ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জীবনী-১২তম পর্ব

ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জীবনী-১২তম পর্ব

ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জীবনী-১২তম পর্ব

ইমাম, হুসাইন, ইমাম হুসাইন, কারবালা, মাবিয়া, এজিদ, আমির মাবিয়া, ইমাম হাসান, ইমাম আলি, ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জীবনী, ইমাম হুসাইন (আ.),

লেখক: মো. মুনীর হোসেন খান

মৃত্যুকালে ইয়াযীদের প্রতি আমীরে মুয়াবিয়ার অসিয়ত

তাবারী ও অন্যান্য ইতিহাসবেত্তা,যেমন ইবনে আসীর বর্ণনা করেছেন যে,আমীরে মুয়াবিয়া মৃত্যুকালে নিজ পুত্র ইয়াযীদের উদ্দেশ্যে অসিয়ত করেছিলেন। আমরা এখানে তারীখে তাবারী থেকে তাঁর অসিয়তের মূল পাঠ পাঠকবর্গের উদ্দেশে তুলে ধরছি :

আবু মিখনাফ বলেন : “আমাকে আবদুল মালিক ইবনে নওফেল ইবনে মুসাহিক ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে মিখমারাহ্ জানিয়েছেন : মুয়াবিয়া যে রোগে মৃত্যুবরণ করেছিলেন সেই রোগে ভোগাকালে ইয়াযীদকে ডেকে এনে বলেছিলেন : হে বৎস! আমি তোমার যুদ্ধযাত্রার সব প্রয়োজন ও ঝামেলা মিটিয়ে দিয়েছি। শত্রুদেরকে দমন ও অপদস্থ করেছি;আরবদের গর্দান তোমার সামনে নত করে দিয়েছি;আমি তোমার জন্য জনগণকে একত্র করে দিয়েছি;কুরাইশদের মধ্য থেকে হুসাইন ইবনে আলী,আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর,আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইর এবং আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর-এ চার ব্যক্তি ব্যতীত আর কারো ব্যাপারে আমি ভয় করি না যে,সে এ বিষয়কে (খিলাফত) কেন্দ্র করে তোমার সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হবে। তবে আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর এমন এক ব্যক্তি যাকে ইবাদত-বন্দেগী মশগুল (এবং পার্থিব ও রাজনৈতিক বিষয়াদির ব্যাপারে নির্লিপ্ত) করেছে। তাই সে ব্যতীত যদি আর কোনো ব্যক্তি বিদ্যমান না থাকে যে তোমার হাতে বাইআত করে নি,তা হলে সেও তোমার হাতে বাইআত করবে। কিন্তু মদীনা থেকে বের করে আনা পর্যন্ত ইরাকবাসী হুসাইন ইবনে আলীকে ত্যাগ করবে না। তাই সে যদি বের হয় (বিদ্রোহ করে) এবং তুমিও তার ওপর বিজয়ী হও তা হলে তাকে ছেড়ে দিও। কারণ,(মহানবীর সাথে) তার নিকটাত্মীয়তা ও ব্যাপক অধিকার আছে। আর আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর হচ্ছে এমন ব্যক্তি যে,সে যদি দেখতে পায় তার সঙ্গী-সাথীরা কিছু একটা করে ফেলেছে,সেও তাদের অনুরূপই করবে। নারী ও আমোদ-প্রমোদে আসক্তি ছাড়া তার কোনো কাজ নেই। কিন্তু যে ব্যক্তি শৃগালসুলভ চতুরতা নিয়ে তোমাকে ধোঁকা দেবে এবং ব্যাঘ্রের মতো ক্ষিপ্র গতিতে তোমার ওপর আক্রমণ করবে অর্থাৎ তুমি যদি সুযোগ দাও তা হলে তোমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে সে ব্যক্তিটি হচ্ছে আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইর। যদি সে তা করে এবং তুমিও তাকে পরাভূত কর,তা হলে তাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।”

হিশাম বলেন : “আওওয়ানাহ্ বলেছেন : আরেকটি হাদীসে আমরা শুনেছি যে,মুয়াবিয়া মৃত্যুকালে (৬০ হিজরীতে) ইয়াযীদের অনুপস্থিতিতেই পুলিশ বাহিনীর প্রধান যাহ্হাক ইবনে কাইস আল ফিহরী এবং মুসলিম ইবনে উকবাহ্ আল মুররীকে ডেকে এনে বলেছিলেন : তোমরা দু’জন ইয়াযীদের কাছে আমার এ অসিয়ত পৌঁছে দিয়ে বলো : (হে ইয়াযীদ!) তুমি হিজাযের অধিবাসীকে সুনজরে দেখবে। কারণ,তারা তোমার উৎসমূল। তাদের মধ্য থেকে কেউ তোমার কাছে এলে তাকে যথাযথ সম্মান করবে। তাদের মধ্যে যারা তোমার কাছে অনুপস্থিত থাকবে (অর্থাৎ তোমার সাথে সম্পর্ক ভালো না থাকার কারণে তোমার কাছে আসবে না) তাদের সাথেও সন্ধি করবে (সদ্ভাব বজায় রাখবে)। ইরাকবাসীকে সুনজরে দেখবে। যদি তারা তোমার কাছে প্রতিদিনই শাসনকর্তা পরিবর্তন করার আবেদন জানায় তা হলে সেটাই করবে। কারণ,শাসনকর্তা পরিবর্তন করা আমার কাছে তোমার বিরুদ্ধে তাদের লক্ষ তরবারি উত্তোলন করার চেয়ে অধিক পছন্দনীয়। শামবাসীকেও তোমার সুনজরে রাখবে। কারণ,তারা তোমার ঘনিষ্ঠ সহচর,প্রহরী ও রক্ষাকারীস্বরূপ। তাই তোমার শত্রু তোমার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে এ শামবাসীর মাধ্যমে দমন করবে। শত্রুদের বিদ্রোহ দমন করার পর শামবাসীকে তাদের নিজ দেশ,শহর ও জনপদে ফিরিয়ে আনবে। কারণ,তারা যদি ভিন্ন দেশ,ভূ-খণ্ড ও জনপদে বসবাস করা শুরু করে তা হলে তারা অন্যদের স্বভাব-চরিত্র গ্রহণ করবে। আমি হুসাইন ইবনে আলী,আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর ও আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইর-এ তিন ব্যক্তি ব্যতীত কুরাইশদের মধ্য থেকে আর কারো ব্যাপারে শঙ্কিত নই। তবে আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর হচ্ছে এমন ব্যক্তি যাকে ধর্ম মশগুল করেছে। তাই সে তোমা থেকে অগ্রবর্তী হয়ে খিলাফত দাবী করবে না। কিন্তু হুসাইন ইবনে আলী বিচার-বুদ্ধিহীন,বোকা ও ব্যক্তিত্বহীন ব্যক্তি। আর আমিও আশা করছি যে,মহান আল্লাহ্ যে ব্যক্তি তার পিতাকে হত্যা করেছে তাকে এবং যারা তার ভাইকে সাহায্য করা থেকে বিরত থেকেছে তাদেরকে তোমার জন্য যথেষ্ট করে দিন (অর্থাৎ তুমি হুসাইনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিও না)। কারণ,হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে তার নিবিঢ় রক্ত-সম্পর্ক,ব্যাপক অধিকার ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা রয়েছে;তবে আমার ধারণা,ইরাকবাসী তাকে বিদ্রোহ করার জন্য (মদীনা থেকে) বের না করে ছাড়বে না। তাই তুমি যদি তার ওপর বিজয়ী হও তা হলে তার থেকে হাত গুটিয়ে নেবে। কারণ,আমিও যদি তার ওপর বিজয়ী হতাম তা হলে তাকে ক্ষমা করতাম এবং ছেড়ে দিতাম। কিন্তু ইবনে যুবাইর হচ্ছে ধূর্ত গিরিগিটি সদৃশ। তাই সে যদি তোমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তা হলে তাকে হত্যা করো। যদি সে তোমার কাছে সন্ধির প্রস্তাব দেয় তা হলে তাকে হত্যা করো না। যদি সে তা করে তা হলে তা গ্রহণ করো। তোমার উচিত যতদূর সম্ভব রক্তপাত থেকে তোমার জ্ঞাতি ও সম্প্রদায়কে রক্ষা করা।”১

এটি হচ্ছে পুত্র ইয়াযীদের প্রতি মুয়াবিয়ার অসিয়ত যা উপরিউক্ত ইতিহাসবেত্তাগণ বর্ণনা করেছেন। তবে কতিপয় গবেষকের মতে এ অসিয়তনামায় এমন কিছু প্রমাণ বিদ্যমান যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে,তা বানোয়াট। এ অসিয়তনামা জালকারীদের উদ্দেশ্য ছিল মুয়াবিয়ার ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা এবং মহানবী (সা.)-এর বংশধর ও হিজাযের অধিবাসীর ব্যাপারে পুত্র ইয়াযীদকে তিনি যে সদাচরণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তা প্রমাণ করা যাতে মুয়াবিয়া ও তাঁর অভিশপ্ত বংশধরদেরকে (বনী উমাইয়্যাহ্) পাপিষ্ঠ ইয়াযীদের জঘন্য অপরাধসমূহের দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্ত করা সম্ভব হয়। ইয়াযীদের প্রতি মুয়াবিয়ার অসিয়তনামার বেশ কিছু জাল বর্ণনা অন্যান্য ইতিহাস গ্রন্থেও বর্ণিত হয়েছে। যেমন খাওয়ারিযমীর ‘আল মাকতাল’ গ্রন্থে এ ধরনের একটি রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে। তিনি নিজ সূত্রে মুয়াবিয়া থেকে বর্ণনা করেছেন : “মুয়াবিয়া পুত্র ইয়াযীদকে বললেন : আমাকে ইবনে আব্বাস বলেছেন : আমি তাঁর (মহানবীর) ওফাতকালে তাঁর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তখন তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছিলেন এবং ঐ অবস্থায় হুসাইনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলছিলেন : এ (হুসাইন) হচ্ছে আমার সবচেয়ে সুগন্ধিময় পবিত্র বৃক্ষমূল।২ আমার পুণ্যবান বংশধরদের একজন এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ বংশধর। ঐ ব্যক্তিকে মহান আল্লাহ্ যেন কোনো কল্যাণ না দেন যে আমার পরে তাকে সংরক্ষণ করবে না (অর্থাৎ তার অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করবে না)। ইবনে আব্বাস বলেন : এরপর মহানবী (সা.) মূর্ছা যান। অতঃপর জ্ঞান ফিরলে তিনি বলেন : হে হুসাইন! কিয়ামত দিবসে নিশ্চয় আমার প্রভুর সামনেই তোমার হত্যাকারীর সাথে আমার বিবাদ করার অধিকার থাকবে। আর যে তোমাকে হত্যা করবে কিয়ামত দিবসে মহান আল্লাহ্ আমাকে তার শত্রু করবেন,এ কারণে আমার প্রাণ তৃপ্ত হয়েছে। মুয়াবিয়া ইয়াযীদকে বললেন : হে বৎস! এটি হচ্ছে আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাসের কথা। এখন আমি মহানবী (সা.)-এর একটি বাণী তোমাকে শুনাচ্ছি : তিনি বলেছেন : একদিন আমার কাছে আমার বন্ধু জিবরীল এসে বললেন : হে মুহাম্মদ! নিশ্চয়ই আপনার উম্মত আপনার পুত্র হুসাইনকে হত্যা করবে এবং তার হত্যাকারী হবে এ উম্মতের অভিশপ্ত ব্যক্তি। মহানবী (সা.) বহুবার হুসাইনের হত্যাকারীর ওপর অভিশাপ দিয়েছেন। তাই হে বৎস! সাবধান! সাবধান! সতর্ক থেক,যাতে তুমি তাকে পাছে কোনো কষ্ট না দাও। কারণ,সে হচ্ছে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর বংশধর। হে বৎস! আল্লাহর শপথ,নিশ্চয়ই তার অধিকার মহান। আর তুমি আমার জীবদ্দশায় দেখেছ যে,আমি কীভাবে তাকে সহ্য করতাম এবং তার সামনে আমার গ্রীবাদেশ অবনত করতাম ঐ অবস্থায়ও যখন সে কটু কথা বলে আমাকে আক্রমণ করত যা আমার হৃদয়কে ব্যথা দিত। কিন্তু এরপরও আমি তার কথার জবাব দিতাম না এবং তাকে জব্দ করার কোনো কৌশলও অবলম্বন করতাম না। কারণ,সে হচ্ছে বর্তমানে পৃথিবীর বুকে মহান আল্লাহর পরিবারের বিদ্যমান সর্বশেষ ব্যক্তি। এমনকি আমি যে তাকে সাবধান করব তা করতেও আমি অক্ষম ছিলাম। এরপর যাহ্হাক ইবনে কাইস আল ফিহরী এবং মুসলিম ইবনে উকবাহ্ আল মুররীর দিকে তাকিয়ে মুয়াবিয়া বললেন : তোমরা আমার এ কথার ব্যাপারে সাক্ষী থেকো। কারণ,মহান আল্লাহর শপথ,হুসাইনও যদি আমার সাথে এমন কোনো আচরণ করে আমি তা সহ্য করতাম এবং আমাকেও মহান আল্লাহ্ যেন তার রক্ত ঝরানোর ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন না করেন। হে বৎস! আমি তোমাকে যে অসিয়ত করলাম তা কি তুমি উপলব্ধি করতে পেরেছ? তখন ইয়াযীদ বলল : হে আমীরুল মুমিনীন! আমি তা বুঝেছি।”

এ সব বর্ণনা ও রেওয়ায়েত যে আসলেই বানোয়াট এবং বনী উমাইয়্যাহ্ ও বনী আব্বাসের বেতনভুক অনুচররা তৈরি করেছে এতৎসংক্রান্ত বহু প্রমাণ বিদ্যমান। আমরা সাইয়্যেদ হাশিম রাসূলী প্রণীত ‘ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জীবনী’ গ্রন্থ থেকে গুটিকতক প্রমাণ এখানে তুলে ধরলাম:

১. মুয়াবিয়ার অসিয়তনামা সংক্রান্ত প্রথম বর্ণনায় আবদুর রহমান ইবনে আবু বকরের নাম এসেছে। অথচ তিনি মুয়াবিয়ার জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ করেন।৩

২. ইতিহাসবেত্তাগণ,এমনকি স্বয়ং তাবারী ও ইবনে আসীর যাঁরা এ অসিয়তনামা তাঁদের ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,তাঁরাও বলেছেন যে,মুয়াবিয়ার মৃত্যুকালে ইয়াযীদ শামে ছিল না এবং সে ‘হাওয়ারীন’ নামক স্থানে অবস্থান করছিল। আর সেখানেই তাকে তার পিতার মৃত্যুর ব্যাপারে অবহিত করা হয় এবং সেখান থেকে শামে নিয়ে যাওয়া হয়,যদিও এ অসিয়তনামার শুরুতে বর্ণিত হয়েছে যে,মুয়াবিয়া মৃত্যুকালে ইয়াযীদকে ডেকে এনে এ অসিয়ত করেছিলেন। আর এ কারণেই ইবনে আসীর এ অসিয়তনামার শেষে বলেছেন : “কেউ কেউ বলেছে যে,মুয়াবিয়া যাহ্হাক ইবনে কাইস ও মুসলিম ইবনে উকবাহ্ নামক তাঁর দু’জন অত্যন্ত বিশ্বস্ত ব্যক্তির কাছে এ অসিয়তনামা অর্পণ করেন যাতে তারা তা ইয়াযীদের কাছে পৌঁছে দেয়।”

৩. মুয়াবিয়া যে হিজাযের অধিবাসীর ব্যাপারে সদাচরণ করার অসিয়ত করেছেন-এতৎসংক্রান্ত বর্ণনা ঐতিহাসিকদের ঐ সব বর্ণনার বিরোধী যেগুলোতে তাঁরা উল্লেখ করেছেন যে,মুয়াবিয়া ইয়াযীদকে বলেছিলেন : “অবশেষে একদিন মদীনাবাসী তোমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। আর যদি তারা এ কাজ করেই বসে তা হলে বিদ্রোহ দমন করার জন্য নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি মুসলিম ইবনে উকবাকে মদীনা অভিমুখে প্রেরণ করবে।”৪

ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী ইয়াযীদ রক্তপিপাসু ও দয়ামায়াহীন জল্লাদ প্রকৃতির লোক মুসলিম ইবনে উকবাকে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য প্রেরণ করেছিল। হাররায় মদীনাবাসীর বিদ্রোহের পর ইয়াযীদ ইবনে মুয়াবিয়া তাকে মদীনাবাসীকে দমন করার জন্য প্রেরণ করেছিল এবং সে মদীনা নগরীতে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র রওযা শরীফের পাশে এমন সব লোমহর্ষক অপরাধ সংঘটিত করেছিল যার বর্ণনা দিতেও লজ্জা হয়।

৪. এ অসিয়তনামায় মুয়াবিয়া ইরাকবাসীর ব্যাপারে বলেছেন : “তারা যদি প্রতিদিনই তোমার কাছে শাসনকর্তা পরিবর্তন করার আবেদন জানায় তা হলে তুমিও তাদের আবেদন মঞ্জুর করবে এবং এ কাজ আঞ্জাম দেবে।” আসলে এ অসিয়তনামা আরেকটি ঐতিহাসিক বর্ণনার বিপরীত যাতে বর্ণিত হয়েছে যে,মুয়াবিয়া ইয়াযীদকে নির্দেশ দিয়েছিলেন : “উবাইদুল্লাহ্ ইবনে যিয়াদকে তুমি ইরাকের শাসনকর্তা নিযুক্ত করবে।”৫

আমাদের সবার জানা আছে যে,এই উবায়দুল্লাহ্ অন্যান্য সকল উমাইয়্যাহ্ শাসকের মতোই ছিল পাষাণ ও রক্তপিপাসু জালেম। আর সে কারবালায় ইমাম হুসাইন (আ.),তাঁর পরিবারবর্গ এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীদের সাথে যে জঘন্য অপরাধ করেছে তা মানব জাতির ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায়ের অবতারণা করেছে। আর এ কারণে সে,ইয়াযীদ ও মুয়াবিয়া তথা বনী উমাইয়্যাহ্ চিরতরে সবার কাছে সর্বাধিক ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছে।

৫. পরিশেষে এ অসিয়তনামা স্বয়ং মুয়াবিয়ার কর্মকাণ্ডেরও পরিপন্থী। কারণ,এ অসিয়তনামার বর্ণনা মোতাবেক মুয়াবিয়া ইয়াযীদকে বলেছিলেন : “যদি কোনো দিন হুসাইন তোমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং তুমিও তার ওপর বিজয়ী হও,তা হলে তার সাথে সদাচরণ করবে এবং তাকে ক্ষমা করে দেবে। কারণ,মহানবী (সা.)-এর সাথে তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা,রক্ত-সম্পর্ক ও অধিকার রয়েছে।” মুয়াবিয়া নিজেই ইমাম হুসাইনের ভাই ইমাম হাসানের সাথে-যিনি ইমাম হুসাইনেরই অনুরূপ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন-এ ধরনের আচরণ করেন নি বরং তিনি খিলাফত ত্যাগ করে মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করার পর মদীনায় ফিরে ইবাদত-বন্দেগীতে আত্মনিয়োগ করা এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকা সত্ত্বেও মুয়াবিয়া তাঁকে গোপনে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করার ষড়যন্ত্র আঁটেন এবং ইমাম হাসানের স্ত্রী জা’দাকে দিয়ে বিষ প্রয়োগ করে তাঁকে শহীদ করেন। মহানবী (সা.)-এর সাথে কি ইমাম হাসানের নিকটাত্মীয়তা,রক্ত-সম্পর্ক এবং বিরাট অধিকার ছিল না? আবার মুয়াবিয়াই কি মক্কা-মদীনা সফরকালে ইমাম হুসাইনের সাথে স্পর্ধামূলক আচরণ করেন নি এবং তিনি কি ইয়াযীদের পক্ষে বাইয়াত গ্রহণ করার লক্ষ্যে ইমাম হুসাইনকে উক্ত বাইয়াত গ্রহণের অধিবেশনে বলপূর্বক বসিয়ে তাঁর মাথার ওপর দুই ব্যক্তিকে খোলা তরবারি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে নির্দেশ দেন নি যাতে তিনি মুয়াবিয়ার বক্তব্যের পরিপন্থী কোনো কথা বললে তারা তাঁকে তৎক্ষণাৎ হত্যা করবে?

এ মুয়াবিয়াই কি হুজর ইবনে আদী,তাঁর সঙ্গী-সাথী এবং রুশাইদ হাজারীর মতো ব্যক্তিদেরকে কেবল তাঁর শাসনের বিরোধিতা করার জন্য অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও অন্যায়ভাবে হত্যা করেন নি?

তাই এ ধরনের বর্ণনার মিথ্যা ও বানোয়াট হবার প্রচুর প্রমাণ বিদ্যমান। আসলে বনী উমাইয়্যাহ্ প্রশাসনের বেতনভুক মিথ্যা হাদীস জালকারীরা অপবিত্র বিষবৃক্ষ (الشجرة الخبيثة)  জঘন্য অপরাধী বনী উমাইয়্যার মূল ব্যক্তি অর্থাৎ মুয়াবিয়ার সম্মান ও মর্যাদা বজায় রাখতে,তাঁর অপরাধের ভার কিছুটা লাঘব করে তা তাঁর কুলাঙ্গার সন্তান ইয়াযীদের কাঁধে ফেলতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে এবং দেখাতে চেয়েছে যে,যে সব জঘন্য কাজ ইয়াযীদ করেছে তিনি সেগুলোর বিরোধী ছিলেন এবং এ সব অপরাধ তাঁর দিক-নির্দেশনা ও অসিয়তের বাইরে সংঘটিত হয়েছে।৬

আমীরে মুয়াবিয়ার উক্ত অসিয়তনামার তাবারী বর্ণিত বর্ণনাদ্বয়ের মূল পাঠে আরো কিছু ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। যেমন প্রথম বর্ণনায় মুয়াবিয়া আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর,ইমাম হুসাইন (আ.),আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর এবং আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইর-কুরাইশ বংশীয় এ চার ব্যক্তির ব্যাপারে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। অথচ দ্বিতীয় বর্ণনায় আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর,ইমাম হুসাইন এবং আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইর-এ তিন ব্যক্তি সম্পর্কে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। কারণ,রেওয়ায়েত জালকারীরা উক্ত অসিয়তনামা জাল করার সময় আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর যে মুয়াবিয়ার জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন তা মিথ্যাবাদীদের স্মরণশক্তি দুর্বল বিধায় লক্ষ্য করে নি। কিন্তু অসিয়তনামা জাল ও তা প্রচার করার পর বিষয়টি বুঝতে পেরে তারা হয়তো অসিয়তনামার দ্বিতীয় পাঠ রচনা করে তা থেকে আবদুর রহমান ইবনে আবু বকরের নাম বাদ দিয়েছে। এ ছাড়া দ্বিতীয় বর্ণনায় ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ব্যক্তিত্বের ওপর ন্যাক্কারজনক হামলা করা হয়েছে যা প্রথম বর্ণনায় উল্লিখিত হয় নি। তাই একই ব্যক্তির পক্ষে কীভাবে দু’ধরনের পাঠ সম্বলিত একই অসিয়ত করা সম্ভব?

আরো লক্ষণীয় যে,অসিয়তনামার উভয় বর্ণনায় আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর ও আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইরের ব্যক্তিত্বকে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ব্যক্তিত্বের তুলনায় অধিকতর ভালো ও ইতিবাচক করে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাই এ ধরনের রেওয়ায়েত জাল করার পেছনে আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইরের সমর্থক ও অনুসারীদেরও হাত থাকতে পারে। স্মর্তব্য যে,আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইর খলীফা হবার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন। আর এ কারণে তিনি ইমাম হুসাইনকে চির প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতেন এবং চাইতেন যে,ইমাম হুসাইন যেন ইয়াযীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে নিহত হন। তাই ইমাম হুসাইন কুফাবাসীর আহ্বানের প্রেক্ষিতে কুফা গমনের সিদ্ধান্ত নিলে আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস,আবদুল্লাহ্ ইবনে জাফর প্রমুখ হিতাকাক্সক্ষী ব্যক্তি ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা ভেবে ইমাম হুসাইনকে কুফা গমন থেকে বিরত থাকার জন্য পত্র দিয়েছিলেন (যদিও তাঁরা ইমাম হুসাইনের এ মহান ঐতিহাসিক মিশনের উদ্দেশ্য ও পরিণতি সম্পর্কে অনবগত ছিলেন)। কিন্তু আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইর ইমাম হুসাইনকে কুফা গমন থেকে বিরত থাকার জন্য পত্র বা পরামর্শ প্রদান করেন নি। অধিকন্তু আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইর নিজেও যে মহানবীর আহলে বাইত তথা বনী হাশিম বিদ্বেষী ছিলেন তা ইতিহাসেও বিধৃত হয়েছে। তাই ইয়াযীদের মৃত্যুর পর তার পুত্র দ্বিতীয় মুয়াবিয়া ইবনে ইয়াযীদ পিতামহ মুয়াবিয়া ও পিতা ইয়াযীদের কুকীর্তি ও অপরাধের প্রতিবাদে খিলাফত ত্যাগ করলে দামেস্কে উদ্ভূত অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলার সুবাদে আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইর বিদ্রোহ করে নিজেকে মুসলিম বিশ্বের খলীফা ঘোষণা করেন এবং হযরত আলীর পুত্র মুহাম্মদ (ইবনে হানাফীয়াহ্) ও আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাসসহ বনী হাশিমের প্রভাবশালী ব্যক্তিদেরকে কারারুদ্ধ অথবা নির্বাসিত করেছিলেন।৭ তাই জালকারীরা মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইতের মর্যাদা এবং রাজনৈতিক-সামাজিক প্রভাব খর্ব করার জন্য এ ধরনের রেওয়ায়েত জাল করে আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর ও আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইর প্রমুখ ব্যক্তিদের ব্যক্তিত্ব,ভূমিকা ও প্রভাব উঁচু করে দেখানোর যে চেষ্টা করেছে তা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।

(চলবে)

 

তথ্যসূত্র ও পাদটীকা

১.আরো দেখুন : আল মুখতাসার ফী আখবারিল বাশার,১ম খণ্ড,পৃ. ১৮৭,আল বিদায়াহ্ ওয়ান নিহায়াহ্,৮ম খণ্ড,পৃ. ৫১০,তারীখে ইবনে খালদূন,৩য় খণ্ড,পৃ. ২২-২৩ এবং আল মুন্তাযাম,৫ম খণ্ড,পৃ. ৩২০।

২. অর্থাৎ মহানবী (সা.)-এর বংশধারার একটি শাখার উৎস হচ্ছেন হুসাইন (আ.)।

৩.আল্লামা সুয়ূতী রচিত তারীখুল খুলাফা,পৃ. ২০৫।

৪.হায়াতুল ইমাম আল হুসাইন (আ.),২য় খণ্ড,পৃ. ২৩৭।

৫. হায়াতুল ইমাম হুসাইন (আ.),২য় খণ্ড,পৃ. ২৩৮।

৬.সাইয়্যেদ হাশিম রাসূলী মাহাল্লাতী প্রণীত যিন্দেগানীয়ে ইমাম হুসাইন (ইমাম হুসাইনের জীবনী),পৃ. ১৩৮-১৪০।

৭.মাওলানা আবুল কালাম আজাদ প্রণীত ও মাওলানা মুহিউদ্দীন খান অনূদিত জীবন সায়া‎হ্নে মানবতার রূপ,পৃ. ১৪৩।

(সূত্র: জ্যোতি পত্রিকা)

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন