ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জীবনী-১১তম পর্ব
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জীবনী-১১তম পর্ব
লেখক: মো. মুনীর হোসেন খান
ইয়াযীদকে খিলাফতের ভাবী উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করার জন্য অধিবেশনের আয়োজন এবং বিভিন্ন শহর ও নগরে পত্র প্রেরণ
ইবনে আসীর প্রসিদ্ধ ইতিহাস গ্রন্থ আল কামিলে এবং তাবারী তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে ৫৬ হিজরীর ঘটনাবলী প্রসঙ্গে লিখেছেন : “যিয়াদের মৃত্যুর পরে১ মুয়াবিয়া ইয়াযীদের জন্য জনগণের কাছ থেকে বাইয়াত (আনুগত্যের শপথ) গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। এতদ্দেশ্যে তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে পত্রাদি প্রেরণ করেন। মদীনার তদানীন্তন শাসনকর্তা মারওয়ান ইবনে হাকামের কাছে তিনি চিঠি দিয়ে সেখানকার অধিবাসীদের কাছ থেকে ইয়াযীদের খিলাফতের পক্ষে বাইয়াত গ্রহণ করার নির্দেশ দেন। মারওয়ানও মদীনাবাসীদের উদ্দেশে প্রদত্ত এক ভাষণে তাদের কাছে ইয়াযীদের খিলাফতের পক্ষে বাইয়াত গ্রহণের বিষয় তুলে ধরে। মদীনাবাসীদের মধ্যে চার গণ্যমান্য ব্যক্তি ছাড়া সবাই তা মেনে নেয় অথবা নীরব থাকে। এ চার ব্যক্তি হলেন : আবু আবদিল্লাহ্ হুসাইন (আ.),আবদুর রহমান ইবনে আবী বকর. আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর এবং আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইর।
মারওয়ান পুরো ঘটনা আমীর মুয়াবিয়াকে লিখে জানালে তিনি বিভিন্ন শহর ও নগরে তাঁর গভর্ণরদের কাছে পত্র প্রেরণ করে ইয়াযীদকে ‘সৎ’ ও ‘যোগ্য’ বলে জনগণের কাছে তুলে ধরার এবং খিলাফতের রাজধানী দামেশকে বিভিন্ন প্রতিনিধিদল প্রেরণ করার নির্দেশ দেন। এ সব চিঠির কারণেই বিভিন্ন শহর ও নগর থেকে প্রতিনিধিদলসমূহের শামে আগমন শুরু হয়। যেমন : আহনাফ ইবনে কাইসের নেতৃত্বে ইরাক থেকে একটি প্রতিনিধিদল এবং মুহাম্মদ ইবনে আমর ইবনে হাযমের নেতৃত্বে মদীনাবাসীদের একটি প্রতিনিধিদল শামে গমন করে।
উপরিউক্ত প্রতিনিধিদলসমূহের আগমনের পর মুয়াবিয়া তাঁর এক ঘনিষ্ঠ সহচর যাহ্হাক ইবনে কাইস ফিহরীকে বলেন : “যখন প্রতিনিধিদলগুলো সভাস্থলে উপস্থিত হয়ে আসন গ্রহণ করবে তখন আমি বক্তৃতা দেয়া শুরু করব এবং আমার ভাষণের পর তুমি দাঁড়াবে এবং উপস্থিত জনতাকে ইয়াযীদের পক্ষে বাইয়াত করার আহ্বান জানাবে। আর আমাকেও তুমি জনতার উপস্থিতিতে এ কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করবে।”
সভা বসলে মুয়াবিয়া ভাষণ দেয়া শুরু করেন এবং ইসলামে খিলাফত প্রসঙ্গ এবং এর গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি ইয়াযীদের গুণাবলী,জ্ঞান,বুদ্ধিমত্তা এবং রাজনীতির সাথে তার পরিচিতি তুলে ধরে উপস্থিত ব্যক্তিদেরকে তার বাইয়াত করার প্রস্তাব দেন। মুয়াবিয়ার ভাষণ শেষ হবার পরপরই যাহ্হাক ইবনে কাইস দাঁড়িয়ে আগে থেকে যা ঠিক করা হয়েছিল তদনুসারে ইয়াযীদের গুণ বর্ণনা করে ইয়াযীদকে ভাবী উত্তরাধিকারী ও খলিফা ঘোষণা করার জন্য মুয়াবিয়ার প্রতি আহ্বান জানায়। এরপর আমর ইবনে সাঈদ আশরাক্ক নামের আরেক ব্যক্তিও দাঁড়িয়ে যাহ্হাকের মতোই কথা বলে। অতঃপর ইয়াযীদ ইবনে মুকান্না নামের এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে যাহ্হাক ও আমরের মতোই বক্তব্য রাখল এবং বলল : “ইনি আমীরুল মুমিনীন। তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন,তা হলে এ (ইয়াযীদ) হবে আমীরুল মুমিনীন। এর অন্যথা হলে কোনো ব্যক্তি তা মেনে নেবে না (এ কথায় সে তার তরবারির প্রতি ইঙ্গিত করে)।”২
ইবনে আসীর আরো বলেন : “মুয়াবিয়া সব ধরনের কূট কৌশল ব্যবহার করে শত্রু-মিত্র,দূরের ও কাছের লোকদেরকে তাঁর সহগামী করেন এবং অধিকাংশ মানুষই ইয়াযীদের হাতে বাইয়াত করে। ইরাক ও শামের জনগণের আনুগত্যের ব্যাপারে নিশ্চিত হবার পরে মুয়াবিয়া এক হাজার অশ্বারোহী নিয়ে হিজাযের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। মদীনার নিকটবর্তী স্থানে পৌঁছানোর পর ইমাম হুসাইন (আ.),আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইর ও আবদুর রহমান ইবনে আবী বকরের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হলে তিনি তাঁদের সাথে রূঢ় আচরণ করেন। এরপর তিনি মদীনায় প্রবেশ করেন। মদীনায় প্রদত্ত ভাষণে তিনি ইয়াযীদের প্রশংসা করেন এবং বিরোধীদেরকে হুমকি প্রদর্শন করে বলেন :
من أحق منه بالخلافة فی فضله وعقله وموضعه؟ ما أظن قوما بمنتهين حتی تصيبهم بوائق تجث أصولهم وقد أنذرت إن أغنت النذر
“আর কে তার চেয়ে খিলাফতের জন্য অধিকতর যোগ্য? কে তার গুণাবলী,জ্ঞান ও অবস্থানের (মর্যাদার) ক্ষেত্রে তার চেয়ে যোগ্য? যারা তার খিলাফতের বিরোধিতা করছে আমি মনে করি না যে,তারা তাদের এ কাজের জন্য শাস্তি না পাওয়া এবং মূলোৎপাটিত না হওয়া পর্যন্ত এ কাজ থেকে বিরত থাকবে। আর যা বলে দেয়া ও সাবধান করা উচিত তা আমি করলাম যদি সতর্কীকরণ ও সাবধান বাণী ফলপ্রসূ হয়।”
এরপর মুয়াবিয়া হযরত আয়েশার সাথে দেখা করেন। হযরত আয়েশা শুনেছিলেন যে,মুয়াবিয়া ইমাম হুসাইন ও তাঁর সাথীদের ব্যাপারে বলেছেন : لأقتلنهم إن لم يبايعوا “যদি তারা বাইয়াত না করে তা হলে আমি অবশ্যই তাদেরকে হত্যা করব।”
তাই হযরত আয়েশা তাঁকে বলেন : “শুনলাম,আপনি তাদেরকে হত্যা করার হুমকি দিয়েছেন?” মুয়াবিয়া বলেন : “এরা ইয়াযীদের খিলাফতের ব্যাপারে যে বাইয়াত নেয়া হয়েছে তার বিরোধিতা করেছে। কিন্তু যে বাইয়াত সম্পন্ন হয়েছে তা আমি কিভাবে ভঙ্গ করব?” হযরত আয়েশা বলেন : “তাদের সাথে আপনি আপস করুন এবং সদ্ভাব বজায় রাখুন। আশা করা যায় ভবিষ্যতে তারা আপনার ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করবে।”
ইবনে আসীর উল্লেখ করেছেন : এ ঘটনার পর মুয়াবিয়া পবিত্র মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং ইমাম হুসাইন,আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইর এবং অন্যদেরকেও নিজের সাথে নেন। তিনি পথিমধ্যে এবং মক্কায় প্রবেশ করার পর তাঁদের সাথে কোমল আচরণ করেন এবং মদীনায় যে আচরণ করেছিলেন ঠিক তার বিপরীতে তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। এরপর একদিন তিনি তাঁদেরকে ডেকে ইয়াযীদের খলীফা হবার ব্যাপারে তাঁদের সাথে আলোচনায় বসেন। তিনি তাঁদেরকে আহ্বান জানান তাঁরা যেন এ ব্যাপারে স্পষ্ট অভিমত প্রকাশ করেন। কিন্তু তাঁরা কোনো জবাব দিলেন না। অবশেষে মুয়াবিয়া দু’বার কথাটা পুনরাবৃত্তি করলে আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইর বললেন : “আপনি এ তিন কাজের যে কোনো একটি করুন : হয় রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর মতো খিলাফত জনগণের হাতে ছেড়ে দিন অথবা আবু বকরের মতো অন্য কোনো গোত্রের লোকের হাতে খিলাফত অর্পণ করুন অথবা উমরের মতো খলীফা নিযুক্ত করার বিষয় একটি শুরা বা পরামর্শ সভার কাছে অর্পণ করুন।”
মুয়াবিয়া জিজ্ঞাসা করলেন : “এ তিন পথ ছাড়া কি অন্য কোনো পথ নেই?” আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইর বললেন : “না।” মুয়াবিয়া বললেন : “এ পর্যন্ত আমি আপনাদের সাথে নম্র আচরণ করেছি এবং অনেক কিছু দেখেও তা উপেক্ষা করেছি। কিন্তু এরপর থেকে আপনাদের সাথে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলব।” এরপর তিনি তাঁদের প্রত্যেকের মাথার ওপর দু’জন করে সৈন্য কোষমুক্ত তরবারি হাতে দাঁড়িয়ে থাকার নির্দেশ দেন এবং বলেন : “খোদার শপথ,আমি যা বলব তা যদি আপনারা মেনে না নেন এবং আপনাদের মধ্য থেকে যে আমার কথা প্রত্যাখ্যান করবে,কোনো কথা বলার আগেই তার মাথার ওপর তরবারির আঘাত হানা হবে।”
এ কথা বলার পর মুয়াবিয়া তাঁদেরকে সাথে নিয়ে মসজিদে গিয়ে মিম্বারের ওপর দাঁড়িয়ে উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বলেন : “এঁরা মুসলমানদের গণ্যমান্য ব্যক্তি যাঁদের পরামর্শ ব্যতীত কোনো কাজই সম্পন্ন করা হয় না। এঁরা ইয়াযীদের খলীফা হবার বিষয়টি মেনে নিয়ে তার বাইয়াত করেছেন। এখন তোমরাও মহান আল্লাহর নামে ইয়াযীদের বাইয়াত কর।”
জনগণ এমন অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ইয়াযীদের খিলাফতের ব্যাপারে বাইয়াত করে। এরপর মুয়াবিয়া সফরসঙ্গীদের নিয়ে পুনরায় মদীনার দিকে রওয়ানা হন। আর জনগণ উক্ত সভার পর ইমাম হুসাইন (আ.) ও ঐ ব্যক্তিবর্গের সাথে দেখা করে বলে : “আপনারা বলেছিলেন,আপনারা ইয়াযীদের হাতে বাইয়াত করবেন না। অতঃপর কিভাবে আপনারাই আবার মেনে নিলেন এবং বাইয়াত করলেন?” তাঁরা বললেন : “আমরা বাইয়াত করি নি।” জনগণ বলল : “তা হলে আপনারা কেনো ঐ সাজানো সভায় প্রতিবাদ করেন নি?” তাঁরা বললেন : “তা হলে আমাদেরকে হত্যা করা হতো।”
এ ঘটনার পর মদীনার জনগণ ইয়াযীদের হাতে বাইয়াত করে এবং মুয়াবিয়া দামেশকে ফিরে যান।৩ আর এটিই হচ্ছে ইয়াযীদের খিলাফতের পক্ষে বাইয়াত গ্রহণের ঘটনা যা ইবনে আসীর প্রণীত আল কামিল ফীত তারীখ থেকে উদ্ধৃত করা হলো। যদিও এ বর্ণনার কিছু অংশ বিতর্কিত তথাপি মূল বিবরণ আমাদের বক্তব্যকে প্রমাণ করে বিধায় আমরা তা এখানে উল্লেখ করলাম।৪
এ বর্ণনার শেষাংশ যদি সঠিক হয়ে থাকে অর্থাৎ ইমাম হুসাইন (আ.) যে মুয়াবিয়ার জল্লাদদের উন্মুক্ত তরবারির মুখে নীরব ছিলেন এবং মুয়াবিয়ার মিথ্যা ভাষণের সময় কোনো কথা বলেন নি,তা হলে এ কথা বলা ঠিক হবে না যে,তিনি নিহত হবার ভয়ে মুখ খোলেন নি। কারণ পরবর্তী বছরগুলোতে তিনি প্রমাণ করেছেন যে,তিনি মৃত্যুকে মোটেও ভয় পেতেন না। তিনি কেবল নিজের জীবনই নয়,বরং নিজ সঙ্গী-সাথী এবং সন্তানদের প্রাণও এ পথে উৎসর্গ করেন এবং ঘৃণ্য উমাইয়্যাহ্ প্রশাসন ও পাপিষ্ঠ ইয়াযীদের খিলাফতের কাছে আত্মসমর্পণ করেন নি। কিন্তু ইমাম হুসাইন (আ.) ঐ সময়কে (মুয়াবিয়ার মক্কায় বাইয়াত গ্রহণের সময়) প্রকাশ্যে বিরোধিতা করার উপযুক্ত সময় বলে বিবেচনা করেন নি এবং প্রকৃতপক্ষে তখন এ কাজের যথার্থ ক্ষেত্রও প্রস্তুত হয় নি। যদি সেদিন ইমাম হুসাইন এ পথে শহীদ হতেন,তা হলে তাঁর রক্ত বৃথা যেত এবং কোনো ফল বয়ে আনত না। অথচ পরবর্তীতে ক্ষেত্র প্রস্তুত হবার পর তাঁর শাহাদাতের মাধ্যমে বনী উমাইয়্যার প্রকৃত চেহারা উন্মোচিত হয়ে যায়।
ইমাম হুসাইন (আ.) ভবিষ্যতে তাঁর বিপ্লব সফল হবার জন্য এবং তাঁর শাহাদাত যাতে অধিক সুফল বয়ে আনতে সক্ষম হয় সেজন্য সেদিন নীরব থাকার মধ্যেই ইসলামের বৃহত্তম কল্যাণ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাই ভবিষ্যতে ক্ষেত্র প্রস্তুত হলে এবং জনগণও যখন বনী উমাইয়্যাহ্ ও মুয়াবিয়ার কপটতা ও দুষ্কৃতি সম্পর্কে অবহিত হয় তখনই কেবল তিনি মুসলমানদের রক্ত শোষণ করে হৃষ্টপুষ্ট উমাইয়্যাহ্ প্রশাসনের বুকে মরণাঘাত হানেন এবং কারবালা প্রান্তরে বিশাল কুফরী ইয়াযীদী বাহিনীর সামনে আবির্ভূত হয়ে নিজের,নিজ সঙ্গী-সাথী ও প্রিয়জনদের জীবন ইসলামের পথে কোরবান করেন যাতে কিয়ামত পর্যন্ত ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে বীরত্বব্যাঞ্জক এ বিপ্লব অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে টিকে থাকে।
ইমাম হুসাইন (আ.) এ ঘটনার পর ৫৬ হিজরী থেকে ৬০ হিজরী অর্থাৎ আমীরে মুয়াবিয়ার মৃত্যু পর্যন্ত-এ চার বছর ধরে এ মহা ক্ষেত্র প্রস্তুত করার কাজে নিয়োজিত থাকেন। সামনে এতৎসংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
ইয়াযীদের পক্ষে বাইয়াত গ্রহণের ঘটনার পর
ইয়াযীদের পক্ষে মুয়াবিয়া কর্তৃক বাইয়াত গ্রহণের পর থেকেই ইমাম হুসাইন (আ.) মুয়াবিয়ার খিলাফত ও ইয়াযীদের সাথে বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত নেন। তখন থেকেই তিনি মুয়াবিয়া ও বনী উমাইয়্যার নির্মম অত্যাচারী প্রশাসনের রিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লব করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে থাকেন। এতদ্দেশ্যে তিনি বিশেষ,এমনকি সর্বসাধারণ সভা-সমাবেশেও বনী উমাইয়্যাহ্ ও মুয়াবিয়ার অত্যাচার-উৎপীড়নের কথা জনগণের কর্ণগোচর করতেন। আর সেই সাথে তাঁর বাসগৃহও ঐ সব অত্যাচারিত ও বঞ্চিতের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছিল যারা মুয়াবিয়ার অত্যাচারে অতিষ্ঠ এবং তাঁর শাসনের ব্যাপারে তীব্রভাবে বীতশ্রদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
বিশেষ করে ইরাকের জনগণ মুয়াবিয়ার নিযুক্ত শাসনকর্তাদের দ্বারা সবচেয়ে বেশি নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার হয়েছিল। কারণ ইরাক ছিল হযরত আলী (আ.)-এর অনুসারীদের কেন্দ্র। প্রতিদিন তাদের চোখের সামনেই কেবল হযরত আলীর অনুসারী হওয়ার কারণে বহু লোককে হত্যা করে তাদের লাশ অন্যদের শিক্ষা দেয়ার জন্য প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে রাখা হতো।
মুয়াবিয়ার গুপ্তচররা সব সময় মদীনা থেকে শামে মুয়াবিয়ার কাছে গোপন রিপোর্ট প্রেরণ করে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর আসন্ন বিপ্লব সম্পর্কে তাঁকে ভীত করে তোলে। আর তিনিও ইমাম হুসাইনের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেবেন তা ভাবতে থাকেন। এ বিষয়ে মারওয়ানের সাথে পরামর্শ করলে সে তাঁকে বলে : “আমার মতে,আপনি তাঁকে শামে আপনার কাছে নিয়ে যান তা হলে আপনি তাঁকে ইরাকবাসীদের থেকে এবং ইরাকবাসীদেরকেও তাঁর থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবেন।” এর জবাবে মুয়াবিয়া বলেন : “মহান আল্লাহর শপথ,তুমি তাঁর থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রেহাই পেতে এবং আমাকে অসুবিধার মধ্যে ফেলতে চাচ্ছ। যদি আমি তাঁর ব্যাপারে ধৈর্যধারণ করি,তা হলে আমি যা পছন্দ করি না সে ব্যাপারেই আমাকে ধৈর্যধারণ করতে হবে। আর আমি যদি তাঁর সাথে মন্দ আচরণ করতে চাই,তা হলে আমি তাঁর সাথে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করতে পারি।”
‘আনসাবুল আশরাফ’ গ্রন্থেও বর্ণিত হয়েছে যে,মারওয়ান মুয়াবিয়ার কাছে আরো একটি চিঠি লিখেছিল। তাতে সে উল্লেখ করে যে,হুসাইনের কাছে জনগণের আসা-যাওয়া বৃদ্ধি পেয়েছে। খোদার শপথ! আমি দেখতে পাচ্ছি,সে আপনাকে এক ভয়ঙ্কর দুর্দিনের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে।”
মুয়াবিয়া ঐ চিঠির জবাবে তাকে লিখেছিলেন : “যতদিন পর্যন্ত হুসাইন তোমার বিরুদ্ধে কিছু না করবে,তোমার প্রতি শত্রুতা প্রদর্শন না করবে এবং নিজের চেহারা উন্মোচন না করবে সে পর্যন্ত তাকে ছেড়ে দাও।”৫
(চলবে)
তথ্যসূত্র ও পাদটীকা
১.ইবনে আসীর এবং অন্যান্য ইতিহাসবেত্তা ৫৩ হিজরীতে যিয়াদ মৃত্যুবরণ করেছে বলে উল্লেখ করেছেন।
২. ইবনে আসীর প্রণীত আল কামিল ফিত তারীখ,৩য় খণ্ড,পৃ. ৫০৬-৫০৮।
৩. ইবনে আসীর জাযারী প্রণীত আল কামিল ফীত তারীখ,৩য় খণ্ড,পৃ. ৫০৮-৫১১।
৪. সাইয়্যেদ হাশেম রাসূলী মাহাল্লাতী প্রণীত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জীবনী,পৃ. ১১৭-১১৯।
৫. হায়াতুল ইমাম হুসাইন (আ.),২য় খণ্ড,পৃ. ২২৩।
(সূত্র: জ্যোতি পত্রিকা)
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন