ইমাম মাহদী (আ.)এর নায়েব “হুসাইন বিন রূহ”
ইমাম মাহদী (আ.)এর নায়েব “হুসাইন বিন রূহ”
এস, এ, এ
হুসাইন বিন রূহ ছিলেন ইমাম মাহদী (আ.)’এর তৃতীয় নায়েব। যার মাধ্যেমে জনগণ ইমাম মাহদী (আ.)’এর কাছে চিঠি সহ বিভিন্ন বিভিন্ন বিষয়াবলির ক্ষেত্রে সম্পর্ক স্থাপন করতেন। হুসাইন বিন রূহ’এর জন্মের বছরটি ইতিহাসে সঠিকভাবে উল্লেখ করা হয়নি। তবে মনে করা হয় যে, তিনি ছিলেন সাভেবাসী। কেননা সাভেবাসীদের সাথে তার যথেষ্ট মিল ছিল। অনেকে আবার মনে করেন তিনি ছিলেন কুমবাসী। তবে অধিকাংশ এবং বিশ্বস্ত রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে তিনি ছিলেন নৌবাখত এলাকার বাসিন্দা। (ইবনে বাবে ওয়েই, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৫০৩- ৫০৪, আল গায়বা, পৃষ্ঠা ১৯৫, ইকবালে আশতিয়ানী, পৃষ্ঠা ২১৪, কাসি, পৃষ্ঠা ৫৫৭)
বংশগত দিক থেকে তিনি ছিলেন নৌবখত বংশের এবং ধারণা করা হয় যে, তিনি তাঁর মায়ের দিক থেকে নৌবখত বংশের লোক বলে নৌবাখতি’এর খ্যাতি অর্জন করেন। (ইকবালে আশতিয়ানী, পৃষ্ঠা ২১৪)
তাঁকে ১৮ই শাবান ৩২৬ হিজরীতে বাগদাদের নৌবাখত এলাকায় দাফন করা হয়। (আল গায়বা, পৃষ্ঠা ২৩৮)
যখন হুসাইন বিন রূহ ইমাম মাহদী (আ.) এর নায়েবের পদ অর্জন করেন তখন তিনি বাধ্যে হন নিজেকে লুকিয়ে রাখতে আর তাই হঠাৎ করেই ইতিহাসে তার সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে সময়টি ৩০৬ হিজরী, ৯১৮ সৌর বর্ষ এবং ৯২৩ খৃষ্টাব্দে হামেদ বিন আব্বাসের যুগে ছিল বলে ধারণা করা হয়। শেইখ তূসী এ সম্পর্কে বলেন যে, তার অবর্তমানে সালমাগানী ইমাম মাহদী (আ.)’এর নায়েবের দ্বায়িত্বটি পালন করেন। (আল গায়বা, পৃষ্ঠা ৩০৩, ৩২৪)
কিন্তু কিছুদিন পরে সালমাগানী’এর বিশ্বাস ও আচরণে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় এবং সে ধিরে ধিরে ‘হুলুল’ এবং ‘গুলু’এর মতো ভ্রান্ত চিন্তাধারার শিকার হয়। আর এ কারণে হুসাইন বিন রূহ তাকে উক্ত পদ থেকে বরখাস্ত করে এবং এভাবে তিনি সালমাগানী’এর ফেতনাকে নস্যাৎ করেন। আর উক্ত ফেতনাটি ছিল হুসাইন বিন রূহ’এর যুগে সবচেয়ে বড় ফেতনা যা আবু জাফর বিন আলী সালমাগানী’এর মাধ্যেমে সৃষ্টি হয়েছিল। (আল গায়বা, পৃষ্ঠা ২২৭, ২৩৯, ২৫১- ২৫২)
হজরত হুসাইন বিন রূহ যে ৫ বছর জনগণের মাঝে উপস্থিত ছিলেন না সে সময়ে তিনি সালমাগানীকে নিজের উক্ত দ্বায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আর সালমাগানীও উক্ত পদের অসৎ ব্যাবহার করে এবং প্রথমে নিজেকে “বাব” বা নায়েব পরে নবী এবং অবশেষে নিজেকে খোদা বলে দাবী করে। যখন হুসাইন বিন রূহ বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হন তখন তিনি শিয়াদেরকে তার অনুসরণ করতে নিষেধ করেন এবং ৩১২ হিজরীতে ইমাম মাহদী (আ.) তার প্রেরিত বার্তায় সালমাগানী’এর প্রতি অভিসম্পাত প্রেরণ করেন। (আল গায়বা, পৃষ্ঠা ১৮৭, ২৫২- ২৫৩, তাবারসী, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ২৯০)
আর ইমাম (আ.)’এর উক্ত বার্তাটি ৩১৭ হিজরীতে প্রকাশ পায়। অবশেষে সে যুগের তখাকথিত খলিফার নির্দেশে সালমাগানীকে ফাঁসি দেয়া হয়। (আল গায়বা, পৃষ্ঠা ২৫৪)
প্রকৃতপক্ষে নৌবাখতিরা ছিল ইরানী বংশভূত এবং আব্বাসীয় খলিফাদের সাথে তাদের যথেষ্ট সুসম্পর্ক ছিল। আর উক্ত বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই অর্থনৈতিক এবং শিক্ষাগত এবং সামাজিক ক্ষেত্রে তাদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। আর এভাবেই তারা সে যুগের শিয়াদের বিভিন্নভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করতো।
মোক্তাদের’এর শাষণকালে হুসাইন বিন রূহ ইমাম মাহদী (আ.)’এর নায়েবের পদ অর্জন করেননি। আর উক্ত সময়ে তিনি খেলাফতের লোকজনদের কাছে খুব ভাল বলে বিবেচিত ছিলেন। আর এভাবে তিনি চেয়েছিলেন খেলাফতের রোষনল থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে। কেননা সে যুগে ভ্রান্ত চিন্তাধারী “কেরামাতে”দের বিদ্রোহের কারণে পরিবেশটি বেশ স্পর্শকাতর হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আব্বাসীয় খলিফা মনসুরের যুগ থেকে নৌবাখত বংশের একটি সুসম্পর্ক বজায় ছিল আর উক্ত সম্পর্কটি মোক্তাদের’এর যুগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।(আল গায়বা, পৃষ্ঠা ৩৭২)
ঐতিহাসিকদের মতে আবুল হাসান আলী বিন মোহাম্মাদ ছিলেন ফুরাত বংশের। তিনি ছিলেন সে যুগের শিয়াদের মধ্যে খুবই সুপ্রিয় একজন ব্যাক্তিত্ব। যেহেতু নৌবাখত বংশের লোকদের সাথে খেলাফতের নেতাদের সাথে সুসম্পর্ক ছিল সেহেতু ধারণা করা হয় যে, আবুল হাসান আলী বিন মোহাম্মাদ’এর মন্ত্রি হওয়ার ক্ষেত্রে হুসাইন বিন রূহের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। কেননা হুসাইন বিন রূহ’এর সাথে আবুল হাসান আলী বিন মোহাম্মাদ’এর ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। অনুরূপভাবে ইমাম মাহদী (আ.)’এর দ্বিতীয় নায়েব মোহাম্মাদ বিন উসমান’এর কন্যা বলেন যে, আবুল হাসান আলী বিন মোহাম্মাদ মন্ত্রি পদে থাকাকলিন সময়ে আলে ফুরাতের লোকজন হুসাইন বিন রূহ’কে যথেষ্ট সম্পদ দান করতেন। (আল গায়বা, পৃষ্ঠা ৩৭২)
হুসাইন বিন রূহ’এর সামাজিক অবস্থান:
আবু জাফর’এর কন্য উম্মে কুলসুম বর্ণনা করেন যে, আমার বাবার যুগে জনগণ এবং শিয়াদের মাঝে হুসাইন বিন রূহ’এর খুব জনপ্রিয়তা ছিল। (আল গায়বা, পৃষ্ঠা ২২৭)
কিন্তু যখন হামেদ বিন আব্বাসী খেলাফতের উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়, তখন সে শিয়া বিরোধিদের বিভিন্ন বিষয়ে সহায়তা করার কারণে হুসাইন বিন রূহ’এর জন্য পরিবেশ পরিস্থিতি কঠিন হয়ে পড়ে। ৩১১ হিজরীতে হামেদ বিন আব্বাসী ক্ষমতায় আসার পরে হুসাইন বিন রূহ কে কারাগারে বন্দি করা হয় এবং ৩১৭ সালে তাঁকে মুক্ত করা হয়। (আল গায়বা, পৃষ্ঠা ১০৯)
কিন্তু তারপর থেকে ৩২৬ হিজরীরর শাবান মাস পর্যন্ত খেলাফতে নৌবাখত বংশের প্রভাবের কারণে আর কেউ তাকে কষ্ট দেয়ার সাহস করেনি। আর তিনি ছিলেন সে যুগের সাধারণ মানুষদের মধ্যে বুদ্ধিমান, জ্ঞানী এবং বিচক্ষণ একজন ব্যাক্তিত্ব। (আল গায়বা, পৃষ্ঠা ১১২)
মোক্তদের’এর ২৫ বছর খেলাফতকালে প্রায় ১২জন উজির নিযুক্ত হয়। তাদের মধ্যে এমনও ব্যাক্তি ছিলেন যারা দুই থেকে তিনবার পর্যন্তও উজির পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং তাদের মধ্যে আবুল হাসান বনি ফুরাত ছিলেন অন্যতম যিনি তিনবার উজির পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন।
হুসাইন বিন রূহ’এর আটক হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে ইমাম মাহদী (আ.)’এর উদ্দেশ্যে শিয়াদের দানকৃত সম্পদ তার কাছে রক্ষিত ছিল এবং তিনি উক্ত সম্পদ খেলাফতের উজিরের কাছে জমা দিতে অস্বীকৃতি জানান। আর এ কারণে তাকে ৫ বছর কারাবাস ভোগ করতে হয়।
হুসাইন বিন রূহ’এর কবর:
হুসাইন বিন রূহ নৌবাখতি ১৮ই শাবান ৩২৬ হিজরীতে ইহলোক ত্যাগ করেন। বর্তমানে তার কবর বাগদাদের নৌবাখত নামক এলাকার সুরজে নামক স্থানে রয়েছে।
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন