নারী নির্যাতনে তাকফিরি গোষ্ঠী আইএসআইএল-এর নৃশংসতা

নারী নির্যাতনে তাকফিরি গোষ্ঠী আইএসআইএল-এর নৃশংসতা

পাশ্চাত্য ও ইহুদিবাদী ইসরাইলের মদদপুষ্ট তাকফিরি-ওয়াহাবি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসআইএল ইসলামী খিলাফত ও শরিয়ত প্রতিষ্ঠার নামে নানা ধরনের বর্বর এবং নৃশংস তৎপরতা চালাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে। ইরাক ও সিরিয়া অঞ্চলে নারীদের ওপর পৈশাচিক এবং পাশবিক নির্যাতন হচ্ছে এসবের মধ্যে অন্যতম। ২০১৩ সাল থেকে সক্রিয় এই গোষ্ঠী নানা শহর দখলের পর সেখানে ঘর-বাড়ি ধ্বংস করে পুরুষদের হত্যা করে ও নারীদের ধর্ষণ করে বা যৌন-দাসী বানায়। তারা শিয়া মুসলমান ও সুন্নি এবং খ্রিস্টানসহ দলমত নির্বিশেষে তাদের চিন্তাদর্শের বিরোধী যে কোনো সম্প্রদায়ের সঙ্গেই এ ধরণের অমানুষিক আচরণ করছে।
 
 তাকফিরি-ওয়াহাবি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসআইএল গত বছরের তথা ২০১৪ সালের পয়লা আগস্ট সন্ধ্যায় সিনজার শহরে হামলা চালিয়ে তা দখল করে নেয় এবং উত্তর ইরাকে অবস্থিত এ শহরটির অধিবাসীদের ওপর পৈশাচিক নৃশংসতা চালায়। শহরটি স্থানীয় কুর্দি ইজাদি সম্প্রদায়ের কাছে খুবই পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। বহু বছর ধরে তারা সেখানে কোনো সংঘাত ও উপদ্রব ছাড়াই নিজস্ব ধর্ম ও প্রথাগুলো পালন করে আসছিল।  
 
সারা বিশ্বে ইজাদি সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। আর তাদের বেশিরভাগই বসবাস করে ইরাকে। তাদের দু'টি পবিত্র স্থানের নাম 'শেনগাল' ও "ল'লাশ"। তাকফিরি-ওয়াহাবি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসআইএল সিনজার শহর দখল করে নিলে স্থানীয় অধিবাসীরা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। হাজার হাজার অধিবাসী আশপাশের পাহাড়গুলোতে আশ্রয় নেয়। বাবা শেইখ হাদি নামের একজন প্রবীণ ইজাদি জানিয়েছেন, তাকফিরি-ওয়াহাবি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসআইএল পালিয়ে যেতে অক্ষম স্থানীয় পুরুষদের হত্যা ও নারীদের ধর্ষণ করে।

এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বিজিত অঞ্চলের নারীদেরকে গণিমত বা যুদ্ধ-লব্ধ সম্পদ বলে মনে করে এবং তাদেরকে মানুষ বলেই মনে করে না। ইজাদি সম্প্রদায়ের নারী ও কন্যাদের সঙ্গে আইএসআইএল-কর্মীদের গণ-ধর্ষণের ভিডিও ইন্টারনেটেও প্রচারের ব্যবস্থা করেছে এই তাকফিরি গোষ্ঠী। বিষয়টিকে প্রচার-যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে তারা যাতে সবাই এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে ভয় পায়।  

২০১৪ সালের ৭ ই আগস্ট ইরাকি রেড-ক্রিসেন্টের মুখপাত্র মুহাম্মাদ খাজায়ি সংবাদ মাধ্যমগুলোকে বলেছেন: আইএসআইএল বন্দী খ্রিস্টান ও ইজাদি নারীদেরকে মসুলের একটি বাজারে নিয়ে আসে বিক্রি করে দেয়ার জন্য।  

জাতিসংঘের নারী বিষয়ক সংস্থার প্রধানও জানিয়েছেন: যদিও উগ্রবাদের বিষাক্ত ছোঁয়া ইরাকি সমাজকে দিনকে দিন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে, কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতি ও হুমকির শিকার হচ্ছে নারীরা।  

নির্ভরযোগ্য নানা রিপোর্টে দেখা গেছে, ইরাকের নারী ও কন্যারা আইএসআইএল-এর সেনা রিক্রুটকারী ব্যক্তিদের মাধ্যমে অপহরণ, ধর্ষণ ও বলপূর্বক বিয়ের মত নানা ধরণের পাশবিকতা এবং নৃশংসতার শিকার হচ্ছে। এগুলো স্পষ্টভাবেই মানবাধিকারের লঙ্ঘন। ইরাকের মানবাধিকার মন্ত্রণালয়ও এইসব বাস্তবতার কথা স্বীকার করেছে। সংস্থাটির সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে এসেছে:

আইএসআইএল-এর অন্যতম কমান্ডার আবু উনস আললিবি নিকাহর জিহাদ বা যৌন-জিহাদে অংশ নিতে অস্বীকার করায় ইরাকের ফাল্লুজা শহরের ১৫০ নারী ও কন্যাকে হত্যা করেছে। এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের নারী সংস্থার প্রধান বলেছেন: এইসব ঘটনার খবর খুবই উদ্বেগজনক। আমরা জেনেছি যে কোনো কোনো নারী আইএসআইএল-এর সেনা রিক্রুটকারী ব্যক্তিদের হাতে ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর আত্মহত্যার পদক্ষেপ নেন।  

সম্প্রতি ফরাসি বার্তা সংস্থার রিপোর্টার ডাবলিও জি ডানলোপ 'ধর্ষণের শিকার হওয়ার লজ্জার চেয়ে আত্মহত্যা ভালো' শীর্ষক বাগদাদ থেকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে আইএসআইএল-এর হাতে ইজাদি নারী ও কন্যাদের দুর্দশা সম্পর্কে জানিয়েছেন: জিইলান ছিল ১৯ বছর বয়স্ক এক ইজাদি তরুণী। হাজার হাজার ইজাদি নারীর মত তাকেও যাতে ইজ্জত হারাতে না হয় সে জন্য সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
 

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল আইএসআইএল-এর ৪০ জন সাবেক পণবন্দির সাক্ষাৎকার থেকে জানিয়েছে: এই গোষ্ঠীর যৌন-দাসী হওয়ার শিকারদের উল্লেখযোগ্য এক অংশ ১৪ ও ১৫ বছরের কিংবা তার চেয়েও কম বয়সী বালিকা। এই মেয়েদের ওপর মানসিক ও দৈহিক নির্যাতনের প্রভাব খুবই দুঃখজনক বা ভয়াবহ। তাদের অনেকেই ভয়াবহ পাশবিকতার শিকার হয়েছে। এমনকি যারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে তারাও তীব্র মানসিক কষ্টের শিকার হয়। অন্য এক রিপোর্টে এসেছে যে, আইএসআইএল-এর সেনা রিক্রুটকারী ব্যক্তিরা কোনো কোনো পুরুষ বন্দির সামনেই তাদের স্ত্রী ও কন্যাকে ধর্ষণ করে কিংবা তাদেরকে ওইসব ধর্ষণের দৃশ্য দেখতে বাধ্য করে। আর এ কারণে তারা আত্মহত্যা করেছেন।
অন্যদিকে তাকফিরি-ওয়াহাবি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসআইএল নারীদেরকেও সন্ত্রাসী-সেনা হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা এক দল সরলমনা পশ্চিমা নারীকেও এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্য করতে সক্ষম হয়েছে এবং স্থল-যোদ্ধা হিসেবে তাদেরকে ব্যবহারও করছে।
 
তাকফিরি-ওয়াহাবি আইএসআইএল গোষ্ঠী পশ্চিমা মুসলিম নারীদের ধোঁকা দেয়ার জন্য এটা প্রচার করছে যে, তাদের গোষ্ঠীর সদস্য হলে বেহেশতে যাওয়াটা অবধারিত বা অনিবার্য । এইসব নারীকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য সিরিয়ার আলেপ্পো বা হালাবের কাছে একটি ঘাঁটিও গড়ে তুলেছে আইএসআইএল। প্রশিক্ষণ-শেষে নানা সন্ত্রাসী তৎপরতায় জড়িয়ে পড়ে এইসব নারী। এ ধরণের সরল-মনা নারীদের দিয়ে একটি আত্মঘাতী হামলার টিম গড়ারও চেষ্টা করছে আইএসআইএল। এই নারীদের যেসব কাজের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো, আইএসআইএল-বিরোধীদের চিহ্নিত করা এবং এরপর খাবার ও পানিতে বিষ মিশিয়ে তাদেরকে হত্যা করা। এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্য-পদ বর্জনকারী এক নারী জানিয়েছেন, প্রতিপক্ষকে বিষ খাইয়ে হত্যা করার কিছু কাজ তুরস্কসহ আশপাশে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আইএসআইএল-এ যোগ-দেয়া সরলমনা সশস্ত্র নারীদের দিয়ে নিরপরাধ লোকদের জিজ্ঞাসাবাদের কাজও করানো হয়। দখলকৃত অঞ্চলের নানা তথ্য সংগ্রহ করা ও সেখানকার জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই তা করা হয়। এ ছাড়াও এই নারীদের দিয়ে আইএসআইএল-এর কর্মীদের মধ্যে যৌন জিহাদ বা জিহাদুন নিকাহর নামে ব্যভিচারও ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।

ব্রিটিশ সাংবাদিক রবার্ট মেন্ডিক গত সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছেন: বহু ব্রিটিশ নারী ও কন্যা আইএসআইএল-এর সদস্য হিসেবে কাজ করছে। তারা এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সেই ব্যক্তির সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখে যে ব্যক্তিটি দু'জন মার্কিন সাংবাদিকের মাথা বিচ্ছিন্ন করেছে। এই গোষ্ঠীর মধ্যে ওই ঘাতকের ছদ্মনামটি হলো জন। আইএসআইএল-এ যোগ দেয়া এক নারীর নাম হলো আকসা মাহমুদ। ২০ বছরের এই তরুণী ব্রিটেনের গ্লাসগো থেকে পালিয়ে সিরিয়ায় যায় ও সেখানে আইএসআইএল-এর এক সদস্যকে বিয়ে করে। মায়ের সঙ্গে সর্বশেষ যোগাযোগে সে জানায়: তোমার সঙ্গে পরকালে দেখা হবে এবং সেখানে তোমাকে সাহায্য করবো যাতে একইসঙ্গে বেহেশতে যেতে পারি; কারণ, আমি শহীদ হব।

আকসা ছাড়াও ৬০ জন ব্রিটিশ নারী ও কন্যা বিশ্ববিদ্যালয় ও হাইস্কুলের পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে আইএসআইএল-এ যোগ দিয়েছে। এদের বয়স ১৮ থেকে ২০। ব্রিটেন ও জার্মানিসহ ইউরোপের আরো অনেক দেশের সরলমনা মুসলিম মেয়ে ও নারীরা তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় গিয়ে আইএসআইএল-এর সদস্য হয়েছে। অনেক মার্কিন নারী ও কন্যাও পালিয়ে সিরিয়া ও ইরাকে গিয়ে এই ওয়াহাবি-তাকফিরি গোষ্ঠীর সদস্য হয়েছে বলে মার্কিন কর্মকর্তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

সোমালিয়ার কয়েকটি মেয়ে আমেরিকা থেকে তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় এসে এই গোষ্ঠীর সদস্য হয়। শ'নোন কনেলী নামের ১৯ বছর বয়স্ক এক মার্কিন তরুণী সালাফি-প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে আমেরিকা থেকে পালানোর সময় বিমানবন্দরে ধরা পড়ে। পাশ্চাত্যের এইসব নারীর অনেকেই আইএসআইএল-এর কর্মীদের মাধ্যমে গর্ভবতী হয়ে দেশে ফিরবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ, এরিমধ্যে এ ধরনের কিছু ঘটনা ঘটেছে। ফলে ইউরোপের অনেক মা টেলিভিশনে হাজির হয়ে সিরিয়া ও ইরাকে পালিয়ে যাওয়া তাদের সন্তানদেরকে দেশে ফিরে আসার অনুরোধ করছেন।

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন