ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মিয় নেতা আলি খামেমায়ি’এর হজবাণী
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মিয় নেতা আলি খামেমায়ি’এর হজবাণী
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
ওয়ালহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন ওয়াস্ সালাতু ওয়াস্ সালামু আলা সাইয়্যিদিল খালকি আজমায়িন। মুহাম্মাদিউঁ ওআলিহিত্ তাহিরিন, ওসাহবিহিল মুনতাজিবিন,ওআলাত্ তাবিয়িনা লাহুম বিইহসানি ইলা ইয়াওমিদ্দিন।
তৌহিদের ঘাঁটি মহান কাবার প্রতি সালাম, যে কাবা মুমিনদের তাওয়াফের স্থান, ফেরেশ্তাদের অবতরণস্থল! সালাম মাসজিদুল হারামের প্রতি, আরাফাতের ময়দান, মাশআর এবং মিনার প্রতি সালাম! একইভাবে বিনয়ী অন্তরগুলোর প্রতিও সালাম, সালাম জিকরধ্বনিময় মুখগুলোর প্রতি, উন্মুক্ত অন্তর্দৃষ্টির অধিকারীদের প্রতি, সঠিক পন্থার দিশারি চিন্তাধারার প্রতিও সালাম। সালাম হজ্জব্রত পালনকারী সেইসব সৌভাগ্যবানের প্রতি যাঁরা আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দিয়ে লাব্বায়িক বলার তৌফিক লাভ করেছেন এবং ঐশী নিয়ামতে পরিপূর্ণ দস্তরখানে বসার সুযোগ পেয়েছেন।
সর্বপ্রথম দায়িত্ব হলো এই সার্বজনীন, ঐতিহাসিক এবং বিশ্বজনীন লাব্বায়িক নিয়ে চিন্তাভাবনা করা: ইন্নাল হামদা ওয়ান্নিমাতা লাকা ওয়াল মুল্ক, লা শারিকা লাকা লাব্বায়িক। সকল প্রশংসা এবং সকল কৃতজ্ঞতা শুধুমাত্র তাঁরই জন্য, সকল নিয়ামত তাঁরই পক্ষ থেকে এসেছে এবং সকল রাজ্য কিংবা রাজত্ব এবং সকল ক্ষমতার মালিক তিনিই। একজন হজ্জ পালনকারীর প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে এই গূঢ় অর্থপূর্ণ ঐশী হুকুম বা বিধান পালনের ক্ষেত্রে উপর্যুক্ত বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি দেওয়া উচিত।
এই ফরয বিধান পালনের ধারাবাহিকতায় একজন হাজিকে হজ্জের আনুষ্ঠানিকতাগুলোর সাথে মিশে যেতে হবে। তাহলেই হজ্জ পালনকারী হজ্জের অবিস্মৃতব্য ও অবিনশ্বর শিক্ষাগুলো আত্মস্থ করতে পারবেন এবং সেইসব শিক্ষার আলোকে নিজের জীবনের কর্মসূচিগুলো সাজিয়ে নিতে পারবেন। হজ্জের দাবি এটাই। এই মহান শিক্ষা অর্জন করার পর সেই অনুযায়ী আমল করা হলে জীবনটা এমনই বরকতপূর্ণ হয়ে উঠবে যে একজন মুসলমান সেই রহমত ও বরকতের সাহায্যে নিজের জীবনকে জীবন্ত, প্রাণবন্ত এবং আনন্দময় করে তুলতে পারবেন। জীবনের প্রতিবন্ধকতাগুলো এ সময় তো বটেই সব সময়ের জন্যই তিনি কাটিয়ে উঠতে পারবেন।
আত্মপূজা বা ভোগবিলাসের মূর্তি, গর্ব-অহংকার ও কামনা-বাসনার মূর্তি, আধিপত্য মেনে নেওয়া এবং আধিপত্যকামিতার মূর্তি, বিশ্বসাম্রাজ্যবাদ ও বলদর্পিতার মূর্তি, দায়িত্বহীনতা এবং অলসতার মূর্তি, মানব জীবনের মূল্যকে তুচ্ছ করে তোলার মূর্তি ইত্যাদি সকল মূর্তি অন্তরের গহীন থেকে আসা ইব্রাহিমি এই উচ্চ স্বরধ্বনির মাধ্যমে ভেঙে চুরে খানখান হয়ে যাবে। ক্লান্তি অবসন্নতা, দুরবস্থা, পরনির্ভরশীলতা ইত্যাদির পরিবর্তে জীবনে নেমে আসবে প্রশান্তি, সম্মান, মর্যাদা এবং স্বাধীনতার সুখ ও আনন্দ।
হজ্জ পালনকারী প্রিয় ভাইবোনেরা! আপনাদের যিনি যে দেশ থেকেই কিংবা যে জাতি থেকেই এসে থাকুন না কেন আপনাদের উচিত ঐশী এই হেকমতপূর্ণ কথাগুলো নিয়ে একবার ভালোভাবে ভাবা, চিন্তাভাবনা করা এবং তারই শিক্ষার আলোকে বর্তমান মুসলিম বিশ্বের বিশেষ করে উত্তর আফ্রিকা এবং পশ্চিম এশিয়ার সমস্যাগুলোর দিকে দৃষ্টি দেয়া। সেইসাথে সবার উচিত যার যার ব্যক্তিগত ও পারিপার্শ্বিক সামর্থ্য অনুযায়ী কর্তব্য নির্ধারণ করে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করা।
আজ মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার কুচক্রী নীতি এ অঞ্চলের জনগণের জন্য বয়ে এনেছে যুদ্ধ, রক্তপাত ও ধ্বংসলীলা, সৃষ্টি করেছে উদ্বাস্তু সমস্যা, দারিদ্র, পশ্চাদপদতা এবং ধর্মীয় ও জাতিগত মতবিরোধ। অন্যদিকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রে ইহুদিবাদী ইসরাইলের অপরাধযজ্ঞ ও বর্বর আচরণ নৃশংসতা ও নির্দয়তার চরমে পৌঁছেছে।
ইহুদিবাদীরা একের পর এক মসজিদুল আকসার অবমাননা করছে। পাশাপাশি তাদের দমন-পীড়নে নির্যাতিত ফিলিস্তিনি জাতির সম্পদ ও প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছে। আমেরিকা ও ইহুদিবাদী ইসরাইলের এই ঘৃণিত আচরণ আজ গোটা মুসলিম জাহানের প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনাদের উচিত এই বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা এবং এর মোকাবিলায় ইসলামের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী নিজেদের কর্তব্য নির্ধারণ করা।
এ ব্যাপারে মুসলিম বিশ্বের আলেম সমাজ এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের কর্তব্য রয়েছে অনেক বেশি; কিন্তু দুঃখজনকভাবে তাদের বেশিরভাগই রয়েছেন গভীর ঘুমে বিভোর। আলেমদের উচিত ধর্মীয় বিভেদের আগুন জ্বালানো বাদ দেয়া, রাজনৈতিক নেতাদের উচিত শত্রুর মোকাবিলায় ভাবলেশহীনতা পরিহার করা এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের উচিত আনন্দ-ফুর্তিতে গা ভাসানো বন্ধ করা। আর তাদের সবার উচিত মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তম ব্যাথা চিহ্নিত করে তা উপসমের ব্যবস্থা করা। কারণ, আল্লাহ রব্বুল আলামিনের দরবারে একদিন তাদেরকে এই কর্তব্য পালনের ব্যাপারে জবাবদিহী করতে হবে।
মধ্যপ্রাচ্যের কান্না উদ্রেককারী ঘটনাপ্রবাহ বিশেষ করে ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন, জর্দান নদীর পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা এবং এশিয়া ও আফ্রিকার আরো কিছু দেশের ঘটনাবলী বর্তমান মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় সংকট। এসব সংকটে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ষড়যন্ত্র খুঁজে বের করে তা নস্যাতের উপায় নিয়ে ভাবতে হবে। মুসলিম জাতিগুলোকে তাদের সরকারগুলোর কাছে এ দাবি জানাতে হবে এবং সরকারগুলোকে তাদের গুরুদায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে।
হজ্বের মহা আড়ম্বরপূর্ণ সমাবেশ হচ্ছে এই ঐতিহাসিক কর্তব্য পালনের ক্ষেত্র সৃষ্টি ও দায়িত্ব বন্টনের সর্বোত্তম স্থান। বারাআত বা মুশরিকদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা হচ্ছে হজ্বের মহাসম্মিলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আনুষ্ঠানিকতা যা সকল দেশের সব হাজীর গুরুত্বসহ পালন করা উচিত।
এ বছর মসজিদুল হারামের দুঃখজনক ও প্রাণহানিকর ঘটনা হজ্বযাত্রীদের পাশাপাশি মুসলিম জাতিগুলোকে বেদনাসিক্ত করেছে। এটা ঠিক যে, এই দুঃখজনক ঘটনায় নিহত ব্যক্তিরা নামাজ ও তাওয়াফসহ অন্যান্য ইবাদতে মশগুল ছিলেন এবং মহান আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত লাভের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন।
কাজেই পৃথিবীর নিরাপদতম স্থানে বসেই তারা সৃষ্টিকর্তার দিদার লাভ করে থাকবেন ইনশাআল্লাহ। এটি মহাসৌভাগ্যের বিষয় এবং তাদের নিকটজনদের জন্য এটিই সান্ত্বনা। তবে যারা আল্লাহর ঘরের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন এর মাধ্যমে তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তারা তাদের প্রতিশ্রুতি ও গুরুদায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন- এটাই আমাদের একান্ত প্রত্যাশা।
ওয়াসসালামু আলা ইবাদিল্লাহিস সলেহিন
সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী
৪ জ্বিলহাজ ১৪২৬ হিজরি মোতাবেক ২৭ শাহরিভার ১৩৯৪ ফারসি সাল।
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন