মরহুম আয়াতুল্লাহ আলী আকবর হাশেমির সংক্ষিপ্ত জীবনী
মরহুম আয়াতুল্লাহ আলী আকবর হাশেমির সংক্ষিপ্ত জীবনী
ইরানের খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ ও আলেম আয়াতুল্লাহ আলী আকবর হাশেমি রাফসানজানি ১৯৩৪ সালের ২৫ আগস্ট ইরানের রাফসানজান এলাকার বাহরেমান গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের পর ১৪ বছর বয়সে তিনি ধর্মীয় উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য পবিত্র কোম নগরীতে যান।
সেখানে তিনি আয়াতুল্লাহিল উজমা হোসেইন তাবাতাবায়ি বোরুজেরদি, ইমাম খোমেনী (রহ.), সাইয়্যেদ মোহাম্মাদ মোহাক্কেক দামাদ, মোহাম্মাদ রেজা গোলপায়গানি, সাইয়্যেদ মোহাম্মাদ কাজেম শারিয়াতমাদারি, আব্দুলকারিম হায়েরি ইয়াজদি, শাহাবুদ্দিন মারআশি নাজাফি ও মোহাম্মাদ হোসেইন তাবাতাবায়ি’র মতো প্রখ্যাত আলেমে দ্বীনের সংস্পর্শ লাভ এবং তাদের কাছ থেকে মূল্যবান ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করেন।
কোমের ছাত্র থাকা অবস্থায় ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের স্থপতি ইমাম খোমেনী (রহ.)’র অনুপ্রেরণায় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন আয়াতুল্লাহ হাশেমি রাফসানজানি। তিনি তৎকালীন স্বৈরাচারী শাহ সরকার ও তার কথিত শ্বেত বিপ্লবের বিরোধিতায় আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এ আন্দোলনে ইরানের আপামর জনতা অংশগ্রহণ করে এবং এর ফলে ১৯৭৯ সালে শাহ সরকারের পতনের মাধ্যমে ইসলামি বিপ্লব চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে।
সুদীর্ঘ বিপ্লবী ও কর্মময় জীবনে আয়াতুল্লাহ হাশেমি রাফসানজানি ইরানের প্রেসিডেন্ট, পার্লামেন্ট স্পিকার, নীতি নির্ধারণী পরিষদের প্রধান এবং বিশেষজ্ঞ পরিষদের চেয়ারম্যানসহ অনেক বড় বড় পদে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ছিলেন ইসলামি ইরানের পার্লামেন্ট মজলিসে শুরায়ে ইসলামির প্রথম স্পিকার। এ ছাড়া, ১৯৮৯ সালে তিনি ইরানের চতুর্থ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং ১৯৯৩ সালে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও জয়লাভ করে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ১৯৯৭ সালে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেননি আয়াতুল্লাহ হাশেমি রাফসানজানি। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনকালে ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সফর করেন ইরানের এই প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ।
ইরানের ওপর ইরাকের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের ফ্রন্ট পরিদর্শনে রাফসানজানি (লাঠি হাতে); ওই যুদ্ধ বন্ধে আয়াতুল্লাহ রাফসানজানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন
ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পর থেকে আমৃত্যু তিনি ইরানের বিশেষজ্ঞ পরিষদে জননির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন। ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি এই পরিষদের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন।
আয়াতুল্লাহ হাশেমি রাফসানজানি জীবদ্দশায় নিজের সংক্ষিপ্ত আত্মজীবনী লিখে গেছেন। আমরা সেখান থেকে কিছু অংশ পার্সটুডের পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি:
“আমার পিতার নাম: আলহাজ মির্জা আলী হাশেমি বাহরেমানি।
আমার মাতার নাম: মাহ বিবি (সাফারিয়ান)।
আমার প্র-পিতামহের নাম ছিল আলহাজ হাশেম। তার নাম থেকেই আমার বংশের নাম হয়েছে হাশেমি। আমাদের এলাকায় আলহাজ হাশেমের অঢেল সম্পত্তি ছিল। এক নামে তাঁকে চিনত সবাই।
আমার পিতা ধর্মীয় লাইনে লেখাপড়া করেছিলেন। আলেম সমাজের ওপর স্বৈরাচারী শাহ সরকারের দমনপীড়নের কারণে আমার পিতা প্রচুর সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও গ্রামে বসবাস করতে বাধ্য হন। এলাকার মানুষের কাছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং সমাজের বিচার-আচারসহ সাধারণ মানুষের ধর্মীয় নানা প্রশ্নের উত্তর ও সমস্যার সমাধান করে দিতেন আমার পিতা।
আমাদের গ্রামের নাম বাহরেমান। বাহরেমান শব্দের অর্থ চুনি পাথর। রাফসানজান এলাকার একটি গ্রাম এটি।
আমার মা ছিলেন একজন গৃহিনী। পাশাপশি তিনি আমার পিতার কাজেও সাহায্য করতেন। নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও ঔষধী গাছগাছালি সম্পর্কে তার অগাধ জ্ঞান ছিল। তাঁর এই জ্ঞান আমাদের বাড়ির লোকজনের পাশাপাশি গ্রামবাসীর অনেক উপকারে আসত। রোগ-বালাইয়ে পড়লে লোকজন আমার মায়ের স্মরণাপন্ন হতো। এখনো আমি নানা রোগে আমার মায়ের সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাই।
আমরা পাঁচ ভাই ও চার বোন। গ্রামে বসবাস করলেও আমাদের জীবনমান খারাপ ছিল না। জাতীয় পরিচয়পত্রে আমার জন্ম সাল হচ্ছে ১৯৩৪। পাঁচ বছর বয়সে আমি আমার দুই বছরের বড় ভাই কাসেমের সঙ্গে লেখাপড়া শুরু করি।
আমাদের গ্রামের মক্তবে জাতীয় পাঠ্যক্রমের বই পড়ানোর পাশাপাশি পবিত্র কুরআনসহ অন্যান্য ধর্মীয় বই পড়ানো হতো। ওই মক্তবে আমি শেখ সা’দির গুলিস্তান বইটি পড়তে শিখেছি। সাত বছর বয়সে মক্তবের লেখাপড়ার পাশাপাশি পিতার কাছ থেকেও তালিম নিয়েছি। একটা পর্যায়ে এসে দেখলাম মক্তব আমাকে নতুন আর কিছু শেখাতে পারছে না। তখন আমার বয়স ১৪ বছর। সে সময় চাচাতো ভাই মোহাম্মাদের পরামর্শে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে কোম শহরে যাই।
কোমের ধর্মতত্ত্ব কেন্দ্রে আমি বিখ্যাত সব আলেমে দ্বীনের কাছ থেকে শিক্ষা অর্জন করি। এসব আলেমের মধ্যে ছিলেন আয়াতুল্লাহিল উজমা বোরুজেরদি, ইমাম খোমেনি (রহ.), দামাদ, গোলপায়গানি, শারিয়াতমাদারি, হায়েরি ইয়াজদি, মারআশি নাজাফি, আল্লামা তাবাতাবায়ি, জাহেদি ও মোনতাজেরি।
১৯৫৮ সালে আমি হুজ্জাতুল ইসলাম আগা সাইয়্যেদ মোহাম্মাদ সাদেক মারআশির কন্যার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হই। আমার স্ত্রী হচ্ছেন মারআশি নাজাফির আত্মীয়া এবং হজরত আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ কাজেম তাবাতাবায়ি ইয়াজদির নাতনি। আয়াতুল্লাহ তাবাতাবায়ির লেখা বই ইরানের প্রায় সব ধর্মতত্ত্ব কেন্দ্রে আজও রেফারেন্স বই হিসেবে পড়ানো হয়।
আমাদের সুখী দাম্পত্য জীবনে মহান আল্লাহ আমাদেরকে পাঁচটি সন্তান দিয়েছেন। তারা হচ্ছেন ফাতেমা, মোহসেন, ফায়েজা, মাহদি এবং ইয়াসির।
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন