা করা এবং তা ধ্বংস করা। আমি তাদের ধ্বংসাত্মক মূলক চিন্তাধারাকে অব্যাজত রাখতে না এবং তাদের কর্মপন্থাকে অনুসরণ করতে চাই না। এখন সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়টি তোমাদের উপরে ন্যাস্ত করলাম যে তোমরা দ্বীন চাও না দুনিয়া। যদি দ্বীনদারী ভাল হয় তাহলে বণী উমাইয়া যতটুকু খেলাফত করেছে তততুকুই যথেষ্ট আর যদি দ্বীনদারী ভাল না হয় তাহলে আবু সুফিয়ানের বংশধর যতটুকু করেছে ততটুকুই যথেষ্ট। অতঃপর তিনি লোকচক্ষু থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখেন এবং ৪০দিন পরে ইহলোক ত্যাগ করেন। উক্ত কথাটুকু লেখার পরে ইবনে হাজার আসকালানী উল্লেখ করেন যে, মাবিয়া বিন ইয়াযিদের উক্ত বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয় যে, তিনি তিনি মাবিয়া বিন আবু সুফিয়ান এবং এজিদের তুলনায় ভাল ছিলেন। (সাওয়ায়েকুম মোহরেক্বা, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ১৭)
অন্য মত অনুযায়ি মাবিয়া বিন ইয়াযিদ খেলাফত ত্যাগের পূর্বে কেন্দ্রীয় মসজিদে যায় এবং সেখানে মেম্বারে আরোহণ করে কিছুক্ষণ নীরবতা অবলম্বন করেন অতঃপর আল্লাহর হামদ ও সানা পাঠ করার পরে সাগ্রহে রাসুল (সা.)এর পরে আহলে বাইত (আ.)কে খেলাফতের জন্য সকলের চেয়ে উত্তম বলে ঘোষণা দেন এবং বলেন: যেমনভাবে আমার পিতামহ মাবিয়া বিন আবু সুফিয়ান খেলাফতের যোগ্য সেই ব্যাক্তিকে বাদ দিয়ে খেলাফতের পদে আসীন হন যিনি ছিলেন রাসুল (সা.)এর সবচেয়ে নিকটতম যার ফযিলত ছিল অনেক, ইসলামের জন্য যিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ, মুহাজিরদের মধ্যে যার কদর ছিল সবচেয়ে বেশী, যিনি সকলের চেয়ে বেশী রাসুল (সা.)এর সাহচর্য্য অর্জন করেছিলেন, রাসুল (সা.) যাকে নিজের কন্যার সাথে বিবাহ দেয়ার জন্য নির্বাচন করেছিলেন, যিনি ছিলেন বেহেশতের দুইজন যুবকের পিতা।
কিন্তু আমার পিতা ইসলামের অবনতি এবং বিভ্রান্তি বৃদ্ধি করেছে, এছাড়া সে নিজের আবেগকে বেশী প্রাধান্য দিত, নিজের ভুলগুলোকে ভাল মনে করতো, সে আল্লাহকে ভয় করতো না, মাবিয়া বিন ইয়াযিদ তার বাবার খেলাফত থেকে নিজেকে বিরত এবং নিজেকে গৃহবন্দী করে রাখে অবশেষে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
খেলাফত ত্যাগ করার পরে মাবিয়ার মা এবং বণী উমাইয়ার লোকজন তাকে বারবার অনুরোধ করে সে যেন তার ভাইকে খেলাফতের জন্য পরবর্তি খলিফা স্বরূপ নির্বাচন করে এবং জনগণের কাছ থেকে তার জন্য বাইয়াত গ্রহণ করে। কিন্তু সে তা করার ক্ষেত্রে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলে: মহান আল্লাহর শপথ অবৈধ হুকুমত আমার জন্য কোনই উপকারে আসেনি। যদি আমি তোমাদের কথা অনুযায়ি আমল করি তাহলে তোমরা এর ফল ভোগ করবে আর আমি আযাব এবং শাস্তি ভোগ করবো। (তাবাকাতুল কোবরা, খন্ড ৫, পৃষ্ঠা ৩৯, শারহে নাহজুল বালাগা, খন্ড ৬, পৃষ্ঠা ১৫২)
মাবিয়া বিন ইয়াযিদের মৃত্যু:
মাবিয়া বিন ইয়াযিদের মৃত্যু সম্পর্কেও বিভিন্ন মতামত বর্ণিত হয়েছে।
১-কেউ মনে করেন যে, তিনি স্বাভাবিকভাব মৃত্যু বরণ করেন। (বালাযুরি, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ২৭০)
২-ইবনে আসীর মনে করেন তাকে বিষ দ্বারা হত্যা করা হয়েছে। যাইহোক তিনি সন ৬৪ হিজরীতে ২১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন বর্তমানে তার কবর দামেস্কে তার কবর রয়েছে। (আল কামেল ফিত তারিখ, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ১৩০, আল ইখতেসাস, পৃষ্ঠা ১৩১, শারহে নাহজুল বালাগা, খন্ড ৬, পৃষ্ঠা ১৫২)
৩- অনেকে মনে করেন তাকে মারওয়ান এজিদের মৃত্যুর পরে তার স্ত্রীর সাথে বিবাহ করে এবং মাবিয়াকে তার মায়ের মাধ্যমে বিষ দ্বারা হত্যা করে। (ইয়েক সাদ মৌযু পনসাদ দাসতান)
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন