সাহাবিরা কি সকলেই ন্যায়পরায়ণ ছিলেন?

সাহাবিরা কি সকলেই ন্যায়পরায়ণ ছিলেন?

সাহাবি, রাসুল, মুনাফিক, মদিনা, আসহাব,

সালাফি বা ওহাবী এবং তাদের জঙ্গি গোষ্ঠিরা শিয়াদের দোষ বা ত্রুটি হিসেবে বিবেচনা করে তা হচ্ছে এমনকি তারা শিয়াদেরকে এক্ষেত্রে কাফের বলেও মনে করে। তারা বলে যে শিয়ারা সাহাবীদের নিন্দা করে।

তাদের উক্ত অপবাদটি হচ্ছে সম্পূর্ণরূপে ভুল এবং মিথ্যা। কেননা শিয়ারা মাযহাবের অনুসারীরা রাসুল (সা.)’এর প্রকৃত সাহাবিদেরকে যথেষ্ট সম্মান করে যেমন সালমান, আবু যার , মেকদাদ (রা.)। সুতরাং ওহাবি বা সালাফিদের উক্ত অপবাদটি হচ্ছে সম্পূর্নরূপে ভুল এবং মিথ্যা। তারা এভাবে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ছড়ানোর চেষ্টা করছে এবং এক্ষেত্রে সকল মুসলমানদের উচিত হবে যেন আমরা সকলে মিলে তাদের উক্ত ষড়যন্ত্রকে নস্যাত করি।

রাসুল (সা.)’এর সাহাবীদের ক্ষেত্রে দুটি মতামত রয়েছে:

প্রথম মতামত: সালাফি বা ওহাবীদের মতে রাসুল (সা.)’এর সকল সাহাবিরা হচ্ছেন ন্যায়পরায়ণ এবং মুজতাহিদ এক্ষেত্রে আমরা কিভাবে সত্যকে নির্ধারণ করবো। তাদের মতে সকল সাহাবিরা ছিলেন মুজতাহিদ এবং তারা নিজেদের কাজে নিজেরাই ফতোয়া জারি করতেন। আর যদি এক্ষেত্রে তারা ভুলও করে থাকেন তাহলেও তাদেরকে একটি সওয়াব দান করা হবে। আর যদি কেউে এক্ষেত্রে গবেষণা করতে চায় তাহলে সে রাসুল (সা.)’এর সাহাবিদেরকে অপমানিত করলো।

কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে এ সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে যে,

لَقَدْ رَضِيَ اللَّهُ عَنِ الْمُؤْمِنينَ إِذْ يُبايِعُونَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ ما في‏ قُلُوبِهِمْ فَأَنْزَلَ السَّكينَةَ عَلَيْهِمْ وَ أَثابَهُمْ فَتْحاً قَريباً

অর্থ: আল্লাহ মুমিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন, যখন তারা বৃক্ষের নীচে আপনার কাছে শপথ করল। আল্লাহ অবগত ছিলেন যা তাদের অন্তরে ছিল। অতঃপর তিনি তাদের প্রতি প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদেরকে আসন্ন বিজয় পুরস্কার দিলেন। (সূরা ফাতহ, আয়াত নং ১৮)

দ্বিতীয় মতামত: সাহাবি হওয়ার ক্ষেত্রে হক্ব ও বাতিলের মানদন্ড না থাকলেও চলবে, মুমিন না হওয়া, সাহাবি না হওয়া, রাসুল (সা.)’এর সন্তান না হওয়া এমনকি রাসুল (সা.)’এর স্ত্রী না হলেও চলবে।

কিন্তু যখন আমরা কোরআনের প্রতি দৃষ্টিপাত করি তখন দেখতে পাই যে, মহান আল্লাহ তায়ালা রাসুল (সা.) কে বলছেন:

وَ لَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَ إِلَى الَّذينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَ لَتَكُونَنَّ مِنَ الْخاسِرينَ

অর্থ: আপনার প্রতি এবং আপনার পূর্ববর্তীদের পতি প্রত্যাদেশ হয়েছে, যদি আল্লাহর শরীক স্থির করেন, তবে আপনার কর্ম নিষ্ফল হবে এবং আপনি ক্ষতিগ্রস্তদের একজন হবেন। (সূরা যুমার, আয়াত নং ৬৫)

পবিত্র কোরআনে আরো বলা হচ্ছে:

إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ

অর্থ: নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক পরহেযগার। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন। (সূরা হুজরাত, আয়াত নং ১৩)

উক্ত আয়াতে সাহাবি হওয়ার মানদন্ড উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, যারা সর্বাধিক পরহেযগার আল্লাহর কাছে তাদের  মর্যাদা রয়েছে।

এমনকি রাসুল (সা.)’এর স্ত্রী তথা উম্মুল মুমিনিনদের ক্ষেত্রেও বলা হয়েছে যে,

يَا نِسَاء النَّبِيِّ مَن يَأْتِ مِنكُنَّ بِفَاحِشَةٍ مُّبَيِّنَةٍ يُضَاعَفْ لَهَا الْعَذَابُ ضِعْفَيْنِ وَكَانَ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرًا

অর্থ: হে নবী পত্নীগণ! তোমাদের মধ্যে কেউ প্রকাশ্য অশ্লীল কাজ করলে তাকে দ্বিগুণ শাস্তি দেয়া হবে। এটা আল্লাহর জন্য সহজ। (সূরা আহযাব, আয়াত নং ৩০)

আর এক্ষেত্রে সাহাবিদের ন্যায়পরায়ণ এবং মুজতাহিদ হওয়ার ক্ষেত্রে এবং তারা সকলেই হবেন বেহেস্তবাসী উক্ত কথাটি হচ্ছে সম্পূর্ণরূপে ভুল এবং উক্ত বিষয়টি কোরআন, হাদিস, যুক্তি এবং ইতিহাসের সাথে কোনভাবেই সামন্জস্যপূর্ণ না।

পবিত্র কোরআনে একটি সূরা রয়েছে যার নাম হচ্ছে মুনাফেকুন। মুসলমানদের মধ্যে মুনাফিক কারা? তাহলে কারা ছিল যারা রাসুল (সা.)’এর সাহাবিদের ছদ্মবেশে অবস্থান করছিল এবং তারা ঈমান নিয়ে আসেনি বরং তারা ইসলামের ক্ষতি সাধনের জন্য এবং ব্যাক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ইসলামকে ঢাল স্বরূপ ব্যাবহার করতো। পবিত্র কোরআন শরিফে মুনাফিকদের সম্পর্কে একাধিক আয়াত নাযিল হয়েছে যেমন:

وَ مِمَّنْ حَوْلَكُمْ مِنَ الْأَعْرابِ مُنافِقُونَ وَ مِنْ أَهْلِ الْمَدينَةِ مَرَدُوا عَلَى النِّفاقِ لا تَعْلَمُهُمْ نَحْنُ نَعْلَمُهُمْ سَنُعَذِّبُهُمْ مَرَّتَيْنِ ثُمَّ يُرَدُّونَ إِلى‏ عَذابٍ عَظيمٍ

অর্থ: আর কিছু কিছু তোমার আশ-পাশের মুনাফেক এবং কিছু লোক মদীনাবাসী কঠোর মুনাফেকীতে অনঢ়। তুমি তাদের জান না; আমি তাদের জানি। আমি তাদেরকে আযাব দান করব দু’বার, তারপর তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হবে মহান আযাবের দিকে। (সূরা তওবা, আয়াত নং ১০১)

إِذا جاءَكَ الْمُنافِقُونَ قالُوا نَشْهَدُ إِنَّكَ لَرَسُولُ اللَّهِ وَ اللَّهُ يَعْلَمُ إِنَّكَ لَرَسُولُهُ وَ اللَّهُ يَشْهَدُ إِنَّ الْمُنافِقينَ لَكاذِبُون

অর্থ: মুনাফিকরা আপনার কাছে এসে বলেঃ আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি নিশ্চয়ই আল্লাহর রসূল। আল্লাহ জানেন যে, আপনি অবশ্যই আল্লাহর রসূল এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী। (সূরা মুনাফেকুন, আয়াত ১)

এছাড়া এ সম্পর্কে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে,

حَدَّثَنَا إِبْرَاهِيمُ بْنُ المُنْذِرِ الحِزَامِيُّ، حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ فُلَيْحٍ، حَدَّثَنَا أَبِي، قَالَ: حَدَّثَنِي هِلاَلُ بْنُ عَلِيٍّ، عَنْ عَطَاءِ بْنِ يَسَارٍ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: " بَيْنَا أَنَا قَائِمٌ إِذَا زُمْرَةٌ، حَتَّى إِذَا عَرَفْتُهُمْ خَرَجَ رَجُلٌ مِنْ بَيْنِي وَبَيْنِهِمْ، فَقَالَ: هَلُمَّ، فَقُلْتُ: أَيْنَ؟ قَالَ: إِلَى النَّارِ وَاللَّهِ، قُلْتُ: وَمَا شَأْنُهُمْ؟ قَالَ: إِنَّهُمُ ارْتَدُّوا بَعْدَكَ عَلَى أَدْبَارِهِمْ القَهْقَرَى. ثُمَّ إِذَا زُمْرَةٌ، حَتَّى إِذَا عَرَفْتُهُمْ خَرَجَ رَجُلٌ مِنْ بَيْنِي وَبَيْنِهِمْ، فَقَالَ: هَلُمَّ، قُلْتُ أَيْنَ؟ قَالَ: إِلَى النَّارِ وَاللَّهِ، قُلْتُ: مَا شَأْنُهُمْ؟ قَالَ: إِنَّهُمُ ارْتَدُّوا بَعْدَكَ عَلَى أَدْبَارِهِمْ القَهْقَرَى، فَلاَ أُرَاهُ يَخْلُصُ مِنْهُمْ إِلَّا مِثْلُ هَمَلِ النَّعَمِ

আমি কেয়ামতের দিন হাউযে কাউসারের কাছে দাড়িয়ে থাকবো তখন আমার কাছ থেকে কিছু সাহাবিকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাওয়া হবে আমি তখন বলবো এদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? ফেরেস্তারা বলবে আল্লাহর শপথ! তাদেরকে জাহান্নামের আগুনের দিকে নিয়ে যাচ্ছি তখন আমি জিজ্ঞাসা করবো যে কেন তারা কি  করেছিল? তখন ফেরেস্তারা বলবে যে, এরা আপনার সাহাবি ছিল কিন্তু তারা আপনার পরে মুরতাদ হয়ে গেছিল এবং বিদআত করছিল এবং জাহেলিয়াতের যুগের ন্যায় আমল করতো। তারপরে আরো এক দলকে জাহান্নামের আগুনের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে এবং তারা কেউই জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণ পাবে না। (সহিহ বুখারি, খন্ড ৮, পৃষ্ঠা ১২১)

উক্ত কোরআনের আয়াত এবং হাদিস থেকে স্পষ্ট হয় যে, যাদের সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ এবং রাসুল (সা.) বলেছেন তারা কি সত্যবাদি ছিলেন নাকি মিথ্যাবাদি। তারা কি মুমিন ছিলেন নাকি মুনাফিক। পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে আরো বলা হয়েছে যে,

يا أَيُّهَا الَّذينَ آمَنُوا إِنْ جاءَكُمْ فاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَنْ تُصيبُوا قَوْماً بِجَهالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلى‏ ما فَعَلْتُمْ نادِمين

অর্থ: মুমিনগণ! যদি কোন পাপাচারী ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোন সংবাদ আনয়ন করে, তবে তোমরা পরীক্ষা করে দেখবে, যাতে অজ্ঞতাবশতঃ তোমরা কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত না হও। (সূরা হুজরাত, আয়াত নং ৬)

যদি আমরা বলি যে, রাসুল (সা.)’এর সকল সাহাবিরা হচ্ছেন সত্যবাদি এবং মুজতাহিদ। কিন্তু যখন আমরা ঐ সকল সাহাবিদের কাছ থেকে দ্বিনকে নিব যারা হচ্ছেন মিথ্যাবাদি এবং মুনাফিক তাহলে অবশ্যই আমরা ভুল পথে পতিত হব।

এটা কিভাবে সম্ভব যে, আবু সুফিয়ানের মতো লোক যে বছরের পর বছর ধরে রাসুল (সা.)’এর বিরূদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে বিভিন্ন যুদ্ধে মুসলমানদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করেছে একাধিক মুসলমান যেমন হজরত হামজা (রা.)  শাহাদতের পিছনে তার হাত ছিল এবং মক্কা বিজয়ের পরে সে ঈমান নিয়ে আসে। সে আবু সুফিয়ান কিভাবে হঠাৎ করেই সাহাবি এবং মুজতাহিদ হয়ে যায়? যদি সকল সাহাবিগণ মুজতাহিদ হন তাহলে কি নাউযুবিল্লাহ আল্লাহ তায়ালা মুনাফিকদের সম্পর্কে আয়াত নাযিল করে ভুল করেছেন? পবিত্র কোরআন এবং কোন হাদিসে উল্লেখ করা হয়নি যে, রাসুল (সা.)’এর সকল সাহাবিগণ হচ্ছে পবিত্র, ন্যায়পরায়ণ এবং বেহেস্তবাসি। বরং কোরআন এবং বিভিন্ন হাদিসের গ্রন্থ সমূহে এর বীপরিতে আয়াত এবং হাদিস বর্ণিত হয়েছে।

إِنَّ الْمُنافِقينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ وَ لَنْ تَجِدَ لَهُمْ نَصيرا

অর্থ: নিঃসন্দেহে মুনাফেকরা রয়েছে দোযখের সর্বনিম্ন স্তরে। আর তোমরা তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী কখনও পাবে না।(সূরা নিসা, আয়াত নং ১৪৫)

إِنَّ الَّذينَ يُبايِعُونَكَ إِنَّما يُبايِعُونَ اللَّهَ يَدُ اللَّهِ فَوْقَ أَيْديهِمْ فَمَنْ نَكَثَ فَإِنَّما يَنْكُثُ عَلى‏ نَفْسِهِ وَ مَنْ أَوْفى‏ بِما عاهَدَ عَلَيْهُ اللَّهَ فَسَيُؤْتيهِ أَجْراً عَظيماً

অর্থ: যারা আপনার কাছে আনুগত্যের শপথ করে, তারা তো আল্লাহর কাছে আনুগত্যের শপথ করে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর রয়েছে। অতএব, যে শপথ ভঙ্গ করে; অতি অবশ্যই সে তা নিজের ক্ষতির জন্যেই করে এবং যে আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করে; আল্লাহ সত্ত্বরই তাকে মহাপুরস্কার দান করবেন। (সূরা ফাতহ, আয়াত নং ১০)

উক্ত আয়াত দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, শুধুমাত্র রাসুল (সা.) এর কাছে বাইয়াত করা যথেষ্ট না বরং উক্ত বাইয়াতের উপরে অবশিষ্ট থাকাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেক মুনাফিক যারা রাসুল (সা.)এর কাছে বাইয়াত করেছিল তাদের সম্পর্কে কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে যে,

وَ إِذا قيلَ لَهُمْ آمِنُوا كَما آمَنَ النَّاسُ قالُوا أَ نُؤْمِنُ كَما آمَنَ السُّفَهاءُ أَلا إِنَّهُمْ هُمُ السُّفَهاءُ وَ لكِنْ لا يَعْلَمُون

অর্থ: আর যখন তাদেরকে বলা হয়, অন্যান্যরা যেভাবে ঈমান এনেছে তোমরাও সেভাবে ঈমান আন, তখন তারা বলে, আমরাও কি ঈমান আনব বোকাদেরই মত! মনে রেখো, প্রকৃতপক্ষে তারাই বোকা, কিন্তু তারা তা বোঝে না। (সূরা বাকারা, আয়াত নং ১৩)

وَ إِذا لَقُوا الَّذينَ آمَنُوا قالُوا آمَنَّا وَ إِذا خَلَوْا إِلى‏ شَياطينِهِمْ قالُوا إِنَّا مَعَكُمْ إِنَّما نَحْنُ مُسْتَهْزِؤُن

অর্থ: আর তারা যখন ঈমানদারদের সাথে মিশে, তখন বলে, আমরা ঈমান এনেছি। আবার যখন তাদের শয়তানদের সাথে একান্তে সাক্ষাৎ করে, তখন বলে, আমরা তোমাদের সাথে রয়েছি। আমরা তো (মুসলমানদের সাথে) উপহাস করি মাত্র। (সূরা বাকারা, আয়াত নং ১৪)

সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হচ্ছে অনেকে রাসুল (সা.) সম্পর্কে ধারণা করে যে তিনিও ভুল করে থাকেন এমনকি তারা এমনটি ধারণা করেন যে শয়তান চাইলে তার উপরে নাযিল কৃত আয়াত সমূহও পরিবর্তন করতে পারতো। কিন্তু তারা এক্ষেত্রে সাহাবিদেরকে মাসুমের পর্যায়ে নিয়ে যেতে দ্বিধাবোধ করে না।

অনেক ক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে যে, অনেক এমন সাহাবিগণ ছিলেন যারা রাসুল (সা.)’এর সুন্নাতকে বাদ দিয়ে হারাম কে হালাল এবং হালালকে হারাম করে দিয়েছেন।

আর এ কারণেই আমরা মুসলমানগণ দুই ধরণের সুন্নাতের মাঝে জীবন যাপন করছি। সুন্নাতে রাসুল (সা.) এবং সুন্নাতে খলিফা এবং উক্ত সন্নত সমূহের মধ্যে আকাশ পাতালের ন্যায় পার্থক্য রয়েছে। আর এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কি আমরা কার সুন্নতকে আকড়ে ধরবো রাসুল (সা.)’এর নাকি খলিফাদের সুন্নতকে?  

এক্ষেত্রে আমাদের সকলের উত্তর হবে এক, আর তা হচ্ছে রাসুল (সা.)’এর সুন্নতকে আকড়ে ধরবো।  কিন্তু তারপরেও আমরা দেখতে পাই যে সে যুগে এমন অনেকেই ছিলেন যারা রাসুল (সা.)’এর সুন্নতের অনুসরণ করেনি।

আমরা যদি ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করি তাহলে দেখতে পাব যে, জামাল এবং সিফফিনের যুদ্ধে এক লক্ষ লোকজন মারা যায়। উক্ত লোকজনের হত্যার অপরাধী হবে কে?

যারা উক্ত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা কি সে যুগের খলিফার বিরূদ্ধে বিদ্রোহ করেনি এবং যে সকল মুসলমানরা উক্ত যুদ্ধ সমূহে মারা গেছিল তাদের হত্যাকারি কারা?

পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে যে,

وَ مَنْ يَقْتُلْ مُؤْمِناً مُتَعَمِّداً فَجَزاؤُهُ جَهَنَّمُ خالِداً فيها وَ غَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَ لَعَنَهُ وَ أَعَدَّ لَهُ عَذاباً عَظيما

অর্থ: যে ব্যক্তি স্বেচ্ছাক্রমে মুসলমানকে হত্যা করে, তার শাস্তি জাহান্নাম, তাতেই সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তার জন্যে ভীষণ শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন। (সূরা নিসা, আয়াত নং ৯৩)

এক্ষেত্রে সাহাবিদের প্রতি আমাদের যে ধারণা তার কারণে মুনাফিকদের অনাকাংক্ষিত মর্যাদা বেড়ে যাচ্ছে আর যার ফলে দেখা যাচ্ছে যে আমার তাদের কাছ থেকে দ্বীনের শিক্ষা নিচ্ছি।

আর এর ফলে দেখা যায় যে, ইসলামের ইতিহাসে যে ভুল কাজ কেউ সম্পাদন করেছে আমরা সে কাজকে সাহাবিদের কাজ বলে চালিয়ে দিচ্ছি কেননা কারো কারো মতো তারা ছিলেন মুজতাহিদ এবং হয়তো তাদের দ্বারা ভুল হয়ে গেছে যেমন: খালিদ বিন ওয়ালিদ মালেক বিন নাওয়িরা’কে হত্যা করে এবং তার স্ত্রীর সাথে ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়। তখন হজরত উমর হজরত আবু বকরকে এর বিচার করতে বললে তিনি তার বিচার করেননি।

খোলাফয়ে রাশেদিনের চতূর্থ খলিফা হজরত আলি (আ.)’এর যুগে তিনটি বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং উক্ত যুদ্ধে প্রায় এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার মুসলমান মারা যায়। যারা উক্ত যুদ্ধে মুসলমানদেরকে যুগের খলিফার বিরূদ্ধে লেলিয়ে দেয় তারা কি সাহাবি, মুজতাহিদ এবং ন্যায়পরায়ণ ব্যাক্তি হতে পারে?

যারা রাসুল (সা.)’এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র ইমাম হাসান (আ.)’এর জানাযার উপরে তীর বর্ষণ করে তারা কি সাহাবি এবং মুজতাহিদ হতে পারে?

অনেকে আবার রাসুল (সা.)’এর সাথে নিজেদের আত্মীয়তার সম্পর্কের কথা বলে এবং অনেকে হালাল বিষয়কে হারাম এবং হারাম বিষয়কে হালাল করে নিজেদেরকে সাহাবি, মুজতাহিদ এবং ন্যায়পরায়ণ হিসেবে মুসলমানদের কাছে প্রমাণ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে।

এজিদ ইমাম হুসাইন (আ.)কে হত্যা করে, কাবাকে ভেঙ্গে দেয়, মদীনার নারীদেরকে তার সৈন্যদের জন্য তিন দিন হালাল করে দেয় যার কারণে হাজার হাজার যুবতিরা গর্ভবতি হয়ে পড়ে। আরএভাবেই তারা হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল করার চেষ্টা করেছে।

যখন জিজ্ঞাসা করা হয় যে যারা হজরত উসমানকে হত্যা করে তারা কি ন্যায়পারায়ণ ছিলেন, ভাল কাজ করেছিলেন, তাদের উক্ত কাজের জন্য আল্লাহর কাছে তারা কোন সওয়াবের অধিকারী হবে কি না?

উত্তরে তারা বলেন: যারা খলিফাকে হত্যার কাজে অংশগ্রহণ করেছিল তারা মুরতাদ হয়ে গেছিল। তাহলে যারা খোলাফায়ে রাশেদিনের চতূর্থ খলিফার বিরূদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল এবং জামাল এবং সিফফিন’এর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল তাহলে তারাও মুরতাদ হয়ে গেছিল। কিন্তু তখন তারা এর উত্তরে বলেন যে, না তারা মুরতাদ হয়ে যায়নি বরং তারা ইজতেহাদের মাধ্যেমে ভুল পথে পা বাড়িয়ে ছিলেন তারা এ কারণে মুরতাদ হবেন না বরং উপরন্তু তাদের উক্ত কাজের বিনিময়ে সওয়াব দান করা হবে।

বেশ কিছু সাহাবি ছিলেন যারা রাসুল (সা.)’এর সাথে যুদ্ধ করেছিলেন এমনকি তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন যাদের সম্পর্কে কোরআন শরিফে বর্নিত হয়েছে যে,

يَحْلِفُونَ بِاللَّهِ ما قالُوا وَ لَقَدْ قالُوا كَلِمَةَ الْكُفْرِ وَ كَفَرُوا بَعْدَ إِسْلامِهِمْ وَ هَمُّوا بِما لَمْ يَنالُوا

অর্থ: যারা কসম খায় যে, আমরা বলিনি, অথচ নিঃসন্দেহে তারা বলেছে কুফরি বাক্যে এবং মুসলমান হওয়ার পর অস্বীকৃতিজ্ঞাপনকারী হয়েছে। (সূরা তওবাহ, আয়াত নং ৭৪)

যারা মদ হারাম হওয়ার পরেও মদ পান করতো তাদের কি সাহাবি বা মুজতাহিদ বলা যাবে?

আব্দুল্লাহ বিন সালুল যাকে রাসুল (সা.) হত্যা করার নির্দেশ দান করেন কি সে সাহাবি ছিল না?

কি কারুন, সামেরি, ইয়াহুদায়ে আসখার ইউতা বিভিন্ন নবী (আ.)দের সাহাবি ছিলেন না? কিন্তু তাদের মুনাফিক সাহাবি হওয়ার ক্ষেত্রে কোন প্রকার সন্দেহ নেই। যারা আল্লাহর দ্বিন এবং নবীদেরকে কষ্ট দেয়ার জন্য চেষ্টা করেছিল।

আমরা এক্ষেত্রে কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাই যে, যারা রাসুল (সা.)’এর  আশেপাশে থাকতেন তাদের সম্পর্কে কোরআন কি বলেছে:

إِنَّ الَّذِينَ تَوَلَّوْاْ مِنكُمْ يَوْمَ الْتَقَى الجْمْعَانِ إِنَّمَا اسْتزَلَّهُمُ الشَّيْطَانُ بِبَعْضِ مَا كَسَبُواْ  وَ لَقَدْ عَفَا اللَّهُ عَنهْمْ  إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ حَلِيم

অর্থ: তোমাদের যে দুটি বড় দল লড়ায়ের জন্য ঘুরে দাড়িয়েছিল শয়তান তাদেরকে বিভ্রান্ত করেছিল তাদের পাপের দরুন। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং ১৫৫)

وَ مِمَّنْ حَوْلَكُمْ مِنَ الْأَعْرابِ مُنافِقُونَ وَ مِنْ أَهْلِ الْمَدينَةِ مَرَدُوا عَلَى النِّفاقِ لا تَعْلَمُهُمْ نَحْنُ نَعْلَمُهُمْ سَنُعَذِّبُهُمْ مَرَّتَيْنِ ثُمَّ يُرَدُّونَ إِلى‏ عَذابٍ عَظيم

অর্থ: আর কিছু কিছু তোমার আশেপাশের মুনাফিক এবং কিছু লোক মদীনাবাসী মুনাফেকিতে অনঢ়। তুমি তাদের জান না; আমি তাদের জানি। আমি তাদেরকে আযাব দান করবো দুবার। তারপরে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হবে মহান আযাবের দিকে। (সূরা তওবা, আয়াত নং ১০১)

يَسْتَأْذِنُ فَريقٌ مِنْهُمُ النَّبِيَّ يَقُولُونَ إِنَّ بُيُوتَنا عَوْرَةٌ وَ ما هِيَ بِعَوْرَةٍ إِنْ يُريدُونَ إِلاَّ فِرارا

অর্থ: তাদের একদল নবীর কাছে অনুমতি প্রার্থনা করে বলেছিল, আমাদের বাড়ি ঘর খালি অথচ সেগুলো খালি ছিল না পলায়ণ করাই ছিল তাদের ইচ্ছা। (সূরা আহযাব, আয়াত নং ১৩)

আর এভাবে বণি উমাইয়া ৭০ বছর ইজতেহাদ করতে থাকে এবং রাসুল (সা.)’এর মেম্বারের উপর থেকে মুসলমানদের খলিফা হজরত আলি (আ.)’এর উপরে অভিসম্পাত করতে থাকে।

সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে রাসুল (সা.)’এর সকল সাহাবি ন্যায়পরায়ণ ছিলেন না। আর এক্ষেত্রে আমরা যদি আয়াত এবং রেওয়য়েতের প্রতি দৃষ্টিপাত করি তাহলে সহজেই বুঝতে পারবো যে কোন সাহাবি ছিলেন মুমিন বা মুনাফিক। 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন