হজরত আলী আকবর (আ.)’এর মা “লাইলা” কি কারবালাতে উপস্থিত ছিলেন?
হজরত আলী আকবর (আ.)’এর মা “লাইলা” কি কারবালাতে উপস্থিত ছিলেন?
এস, এ, এ
হজরত আলী আকবর (আ.)’এর মায়ের নাম হচ্ছে লাইলা বিনতে আবি মাররা বিন উরওয়া বিন মাসউদ সাকাফি। এছাড়াও ইতিহাসে তার বিভিন্ন নাম উল্লেখ করা হয়েছে যেমনঃ লাইলা, মাররা, আমেনা ইত্যাদি।
লাইলার পিতার নাম মাররা, মাতার নাম মাইমুনা, স্বামীর নাম ইমাম হুসাইন (আ.) এবং তার সবচেয়ে বড় সন্তানের নাম হচ্ছে আলী আকবর (আ.)।
হজরত আলী আকবর (আ.)’এর ,মা “লাইলা” কারবালাতে উপস্থিত ছিলেন কি না এ সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত বর্ণনা করা হয়েছে।
কোন কোন ঐতিহাসিকগণ বলেছেনঃ কারবালাতে ইমাম হুসাইন (আ.) লাইলাকে বলেন আমি রাসুল (সা.) থেকে শুনেছি যে, ছেলের জন্য মায়ের দোয়াকে আল্লাহ কবুল করেন। যাও অমুক তাবুতে এবং নিজের সন্তানের জন্য দোয়া কর যেন তোমার সন্তান রক্ষা পায়। (হামাসে হুসাইনী, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ২৬)
আরো বলা হয়েছে যে, উক্ত কথাটি শুনার পরে লাইলা তাবুতে যায় দোয়া এবং মানত করে যে, যদি কারবালার ঘটনায় হজরত আলী আকবর (আ.) রক্ষা পায় তাহলে আমি কারবালা থেকে মদীনা পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় ৩০০ ফারসাখ (৬ কিঃমিঃ) বেসিল জাতীয় উদ্ভিদ রোপন করবে। (হামাসে হুসাইনী, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ২৬)
রিয়াযুল কুদ্দুস হচ্ছে এমন একটি পুস্তক যা ভারত, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান’এর ওয়াজকারীরা বেশী ব্যাবহার করে থাকে। উক্ত পুস্তকে লাইলা সম্পর্কে তেমন কিছুই উল্লেখ করা হয়নি বেশীরভাগ হজরত জয়নাব (সা.আ.) এবং আলী আকবর সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। উক্ত গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, হজরত লাইলা দেখলেন যে, বণী হাশিমের নারীরা হজরত আলী আকবর (আ.)’কে ঘিরে রেখেছে এবং আলী আকবর(আ.) যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ঘোড়ায় আরোহন করেছে তখন একবার তিনি ক্রন্দনের সূরে বলে হে আলী তুমি কি চলে যাচ্ছ? আল্লাহ তোমাকে রক্ষা করুক, আমি আমার দুধের ঋণকে তোমার জন্য মাফ করে দিলাম, তুমি হজরত ফাতেমা (সা.আ.)’এর কাছে আমার মান রেখেছ, যাও তোমার বাবার জীবন রক্ষার্থে জিহাদ কর।
এই বলে তিনি তাবুর পর্দাকে ফেলে দেন এবং তাবুতে বিছানো গালিচাকে তুলে ফেলেন এবং মাটির উপরে বসে পড়েন এবং মুষ্টি মুষ্টি মাটি তুলে নিজের মাথার উপরে নিক্ষেপ করেন এবং ক্রন্দন করতে থাকেন। তিনি খোদার কাছে দোয়া চান এবং বলে হে খোদা আপনি ইউসুফকে ৪০ বছর পরে ইয়াকুব (আ.) এর কাছে ফিরিয়ে দেন, হজরত ইসমাইলকে হজরত ইব্রাহিমকে ফিরিয়ে দিয়েছেন অনুরুপভাবে আমার আলী আকবর কে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন।( রিয়াযুল কুদস, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৮)
সমসাময়িক একজন লেখক লিখেছেন যে, ইমাম হুসাইন (আ.)’এর চেহারার রং পরিবর্তন হলে লাইলা তাকে বলেনঃ কি আলী আকবর কোন আঘাত পেয়েছে? না তবে তার সাথে লড়াই করার জন্য যে এসেছে আমি তার সম্পর্কে চিন্তা করছি। তুমি আলী আকবর’এর জন্য দোয়া কর। কেননা আমি রাসুল (সা.) থেকে শুনেছি যে, সন্তানের জন্য মায়ের দোয়াকে আল্লাহ কুবল করেন। তখণ তিনি আবার তাবুর মধ্যে প্রবেশ করেন এবং আলী আকবরের জন্য দোয়া করতে থাকেন। বাকর বিন গানেম তার কোন ক্ষতি করতে না পারে। এমতাবস্থায় আলী আকবর দেখতে পান যে, শত্রুর জেরা এক স্থানে ছিড়া রয়েছে তিনি সেখানে হামলা করেন এবং তার তরবারিকে ভেঙ্গে দুই টুকরো করে দেন এবং তাকে হত্যা করেন। (কিয়ামে সালারে শাহিদান, পৃষ্ঠা ১৯১ )
লেখক লিখেন যে লাইলাকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, কেন তুমি আলী আকবর শহীদ হওয়ার পরে তাবুর বাইরে দেরী করে আসলে?
তখন জবাবে তিনি বলেন আমি চাচ্ছিলাম যে তাবুর বাইরে আসতে কিন্তু যখন আলী আকবর’এর রক্ত মাটি মাখা শরীরকে দেখলাম তখন মনে হচ্ছিল যে আমার আত্মা শরীর থেকে বাহির হয়ে গেছে, যখন আমি উঠতে চাচ্ছিলাম তখন মনে হচ্ছিল যেন আমর কোমর ভেঙ্গে গেছে।(কিয়ামে সালারে শাহিদান, পৃষ্ঠা ১৯১ )
তবে গবেষকগণ মনে করেন যে কারবালাতে লাইলা’র উপস্থিতিকে বিশ্বস্ত বলে মনে করেন না এমনকি কারবালাতে লাইলার উপস্থিতিকেও অস্বীকার করেন এমনকি তার জীবিত থাকার বিষয়টিকেও সত্য বলে মনে করেন না। (যিন্দেগানি ইমাম হুসাইন (আ.) পৃষ্ঠা ৪৬১)
রিয়াহিনুশ শিয়া নামক গ্রন্থে লাইলা’র কারবালাতে উপস্থিত থাকার বিষয়টিকে অস্বীকার করা হয়েছে। গ্রন্থটির লেখক মনে করেন যে, যদি হজরত আলী আকবর’এর মা কারবালাতে উপস্থিত থাকতেন তাহলে অবশ্যই কোন না কোন শাহাদতের গ্রন্থে বিষয়টিকে উল্লেখ করা হতো।
এমনকি সে সময়ে তার মদীনাতে জিবীত থাকার বিষয়টিকেও কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। শুধুমাত্র মরহুম মির্যা হাদী আবুল ফারাজে ইসফাহানী থেকে বর্ণনা করেন যে, একদা এক আরব মদীনাতে আসে এবং যখন সে বণী হাশিমের গলি থেকে অতিক্রম করছিল তখন সে একজন নারীর ক্রন্দনের শব্দ শুনতে পায় সে উক্ত বাড়ির এক দাসীর কাছে জিজ্ঞাসা করে যে কে এত করুণভাবে ক্রন্দন করছে তখন সে বলে আলী আকবর’এর মা লাইলা যিনি কারবালার ঘটনার পর থেকেই ক্রন্দন করছেন। (রিয়াহিনুশ শারিয়াহ, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ২৩৭)
প্রসিদ্ধ এবং মোহাদ্দেস শেইখ আব্বাস কুম্মী (রহ.) তার নাফসুল মাহমুম নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, লাইলা’র কারবালায় থাকা এবং না থাকার বিষয়টি কোথাও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। (আকসিরুল ইবাদাত ফি আসরারিশ শাহাদত, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৬৪১)
যদিও তিনি কারবালার ঘটনার পূর্বেই মারা যান কিন্তু উক্ত বিষয়টি ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেননি। (আলী আকবর, আব্দুর রাজ্জাক মোকাররম, পৃষ্ঠা ১১)
সুতরাং উপরে উল্লেখিত প্রমানাদি থেকে স্পষ্ট হয় যে, হজরত আলী আকবর (আ.)’এর মা “লাইলা” কারবালাতে উপস্থিত ছিলেন না। যদিও কিছু সংখ্যক লেখক তাদের পুস্তকে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সত্য হচ্ছে যে লাইলা কারবালাতে উপস্থিত থাকার বিষয়টি কোথাও স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়নি। কেননা বিষয়টি হচ্ছে বানোয়াট একটি ঘটনা।
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন