ওয়াহাবি ষড়যন্ত্রের শিকার জান্নাতুল বাকি
ওয়াহাবি ষড়যন্ত্রের শিকার জান্নাতুল বাকি
এস, এ, এ
জান্নাতুল বাকির পরিচিতি:
সৌদি আরবের মদিনায় অবস্থিত একটি কবরস্থান। এই কবরস্থানটি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। জান্নাতুল বাকি নামক কবরস্থানটি মসজিদে নববীর দক্ষিণ পূর্ব দিকে অবস্থিত। পূর্বে এখানে কবরের উপর স্থাপনা ছিল। পরবর্তীতে ইয়াহুদী বংশোদ্ভূত সউদী সরকার ১৯২৫ সালে আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ ক্ষমতায় বসার পর মক্কা ও মদীনা শরীফে বিভিন্ন ইসলামী ঐতিহ্য ধ্বংস করেছে যেমন: জান্নাতুল বাকি কবরস্থান সহ সাহাবি এবং উম্মুল মুমিনিনদের কবর সমূহকে ধ্বংস করা হয়। একই বছর মক্কার জান্নাতুল মুয়াল্লা কবরস্থানের মাজারগুলোও ধ্বংস করা হয়। এরপর বর্বর ও ধর্মান্ধ ওয়াহাবিরা আরো কিছু পবিত্র মাজারের অবমাননা করে এবং এইসব মাজারের গম্বুজ ও স্থাপনাগুলো ভেঙ্গে-চুরে ইসলাম অবমাননার ন্যক্কারজনক তাণ্ডব চালায়।
জান্নাতুল বাকি ছিল রাসুল (সা.)এর সম্পদ:
মুহাম্মদ (সা) হিজরত করে মদিনা আসার সময় জান্নাতুল বাকির স্থান সবুজ বৃক্ষ আচ্ছাদিত ছিল। মসজিদে নববী নির্মাণের সময় তিনি মসজিদের স্থানটি দুজন এতিম শিশুর কাছ থেকে কিনে নেন। তার এক সাহাবি আসাদ বিন জারারার মৃত্যুর পর মুহাম্মদ (সা) কবরস্থানের জায়গা নির্ধারণ করেন। আসাদ বিন জারার ছিলেন এখানে দাফন হওয়া প্রথম আনসার ব্যক্তি। উসমান বিন মাজুন এখানে দাফন হওয়া প্রথম মুহাজির ব্যক্তি। এছাড়াও সেখানে দাফন করা হয়েছে ইসলামের বিশিষ্ট ব্যাক্তিত্ববর্গদেরকে যেমন: মুহাম্মদ (সা) এর আত্মীয় ও সাহাবি, খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ (সা.আ.) ছাড়া রাসুল (সা) এর অন্যান্য স্ত্রীগণ, মুহাম্মদ (সা) এর শিশুপুত্র ইবরাহিম, রুকাইয়াহ বিনতে মুহাম্মদ, মুহাম্মদ (সা) এর কন্যা, মুহাম্মদ (সা) এর চাচি ফাতিমা বিনতে আসাদ, সাফিয়া ও আতিকা, তৃতীয় খলিফা উসমান ইবনে আফফান, মুহাম্মদ (সা) এর সাহাবি উসমান বিন মজুন, মুহাম্মদ (সা) এর চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব, ইমাম আলি (আ.)এর মাতা ফাতিমা বিনতে হিজাম ওরফে উম্মুল বানিন, মুহাম্মদ (সা) এর নাতি এবং আলি ইবনে আবি তালিব ও ফাতিমার পুত্র হাসান ইবনে আলি (আ.), হুসাইন ইবনে আলির পুত্র ইমাম জয়নুল আবেদিন (আ.), শিয়াদের পঞ্চম ইমাম মুহাম্মদ আল বাকির (আ.), শিয়াদের ষষ্ঠ ইমাম জাফর আল-সাদিক (আ.), আলি ইবনে আবি তালিবের কন্যা জয়নাবের স্বামী ও ভাতিজা আবদুল্লাহ ইবনে জাফর (রা.), হজরত আলি (আ.)এর বড় ভাই হজরত আকিল ইবনে আবি তালিব (রা.)।
বিশ্বনবী (সা.) কবর জিয়ারতের সুন্নাতকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দান:
সম্ভবত রাসুল (সা.)এর কবর যিয়ারতের অন্যতম কারণ এটাও ছিল যে এর মাধ্যমে তিনি মুসলমানদের মধ্যে বিভেদকামী এই ওয়াহাবি-সালাফি গোষ্ঠীর মুনাফেকি বা কপট চরিত্র উন্মোচন করবেন। এই সুন্নাতের মাধ্যমে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এটা স্পষ্ট করেন যে, একটি গতিশীল ইসলামী সমাজ সবসময় তার মৃত ব্যক্তিদের স্মরণ করে যেই মৃত ব্যক্তিরা মৃত্যুর পরেও খোদায়ী রহমত পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। অন্যদিকে শহীদদের অবস্থা আরো উন্নত। স্বয়ং মহান আল্লাহ বলেছেন,
‘যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়েছে তাদের তোমরা মৃত ভেবো না, বরং তারা জীবিত এবং তাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে জীবিকা-প্রাপ্ত।’ (সুরা আলে ইমরান-১৬৯)
অন্য একটি আয়াত হতে জানা যায় এই বিশেষ জীবন (বারজাখের জীবন) শুধু শহীদদের জন্যই নয়, বরং আল্লাহর সকল অনুগত ও সৎকর্মশীল বান্দার জন্য নির্ধারিত।
মহান আল্লাহ্ বলেছেন :
‘যারা আল্লাহ্ ও তাঁর প্রেরিত পুরুষের আনুগত্য করবে তারা সেই সব ব্যক্তির সঙ্গে থাকবে নবীগণ, সত্যবাদিগণ, শহীদগণ ও সৎকর্মশীলদের মধ্য হতে যাদের তিনি নিয়ামত দিয়েছেন। তারা কতই না উত্তম সঙ্গী!’ (সুরা নিসা-৬৯)
যদি শহীদগণ আল্লাহর কাছে জীবিত থাকেন ও জীবিকা লাভ করেন তবে যে কেউ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের অনুগত হবে, সেও শহীদদের সাথে থাকবে, (যেহেতু রাসূল নিজেও তাঁর আনীত নির্দেশের আনুগত্যকারী, সেহেতু তিনিও এই সুবিধার অন্তর্ভুক্ত)। কারণ এ আয়াতে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যকারীরা শহীদদের সঙ্গে থাকবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদি শহীদরা মৃত্যুর পর আল্লাহর কাছে জীবিত থাকেন তবে তারাও অর্থাত আল্লাহ ও নবী-রাসূলদের আনুগত্যকারীরাও আল্লাহর কাছে জীবিত রয়েছেন ও বারজাখী জীবনের অধিকারী।
জান্নাতুল বাকি হচ্ছে সেই কবরস্থান যেখানে বেহেশতী নারীদের সর্দার তথা খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমা (সা.) বিশ্বনবী (সা.)’র ইন্তিকালের পর যে ৯০ দিন নিজে বেঁচে ছিলেন প্রায়ই সেখানে গিয়েই শোক প্রকাশ করতেন। যেখানে বসে তিনি শোক প্রকাশ করতেন সেই স্থানটিকে বল হল বাইতুল হুজন বা শোক প্রকাশের ঘর। একই স্থানে কারবালার শোকাবহ ঘটনার পর বিশ্বনবী (সা.)’র নাতি শহীদদের নেতা ইমাম হুসাইন (আ.) ও নিজের পুত্র হযরত আবুল ফজল আব্বাস (রা.) ’র জন্য শোক প্রকাশ করতেন মুমিনদের নেতা হযরত আলী (আ.)’র স্ত্রী উম্মুল বানিন (সা. আ.)। এখানেই মদিনাবাসী যোগ দিতেন শোক-অনুষ্ঠানে। এখানে প্রায়ই শোক প্রকাশের জন্য আসতেন ইমাম হুসাইন (আ.)’র স্ত্রী হযরত রাবাব (সা. আ.)। বিশ্বনবী (সা.)’র নাতনী ও ইমাম হুসাইন (আ.)’র বোন হযরত জয়নাব (সা. আ.) ও উম্মে কুলসুম (সা.আ.) নিয়মিত শোক প্রকাশের জন্য এখানেই আসতেন।
ওয়াহাবি মতবাদের জন্ম:
আজ থেকে প্রায় ৩০০ বছর আগে ওয়াহাবি মতবাদের প্রবক্তা আবদুল ওয়াহহাব নজদি সৌদ বংশের সহায়তা নিয়ে ইবনে তাইমিয়ার বিভ্রান্ত চিন্তাধারা প্রচার করতে থাকে। আবার অনেরে মতে সৌদি রাজ –পরিবার তথা ওহাবি আসলে “দোমনেহ” নামের বিভ্রান্ত ইহুদিবাদী গোষ্ঠীর বংশধর। এই গোষ্ঠী ভণ্ড ইহুদিবাদী নবী ‘শাব্বিটি জিভি’র অনুসারী। তারা প্রকাশ্যে ইসলামের অনুসারী বলে দাবি করত। কিন্তু তারা বাস্তবেমদ্যপ ও নির্বিচার যৌনাচার বা যৌন অনাচারসহ নানা ঘৃণ্য কাজে অভ্যস্ত ছিল। তার ভুল দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে নজদি অলি-আওলিয়ার উসিলা দিয়ে দোয়া করা, তাদের মাজারে মানত করা ও শ্রদ্ধা জানানো সহ অলি-আওলিয়ার মাজার ও কবর জিয়ারতের মত ইসলামের মৌলিক কিছু ইবাদত এবং আচার-অনুষ্ঠানকে হারাম ও শির্ক বলে ঘোষণা করেছিল। ফলে ওয়াহাবিরা মাজার ও পবিত্র স্থানগুলো ধ্বংস করে আসছে। শুধু তাই নয় নজদি তার চিন্তাধারার বিরোধীদেরকে কাফির ও তাদেরকে হত্যা করা ওয়াজিব বলে উল্লেখ করত। বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন নামের জঙ্গিরা তা বাস্তবায়নের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ওয়াহাবিদের সন্ত্রাসমূলক কর্মকান্ড:
১- ওয়াহাবিরা আলে সৌদের বাহিনী নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণের ওপর নৃশংসভাবে গণহত্যা চালিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করত এবং জনগণকে ওয়াহাবি মতবাদ মেনে নিতে বাধ্য করত।
২- প্রাথমিক পর্যায়ে যখন তাদের কেন্দ্রীয় শাসন ছিল না সে সময় ওয়াহাবিরা লুটপাট ও ডাকাতির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত। শহরগুলোতে লুটপাটের পর সেইসব অঞ্চলের ওপর দখলদারিত্ব ধরে রাখার চেষ্টা করতো।
৩- ওয়াহাবিরা বিশ্বনবী (সা.)’র পবিত্র মাজারে এবং কারবালায় হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) মাজারে হামলা চালিয়ে মূল্যবান অনেক সম্পদ, উপহার ও নিদর্শন লুট করেছিল।
৪- ইসলামের পবিত্র ও ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো ধ্বংস করে ওয়াহাবিরা শুধু মুসলিম উম্মাহর হৃদয়কেই ক্ষত-বিক্ষত করেনি, একইসঙ্গে মানব সভ্যতার অবমাননার মত জঘন্য কলঙ্কও সৃষ্টি করেছে।
৫- ওয়াহাবিরা ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনগুলোও ধ্বংস করে দিচ্ছে যাতে ভবিষ্যত প্রজন্মগুলো এইসব নিদর্শন সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে। এটা ইসলাম ও মানব সভ্যতার জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।
৬- ওয়াহাবিরা জান্নাতুল বাকিতে হামলা চালিয়ে নিষ্পাপ ইমামদের মাজার ধ্বংস করেছিল।
৭- হিজরি ১২২১ সালে (১৮০০ খ্রিস্টাব্দে) ওয়াহাবিরা দেড় বছর ধরে মদীনাকে অবরুদ্ধ করে শহরটি দখল করে।
৮- বিশ্বনবী (সা.) পবিত্র মাজারের দামী পাথর ও সোনা-রূপাসহ মূল্যবান জিনিষগুলো লুট করে এবং জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে ধ্বংসযজ্ঞ ও লুটপাট চালায়। তারা হামলা পবিত্র মক্কায়ও হামলা চালিয়েছিল।
৯- তারা ওই একই বছর কেবল বিশ্বনবী (সা.)’র মাজার ছাড়া মক্কা ও মদীনায় সব মাজার ধ্বংস করে। শ্রদ্ধার জন্য নয়, বরং জনগণের ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে ও ভয়াবহ পরিণামের ভয়ে বিশ্বনবী (সা.)’র মাজার ধ্বংস করার সাহস তারা করেনি।
১০- ওয়াহাবিরা মক্কা ও মদিনার কাজি বা বিচারকদের অপসারণ করে সেখানে নিজেদের কাজি নিয়োগ করে। নবনিযুক্ত ওয়াহাবি কাজি বিশ্বনবী (সা.)’র মাজার বা কবর জিয়ারত থেকে জনগণকে বিরত রাখার চেষ্টা করতেন। মক্কা ও মদিনার জনগণকে জোর করে ওয়াহাবি মতবাদ মেনে নিতে বাধ্য করেছিল ওয়াহাবিরা।
১১- ওয়াহাবিরা দ্বিতীয়বার মক্কা দখলের পর পর ১৩৪৪ বা ১৩৪৫ হিজরিতে তথা ১৯২৫ সালে মদীনা অবরোধ করে এবং প্রতিরোধাকামীদের পরাজিত করে এই পবিত্র শহর দখল করে।
১২- বিশ্বনবী (সা.)’এর স্ত্রী ও প্রথম মুসলমান উম্মুল মুমিনিন হযরত খাদিজা (সালামুল্লাহি আলাইহার) বাসভবনটিকে ধ্বংস করে সেখানে টয়লেট নির্মাণ করেছে। তারা ‘মৌলুদুন্নবি’ নামে খ্যাত বিশ্বনবী (সা.)’র জন্মের স্থানটিকে পশু রাখার স্থানে পরিণত করেছে।
বর্তমানে ওয়াহাবিদের নারকীয় তাণ্ডব:
ওয়াহাবিদের নারকীয় তাণ্ডব আজও অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিন তাদের অনুগত সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হচ্ছে ইরাক, পাকিস্তান ও সিরিয়ার নিরপরাধ নারী, পুরুষ ও শিশু। শুধু তাই নয় তারা লাশের অবমাননা করে কলিজা বের করে তা চিবিয়ে খেতেও দ্বিধা করছে না। মানুষ-খেকো এই ওয়াহাবিদের নৃশংসতা বিশ্বনবী (সা.)’র চাচা ও শহীদদের নেতা হযরত হামজার কলিজা-খেকো নারী হিন্দার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। হিন্দা ছিল ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্রু আবু-সুফিয়ানের স্ত্রী ও মুয়াবিয়ার মা তথা ইয়াজিদের দাদী।
ওয়াহাবিদের বিরূদ্ধে বর্তমান মুসলমানদের কর্তব্য:
আজ বিশ্বের মুসলমানদের সচেতন হতে হবে এবং শিয়া সুন্নি মতবাদের উর্ধে ইসলামী আদর্শ ও চিন্তাধারাকে অগ্রধিকার দিতে হবে এবং মক্কা ও মদীনার মত পবিত্র শহরগুলো পরিচালনার দায়িত্ব থেকে ওয়াহাবিদের সরিয়ে দিয়ে তা মুসলমানদের প্রকৃত প্রতিনিধিদের কাছে অর্পণ করতে হবে। কেননা ওহাবিরা হচ্ছে আমেরিকা ও ইয়াহুদিদের চর যারা প্রতিনয়িত মুসলমানদের সার্বিক ক্ষতি সাধনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কখনও তারা জাকির নায়েকের রূপে আবার কখনও বিভিন্ন মুফতিরূপে। আর এভাবে তারা বিশ্বের যুব সমাজকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বিভ্রান্তির পথে। পরিণতিতে দেশ পড়ছে ইয়াহুদিবাদিদের খপ্পরে। যারা বিশ্বে শান্তি আনায়নের নামে চালিয়ে যাচ্ছে হত্যাযজ্ঞ। তাই আসুন আমরা ইসলামের শত্রু ওহাবিদের ষড়যন্ত্রকে নস্যাত করার লক্ষ্যে এবং সকল ভেদাভেদকে ভুলে এক কলেমার ছায়াতলে একত্রিত হই। ইসলাম এবং ইসলামী স্থাপত্যগুলোকে রক্ষা করতে সোচ্চার হই।
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন