আহলে সুন্নাতের আলেমগণের দৃষ্টিতে এজিদ

আহলে সুন্নাতের আলেমগণের দৃষ্টিতে এজিদ

আহলে সুন্নাতের আলেমগণের দৃষ্টিতে এজিদ

এজিদ, মাবিয়া, কারবালা, ইমাম, ইমাম হুসাইন, আবু কুবাইস, ইবনে যিয়াদ, কুফা,

এস, এ, এ

মানুষের কর্ম তার নামকে মানুষের অন্তরে জিবিত রাখে। আর তাই আমরা দেখতে পাই যে, ইতিহাসে একাধিক মানুষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কারো নামকে সম্মানের সহিত এবং কারো নামকে অসম্মানের সহিত স্মরণ করা হয়। আর এর মূলেই রয়েছে উক্ত ব্যাক্তিদের কৃতকর্ম। এজিদ হচ্ছে এমন একটি নাম যে ৬১ হিজরির পরে আর মুসলমানরা নিজেদের সন্তানদের নাম এজিদ রাখেনি। আর এতেই তার পরিচয় পাওয়া যায় যে সে কেমন প্রকৃতির মানুষ ছিল। এজিদ মুসলমানদের কোন ফেরকার মানুষের কাছে কোন কালেই শ্রদ্ধার পাত্র ছিল না। আর তাই ইতিহাস এবং ঐতিহাসিকগণের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে বুঝতে পারি যে, তারা এজিদ সম্পর্কে কিরূপ মতামত প্রকাশ করতো। নিন্মে কিছু মতামতকে উল্লেখ করা হলো:

ইবনে হাজার আসকালানি ছিলেন আহলে সুন্নাতের একজন প্রসিদ্ধ গবেষক, লেখক এবং আলেম। তিনি লিখেছেন যে, আহলে সুন্নাতের লোকেরা এজিদের কাফের হওয়ার বিষয়ে তৃমত পোষণ করে থাকেন।

১- একদল লোকের মতে (এসকাফি, অলুসি এবং ইবনে জুযি)এজিদ কাফের এবং অভিসম্পাতের উপযোগি।

২- আরেক দলের মতে এজিদ কাফের না।

৩- আরেক দলের মতে (আবু হামেদ গাজ্জালি, ইবনে আরাবি মালেকি, ইবনে খালদুন) এজিকে অভিসম্পাত করা ঠিক না।

৪- আরেক দলের মতে এজিদের বিষয় নিয়ে আলোচনা না করা।

আর উক্ত চার দলের লোকদের জন্য নিন্মে এজিদ সম্পর্কে আহলে সুন্নাতের বিভিন্ন আলেমদের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে উল্লেখ করা হলো।

ইবনে হাজার আসকালানি বলেন: এ শ্রেণীর লোকেরা যারা এজিদকে কাফের বলে মনে করে তার কারণ হচ্ছে যখন ইমাম হুসাইন (আ.)’এর কাটা মস্তককে শামে আনা হয়। তখন এজিদ তার দরবারে জনগণের সম্মুখে তার হাতের ছড়ি দিয়ে ইমাম হুসাইন (আ.)’এর মাথা ও দাঁতে আঘাত করে বলে:

ليت اشياخى ببدر شهدوا *** جزع الخزرج من وقع الأسل
لأهلوا و استهلوا فرحاً *** ثم قالوا يا يزيد لا تشل...
لعبت هاشم بالملك فلا *** خبر جاء ولا وحى نزل

ইবনে জুযি বলেন: ইমাম হুসাইন (আ.)’এর সাথে ইবনে যিয়াদের যুদ্ধ কোন আশ্চর্যের বিষয় ছিল না। বরং এজিদ ইমাম হুসাইন (আ.)’এর কাটা মস্তক ও দাঁত মোবারকে আঘাত করছিল এবং রাসুল (সা.)’এর আহলে বাইত (আ.)কে বন্দি অবস্থায় উটের পিঠে আরোহন করে জনসম্মুখে তাদেরকে শামে নিয়ে আসাটাই ছিল আশ্চর্যের বিষয়। এজিদের উক্ত কর্ম থেকে স্পষ্ট হয় যে, তার অন্তরে জাহেলি যুগের ন্যায় বিদ্বেষ এবং হিংস্রতা কোন অংশেই কম ছিল না। যদি তার অন্তরে বদরের যুদ্ধের বণি উমাইয়ার মৃত ব্যাক্তিদের প্রতিশোধের আগুন প্রজ্জলিত ছিল।

তারা তাদের উক্ত দাবিকে প্রমাণিত করার জন্য বলে যে, যখন এজিদ ইমাম হুসাইন (আ.)’এর কাটা মস্তককে দেখে তখন সে বলে: হে হুসাইন তোমার উপরে আল্লাহর রহমত নাযিল হোক। তোমাকে এমন এক ব্যাক্তি হত্যা করেছে যে তার উক্ত কাজের মাধ্যেমে ভাল খারাপ সকল মানেুষের অন্তরে আমার জন্য ঘৃণার সৃষ্টি করে দিয়েছে। (সাওয়ায়েকে মোহরেকা, পৃষ্ঠা ২১৮)

এই মতাদর্শের অনুসারিদের ক্ষেত্রে বক্তব্য হচ্ছে ইবনে জুযি তার এক গ্রন্থে লিখেছেন যে, একজন আমাকে জিজ্ঞাসা করে যে, এজিদ এবং মাবিয়ার যে জঘণ্য কাজ করেছিল সে কারণে তাদের প্রতি অভিসম্পাত করা জায়েজ কিনা? আমি তাদের উত্তরে বলি যে, ইমাম আহমাদ তাদের প্রতি অভিসম্পাত করা জায়েজ বলে মনে করেন।

এছাড়া শেইখ আব্দুল করিম উদ্দিন তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, সকল মুসলমানগণ আহলে বাইত (আ.) তথা ফাতেমা, আলি, হাসান ও হুসাইন (আ.)কে ভালবাসে এবং তাদের প্রতি দুরুদ ও সালাম প্রেরণ করে। এছাড়া তিনি আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসার ক্ষেত্রে হাদিসও বর্ণনা করেছেন যে, এজিদ এবং তার অনুসারিগণ রাসুল (সা.)’এর আহলে বাইতের উপরে অত্যাচার ও অপমান করেছিল। সুতরাং তারা হচ্ছে অভিশম্পাতের অধিকারি। সুতরাং যদি কেউ এজিদের প্রতি অভিশম্পাত প্রেরণ করাকে জায়েজ বলে মনে না করে তাহলে তারা যেন উক্ত লেখকের পুস্তকটির অধ্যায়ন করে। কেননা তিনি তার গ্রন্থে আরো লিখেছেন যে, কিছু লোক এজিদের প্রতি অভিসম্পাত করাকে জায়েজ বলে মনে করে না এবং ভয় করে যে, তাদের  প্রেরিত লানতের ভাগিদার হয়তো তার বাবা মাবিয়াও হয়ে যাবে।

ইবনে হাজার আসকালানি লিখেছেন: কাজি আবু আলি নামক এক লেখকের ‘চে কাসি ইসতেহকাকে লাআন দরাদ’ নামক পুস্তকে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এজিদ হচ্ছে ঐ সকল ব্যাক্তিদের মধ্যে অন্যতম যাদের প্রতি আভিশম্পাত করা জায়েজ রয়েছে। উক্ত লেখকটি তার কথার দলিল স্বরূপ রাসুল (সা.) থেকে বর্ণিত একটি রেওয়ায়েত উপস্থাপন করেছে যে, রাসুল (সা.) বলেছেন: যদি কোন ব্যাক্তি মদিনার লোকদের ভয় দেখায় তাহলে মহান আল্লাহ তায়ালা তাকে ভয় দেখাবে এবং তাকে আল্লাহ, ফেরেস্তা এবং মানুষের অভিসম্পাতের মুখে পতিত করবেন।

আর এজিদ তার সৈন্যদেরকে মদিনাবাসিদের উপরে হামলা করার জন্য প্রেরণ করে। আর এজিদি সৈন্যরা মদিনাবাসিদের উপরে যে অত্যাচার করেছিল তা হচ্ছে ইতিহাসের একটি নজির বিহিন ও জঘণ্যতম ঘটনা। আর উক্ত ঘটনার কারণে শুধুমাত্র মদিনাবাসিদের অন্তর কেঁপে উঠেনি বরং উক্ত ঘটনা শোনার পরে আজও সকল মুসলমানদের অন্তর কেঁপে উঠে।

আর এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এজিদের নির্দেশে তার সৈন্য বাহিনিরা মদিনাবাসিদের সকল কিছুকে মুবাহ বলে মনে করেছিল এবং উল্লেখ করা হয় যে, ৩০০ মেয়েকে জোরপূর্বক গর্ভবতি করা হয়, সাহাবিদেরকে হত্যা করা হয় এবং মসজিদে নবাবিতে জামাতের নামাজকে বন্ধ করে দেয়। অতঃপর সে আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইরের সাথে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং পবিত্র কাবা গৃহে মিন্জানিক দ্বারা অগ্নিগোলা বর্ষণ করে। (সাওয়ায়েকে মোহরেকা, পৃষ্ঠা ২২২)

শাহ আব্দুল হক মোহাদ্দেস দাহলাভি তার ‘মা সাবতু মিনাস সেনাতি’ নামক গ্রন্থের ৬৩ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম হুসাইন (আ.)কে শহিদ করার পরে তাঁর কাটা মাথাকে একটি পাত্রে রেখে ইবনে যিয়াদের কাছে উপস্থাপন করে। আল্লাহর লানত হোক ইমাম হুসাইন (আ.)’এর হত্যাকারি, ইবনে যিয়াদ, এজিদ এবং মাবিয়ার উপরে।

সাআদ উদ্দিন তাফতাযানি উল্লেখ করেছেন যে, রাসুল (সা.)’এর আহলে বাইত (আ.)’এর উপরে যে অত্যাচার করা হয়েছে তা এতই স্পষ্ট যে তাতে কোন প্রকার সন্দেহ পোষণের অবকাশ নেই। (শারহে মাকাসেদ সাআদ উদ্দিন তাফতাযানি, খন্ড ৫, পৃষ্ঠা ৩১১)

মাসউদি এজিদ সম্পর্কে লিখেছেন যে, সে ছিল একজন আমোদপ্রেমি মানুষ, তার কাছে ছিল শিকারি পশু, সে কুকুর ও বানর নিয়ে খেলা করতো এবং মদ্যপান অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো। ইমাম হুসাইন (আ.)কে শহিদ করার পরে সে একটি মদ্যপান অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল এবং সেখানে ইবনে যিয়াদ তার ডান পাশে বসে মদ পান করছিল এবং এজিদ বলছিল:  আমাকে এত পরিমাণে মদ পান করাও যেন আমি পরিতৃপ্ত হয়ে যায়। আর অনুরুপভাবে ইবনে যিয়াদকেও মদ পান করাও কেননা সে হচ্ছে আমার গোপনীয়তা রক্ষাকারি, আমানতদার। তার মাধ্যেমেই আমার খেলাফত আরো শক্তিশালি হয়েছে অর্থাৎ সে হুসাইন ইবনে আলিকে হত্যা করেছে।

মাসউদি আরো লিখেছেন যে, এজিদের একটি বানর ছিল যার নাম সে রেখেছিল ‘আবু কাবাইস’ সে উক্ত বানরকে মদ্যপানের অনুষ্ঠানে নিয়ে আসতো তার জন্য বালেশের ব্যাবস্থা করা হতো এবং তাকে একটি ক্ষুদ্রকায় অশ্বের উপরে আরোহন করতো এবং তাকে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করাতো। এজিদের উক্ত বানরটি রেশমের লাল রংয়ের এক ধরণের আরবি পোষাক পরিধান করাতো এবং তার মাথায় বিভিন্ন রংয়ের টুপি পরাতো।(বাররাসি তারিখে আশুরা, পৃষ্ঠা ৭৭)

 

 

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন