ফকীহ্ শাসক কি নির্বাচিত নাকি মনোনীত?

ফকীহ্ শাসক কি নির্বাচিত নাকি মনোনীত?

ফকীহ্ শাসক কি নির্বাচিত নাকি মনোনীত?

জবাবঃ ফকীহ শাসকের হুকুমাত ও শাসন-কর্তৃত্বের মূলনীতিটির শরয়ী ভিত্তি আল্লাহ্ তা‘ আলার পক্ষ থেকে নির্ধারিত। যেহেতু ফকীহ্ শাসক হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর পক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করেন,সেহেতু তার নিয়োগও কোনো না কোনোভাবে হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর পক্ষ থেকে বা তার অনুমতিক্রমে হওয়া প্রয়োজন। তবে ফকীহর হুকুমাত ও শাসন-কর্তৃত্ব বাস্তব রূপ লাভের বিষয়টি জনগণ কর্তৃক গৃহীত হওয়ার শর্তাধীন।(জনগণ কর্তৃক গৃহীত হওয়ার শর্ত সম্পর্কে উল্লেখ করতে হয় যে,নবী-রাসূলগণ (আ.) এবং সেই সাথে শিয়া মাযহাবের আক্বিদাহ্ অনুযায়ী বারো জন নিষ্পাপ ইমাম (আ.) আল্লাহ্ তা‘ আলার পক্ষ থেকে মানুষের পথপ্রদর্শন ও নেতৃত্বের জন্য মনোনীত। আর যে ব্যক্তি কাউকে আল্লাহ্ তা‘ আলার পক্ষ থেকে মনোনীত পথপ্রদর্শক ও নেতা হিসেবে জানে তার পক্ষে ঐ ব্যক্তিকে শাসক হিসেবে গণ্য না করে অন্য কাউকে শাসক হিসেবে গণ্য করা সম্ভব নয়। অতএব,সে সর্বাবস্থায়ই খোদায়ী নেতৃত্বের নিকট আত্মসমর্পিত থাকবে। তবে বাস্তবে গোটা সমাজের ওপর খোদায়ী নেতৃত্বের শাসন-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বিষয়টি খোদায়ী বিধানে ব্যাপক জনগোষ্ঠী কর্তৃক স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাকে নেতা ও শাসক রূপে গ্রহণের শর্তাধীন রাখা হয়েছে। কারণ,পরম জ্ঞানী আল্লাহ্ তা‘ আলা জোর-জবরদস্তি ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে খোদায়ী শাসন প্রতিষ্ঠাকে উচিৎ গণ্য করেন নি। এ কারণে দেখা যায় যে,অধিকাংশ নবী-রাসূলই (আ.) রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনার সুযোগ পান নি। তবে রাষ্ট্র ও প্রশাসন খোদায়ী নেতৃত্বের হাতে থাকা ও না থাকা -এ দুই অবস্থায় তার সাথে মু’ মিনের সম্পর্কে বিন্দুমাত্র পার্থক্য হতে পারে না। উভয় অবস্থায়ই খোদায়ী নেতৃত্বই মু’ মিনের শাসক; রাষ্ট্র ও প্রশাসনে তার নিয়ন্ত্রণ না থাকা অবস্থায় সে রাষ্ট্র ও প্রশাসনের সাথে মু’ মিনের সম্পর্ক ও আচরণ খোদায়ী নেতৃত্বের নির্দেশ ও অনুমতি দ্বারা নির্ধারিত হবে। এ ব্যাপারে নবী-রাসূল (আ.),মা‘ ছূম ইমাম (আ.) ও নায়েবে নবী বা মুজতাহিদের সাথে মু’ মিনের সম্পর্কে কোনোই পার্থক্য হতে পারে না। কোনো ব্যক্তির মধ্যে যখন কারো প্রকৃত নায়েবে নবী হওয়ার ব্যাপারে প্রত্যয় সৃষ্টি হয় তখন তার আদেশ ও অনুমতিকে নবী-রাসূল (আ.)-এর আদেশ ও অনুমতির তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ গণ্য করার কোনোই অবকাশ থাকে না)

ইসলামী দৃষ্টিকোণের ভিত্তিতে আমরা বিশ্বাস করি,সমগ্র সৃষ্টিলোক তথা মানুষ সহ এ সমগ্র বিশজগতের অস্তিত্বলাভের পিছনে নিহিত মূল কারণ হচ্ছেন পরম করুণাময় আল্লাহ্ তা‘ আলা এবং তিনিই এ বিশ্বলোক ও এর অভ্যন্তরে নিহিত সব কিছুর প্রকৃত মালিক। তাই সকল মানুষই আল্লাহ্ তা‘ আলার বান্দাহ্ ও দাস। প্রকৃত সত্য হলো এই যে,আমাদের সত্তার কোনো অংশই আমাদের নিজেদের নয়; আমাদের পুরো অস্তিত্বই তার মালিকানাধীন। এটা অনস্বীকার্য যে,কোনো সম্পদে তার মালিকের অনুমতি ছাড়া হস্তক্ষেপ করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ এবং তা যুলুম বৈ নয়। এর ভিত্তিতে আমাদের অবশ্যই স্বীকার করা উচিৎ যে,কোনো মানুষেরই তার মালিক আল্লাহ্ তা‘ আলার অনুমতি ব্যতিরেকে তার নিজের বা অন্যদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই।

বলা বাহুল্য যে,কতগুলো কাজ রাষ্ট্রশক্তির সাথে অনিবার্য ও অপরিহার্যভাবে জড়িত। যেমনঃ বৈধ প্রয়োজনে কাউকে গ্রেফতার করা,কারাগারে নিক্ষেপ করা,জরিমানা করা,কর আদায় করা,হত্যা করা,মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা,বিভিন্ন ধরনের হস্তক্ষেপ করণ এবং ব্যক্তি ও সমষ্টির আচরণে,কাজকর্মে ও জীবনযাত্রায় বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতা আরোপ করণ। অতএব,ব্যক্তি ও সমষ্টির জীবনে এভাবে হস্তক্ষেপ করার জন্য শাসককে অবশ্যই মানুষের প্রকৃত মালিক আল্লাহ্ তা‘ আলার কাছ থেকে অনুমতির অধিকারী হতে হবে। অন্যথায় তার সমস্ত হস্তক্ষেপই হবে অবৈধ,জুলুম ও জবরদস্তি মূলক। এটাই বিচারবুদ্ধির রায়। বেলায়াতে ফকীহ্ বা ফকীহর শাসন-কর্তৃত্ব মূলনীতি অনুযায়ী আল্লাহ্ তা‘ আলা ও হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের জন্য মনোনীত পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী ফকীহকে এ অধিকার প্রদান করা হয়েছে। তার আইনানুগ বৈধতার ভিত্তিও হচ্ছে এই মনোনয়ন - যা আল্লাহ্ তা‘ আলা ও হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর পক্ষ থেকে সম্পাদিত হয়েছে।

ওমর বিন হানযালাহ্ বর্ণিত মাক্ববুলাহ হাদিসটি(যে হাদিসের বর্ণনাধারার শেষ বর্ণনাকারী অর্থাৎ যে ব্যক্তি নবী বা ইমাম হতে বর্ণনা করেছেন তার বিশ্বস্ততার স্বীকৃতি স্বরূপ নবী বা ইমাম হতে কিছু বর্ণিত হয়নি অবশ্য তারা তাকে কখনও মিথ্যাবাদীও বলেননি; এ হাদিসের বর্ণনাকারী ওমর বিন হানযালাহর ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে অর্থাৎ তার বিশ্বস্ততার বিষয়টি অজ্ঞাত) এক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ। ফকীহগণের অনেকেই বেলায়াতে ফকীহ্ তত্ত্ব প্রমাণের জন্য এর সপক্ষে দলীল হিসেবে উক্ত রেওয়ায়েতটির উল্লেখ করেছেন। হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)ও তার‘বেলায়াতে ফকীহ্’ গ্রন্থে এর উল্লেখ করেছেন। উক্ত রেওয়ায়েত অনুযায়ী,হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেনঃ  “ তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তিই আমাদের হাদীছ বর্ণনা করবে (অর্থাৎ হাদীস বিশেষজ্ঞ হিসেবে হাদীসটি আদৌ নবী বা ইমামদের থেকে বর্ণিত কিনা যাচাই করতে পারবে) ,হালাল ও হারামের প্রতি দৃষ্টি রাখবে (এ ক্ষেত্রে মতামত দেয়ার যোগ্যতার অধিকারী হবে) এবং আমাদের আহ্কামের সাথে পুরোপুরি পরিচিত থাকবে,তোমরা তাকে ফয়সালাকারী হিসেবে গ্রহণ করো। অবশ্যই জেনো যে,আমি তাকে তোমাদের ওপর শাসক ও বিচারক নিয়োগ করলাম (فانی قد جعلته عليکم حاکماً )। অতএব,সে যখন কোনো আদেশ দেয় তখন যারা তা গ্রহণ না করে তারা আল্লাহর আদেশকে উপেক্ষা করলো এবং আমাদেরকে প্রত্যাখ্যান করলো। আর যে ব্যক্তি আমাদেরকে প্রত্যাখ্যান করে সে আল্লাহকেই প্রত্যাখ্যান করলো,আর আল্লাহকে প্রত্যাখ্যান করা আল্লাহ্ তা‘ আলার সাথে শিরক করার সমতুল্য।”

এখানে হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.) ফকীহগণ ও ওলামায়ে দ্বীনের কথা বলেছেন যে,তিনি তাদেরকে নিজের পক্ষ থেকে জনগণের ওপর শাসক ও বিচারক নিয়োগ করেছেন এবং তিনি ফকীহগণের রায়কে তার নিজেরই রায় বলে গণ্য করেছেন। আর বলা বাহুল্য যে,মা‘ ছূম ইমাম (আ.)-এর আদেশের আনুগত্য অপরিহার্য কর্তব্য। অতএব,ফকীহর আদেশের আনুগত্য করাও অপরিহার্য কর্তব্য এবং ফকীহর শাসন-কর্তৃত্ব অমান্য করা বড় ধরনের গুনাহ্ ও আল্লাহ্ তা‘ আলার সাথে শিরক করার সম পর্যায়ভুক্ত।

হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) তার‘ বেলায়াতে ফকীহ্’ গ্রন্থের ১০৪ নং পৃষ্ঠায় বলেনঃ“ তিনি [ইমাম জাফর সাদিক (আ.)] এরশাদ করেছেনঃفانی قد جعلته عليکم حاکماً -অর্থাৎ এ ধরনের শর্তাবলী বিশিষ্ট কাউকে যখন আমি তোমাদের ওপর শাসক নিয়োগ করবো এবং যে ব্যক্তি এ ধরনের শর্তাবলীর অধিকারী সে আমার পক্ষ থেকে মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় ও বিচার বিষয়ক কার্যাবলী সম্পাদনের জন্য আমার পক্ষ থেকে মনোনীত; মুসলমানদের অধিকার নেই তার নিকট ব্যতীত অন্য কারো নিকট (বিচার-ফয়সালার জন্য) গমন করার।”

হযরত ইমাম (রহ্ঃ) তার একই গ্রন্থের ১২২ নং পৃষ্ঠায় বলেনঃ“ ফকীহগণ হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর পক্ষ থেকে খেলাফত ও হুকুমাতের জন্য মনোনীত।”

এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে,বেলায়াতে ফকীহ্ বা ফকীহর শাসনের বাস্তব রূপায়নের ক্ষেত্রে জনগণের অবস্থান ও ভূমিকা সম্পর্কে হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)-এর অভিমত ফকীহর পরিপূর্ণ স্বাধীনতার মতের সাথে সামঞ্জস্যশীল। আর তিনি তার বিভিন্ন লেখা ও ভাষণে এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির কথা পুরোপুরিভাবে উল্লেখ করেছেন। মূলতঃ হযরত ইমাম (রহ্ঃ) যে ফকীহর নিরঙ্কুশ শাসন-কর্তৃত্বের তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন তাতে পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী ফকীহর হুকুমাতী এখতিয়ার সমূহকে(শাসন ও কর্তৃত্বের পরিধি) হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) ও মা‘ ছূম ইমামগণের (আ.) হুকুমাতী এখতিয়ারের সমপর্যায়ভুক্ত গণ্য করা হয়েছে। আর এ এখতিয়ারের উৎস হচ্ছে অভিন্ন খোদায়ী উৎস। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে,শাসনকার্যের দায়িত্ব একটি খোদায়ী দায়িত্ব,এ কারণে,খোদায়ী শাসকের এখতিয়ার সমূহ নির্ধারণ এবং তার নিয়োগ ও বরখাস্তের বিষয়টিও পরম প্রমুক্ত আল্লাহ্ তা‘ আলার পক্ষ থেকেই হয়েছে।(ফকিহ শাসক আল্লাহ্ তা‘ আলার পক্ষ থেকে মনোনীত হওয়ার কথাটি অত্র গ্রন্থে এর পর আরো বহু বার উল্লিখিত হয়েছে। কারো কাছে হয়তো এটিকে ভাবাবেগমূলক ও ভাবাবেগ সৃষ্টির উদ্দেশ্য প্রণোদিত কথা বলে মনে হতে পারে। কারণ,নবী-রাসূলগণ (আ.) আল্লাহ্ তা‘ আলার পক্ষ থেকে মনোনীত এবং তা তাদেরকে অবগত করা হয়,অতঃপর তারা নিজেদেরকে নবী বলে দাবী করে সমাজে দ্বীনের দাওয়াত প্রদান করেন। অনুরূপভাবে,শিয়া মাযহাবের আক্বিদাহ্ অনুযায়ী,মা‘ ছূম ইমামগণও (আ.) ইমাম হিসেবে আল্লাহ্ তা‘ আলার পক্ষ থেকে মনোনীত ও হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর মাধ্যমে ঘোষিত এবং তারা নিজেরাও তা জানতেন ও নিজেদেরকে ইমাম বলে দাবী করতেন। কিন্তু কোনো ফকিহ শাসকের নাম সুনির্দিষ্টভাবে আল্লাহ্ তা‘ আলার পক্ষ থেকে মনোনীত শাসক হিসেবে দ্বীনের কোনো সূত্রে (কোরআন-হাদীছে) উল্লিখিত নেই এবং তিনি নিজেও তা জানেন না বলে নিজেকে খোদায়ী শাসক হিসেবে দাবী করেন না,বরং বিশেষজ্ঞগণ তাকে চিহ্নিত ও পরিচয় করিয়ে দেন। তাই প্রশ্ন উঠতে পারে,এমতাবস্থায় তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে শাসক হিসেবে মনোনীত - এরূপ অকাট্য ধারণা পোষণের ভিত্তি কী?

এর ভিত্তি দু’ টি বিষয়। প্রথমতঃ আল্লাহ্ তা‘ আলা কোনো যুগে তার বান্দাহ্দেরকে প্রত্যক্ষভাবে নেতৃত্ব দানকারী তার মনোনীত নেতা ও শাসক থেকে বঞ্চিত রাখবেন - বিচারবুদ্ধি এটা মানতে পারে না। শিয়া মাযহাবের আক্বিদাহ্ অনুযায়ীও,হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.) সমাজে বিচরণ করলেও তিনি যেহেতু প্রত্যক্ষভাবে ও স্বীয় পরিচয় সহকারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন না সেহেতু প্রত্যক্ষ খোদায়ী নেতৃত্বের উক্ত প্রয়োজন থেকেই যাচ্ছে। উল্লেখ্য,আহলে সুন্নাতের মধ্যেও প্রত্যেক যুগ বা শতাব্দীতে মুজাদ্দিদের অস্তিত্ব থাকার বিশ্বাস বিদ্যমান রয়েছে। যদিও সে বিশ্বাস পুরোপুরি আক্বায়েদী ভিত্তি লাভ করে নি,তবে এ ধরনের বিশ্বাসের উদ্ভব খোদায়ী পথপ্রদর্শক ও নেতৃত্বের অপরিহার্য প্রয়োজনীয়তাকেই নির্দেশ করে। দ্বিতীয়তঃ ফকিহ নেতা কর্তৃক নিজেকে নেতা ও শাসক হিসেবে দাবী না করা এবং অন্য মুজতাহিদগণ কর্তৃক তাকে নিজেদের মধ্যে এ দায়িত্বের জন্যে যোগ্যতম রূপে চিহ্নিত করা থেকেই প্রমাণিত হয় যে,তিনিই আল্লাহ্ তা‘ আলা কর্তৃক মনোনীত শাসক। কারণ,তার পক্ষ থেকে প্রার্থিতা ও দাবী না থাকা এবং বিশেষজ্ঞগণ তথা মুজতাহিদগণ কর্তৃক ইখলাছের সাথে খোদায়ী নেতৃত্বকে চিহ্নিত করার চেষ্টা চালাতে গিয়ে তাকে চিহ্নিত করা থেকেই প্রমাণিত হয় যে,তিনিই এ দায়িত্বের জন্য উপযুক্ততম ব্যক্তি। আর উপযুক্ততম ব্যক্তি আল্লাহ্ তা‘ আলার মনোনীত শাসক নন,অন্য কেউ হবেন এবং বিশেষজ্ঞগণ ইখলাছের সাথে অনুসন্ধান করেও তাকে চিহ্নিত করতে পারবেন না এটা অসম্ভব ব্যাপার। শুধু তা-ই নয়,মানুষ যখন নিঃস্বার্থভাবে ও ইখলাছের সাথে চেষ্টা করেও পথ খুঁজে না পায় তখন সে আল্লাহর কাছে সাহায্য ও পথনির্দেশ কামনা করে এবং এমতাবস্থায় আল্লাহ্ তা‘ আলা তার অন্তরে সঠিক পথের সন্ধান জাগ্রত করে দেন। অতএব,যে কোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা হোক না কেন,এভাবে খুঁজে বের করা শাসক যে আল্লাহ্ তা‘ আলার পছন্দনীয় শাসক তাতে সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না)

এ দৃষ্টিকোণ থেকে ফকীহ শাসকের নিয়োগ এবং তার শাসনকার্যের বৈধতাদানের ক্ষেত্রে জনগণের কোনোই ভূমিকা নেই (জনগণের দ্বারা বিশেষজ্ঞগণ নির্বাচিত হন এবং তারা মুজতাহিদ শাসককে চিহ্নিত ও জনসমক্ষে পরিচিত করিয়ে দেন - এ কারণে অনেকে এ কাজটিকে পরোক্ষ নির্বাচন বলে মনে করতে পারেন। কিন্তু নির্বাচনের সাথে এ কাজের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। কারণ,নির্বাচিত বিশেষজ্ঞগণ ইলেক্টোরাল কলেজের ন্যায় কোনো সুনির্দিষ্ট প্রার্থীর পক্ষে জনগণের রায় নিয়ে আসেন না । বরং এ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ বিশেষজ্ঞদের ওপর তাদের আস্থার কথা ঘোষণা করে,কিন্তু তাদের পক্ষে আদৌ ধারণা করা সম্ভব নয় যে,বিশেষজ্ঞগণ কাকে শাসক হিসেবে চিহ্নিত করবেন। কারণ,খোদায়ী শাসকের সকল বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এবং এ বৈশিষ্ট্যের বিচারে সর্বোত্তম ব্যক্তি কে সে সম্পর্কে সাধারণ জনগণের অকাট্য ধারণা থাকে না; থাকলে তারাই খোদায়ী শাসককে চিহ্নিত করতে পারতো,বিশেষজ্ঞদের ওপর এ কাজের দায়িত্ব দিতে হতো না। এ কারণেই এমনও হতে পারে যে,খোদায়ী শাসকের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী দু’ জন মুজতাহিদের মধ্যে যিনি বেশী জনপ্রিয় তথা জনগণের ভোটে নির্বাচিত করলে যিনি নির্বাচিত হতেন বিশেষজ্ঞগণ তাকে নির্বাচিত না করে বিশেষজ্ঞত্বের দৃষ্টিতে অপর জনকে যোগ্যতম লক্ষ্য করে তঁকেই শাসক হিসেবে চিহ্নিত ও জনগণের সামনে পরিচিত করিয়ে দেবেন) ,বরং এ ক্ষেত্রে জনগণের ভূমিকা হচ্ছে হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মগোপনরত অবস্থায় ফকীহর হুকুমাত ও শাসন-কর্তৃত্বের বাস্তব রূপায়ন ও তার প্রতিষ্ঠা। জনগণের তথা মুসলিম জনগণের দায়িত্ব হচ্ছে হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মগোপনের যুগে ফকিহগণের হুকুমাত ও শাসন-কর্তৃত্ব বাস্তবায়নের জন্যে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। বস্তুতঃ নবী-রাসূলগণ (আ.) ও মা‘ ছূম ইমামগণের (আ.) বেলায় যেমনটি ঘটেছে,ঠিক তদ্রূপই যতক্ষণ পর্যন্ত জনগণ না চাইবে ততক্ষণ পর্যন্ত ফকীহ স্বীয় হুকুমাত ও শাসন-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তি প্রয়োগের আশ্রয় গ্রহণ করবেন না (ইমাম খেমেনী(রহঃ) এ বিষয়ে বলেন: স্বীয় জাতির উপর ফকিহদের শাসন চাপিয়ে দেয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়,ইসলাম আমাদের এ অনুমতি দেয়নি যে,আমরা জনগণের উপর স্বৈরাচারী কায়দায় জেকে বসবো; আল্লাহ ও তার নবী এমন অনুমতি আমাদেরকে দেননি)। জনগণ যদি সমর্থন করে ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে কেবল তখনই দ্বীনের ও ফকীহগণের হুকুমাত প্রতিষ্ঠিত হবে। যদিও জনগণের উচিৎ ফকীহগণের অনুসরণ ও আনুগত্য করা এবং তারা যদি ফকীহগণের হুকুমাতের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত না করে তাহলে তারা গুনাহ্গার হবে ও এ কারণে তাদেরকে আল্লাহ্ তা‘ আলার নিকট জবাবদিহি করতে ও শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে,তথাপি তারা ফকীহর হুকুমাত প্রতিষ্ঠার কাজে সহায়তা দেয়া ও না দেয়ার ব্যাপারে স্বাধীন। তারা যদি সহায়তা প্রদান করে তাহলে আল্লাহ্ তা‘ আলা,হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) ও হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর পক্ষ থেকে মনোনীত ফকীহ শাসক হুকুমাত প্রতিষ্ঠা করেন এবং জনগণকে আল্লাহর ইবাদত ও গোলামী,দ্বীনদারী এবং দুনিয়া ও আখেরাতের সৌভাগ্যের দিকে নিয়ে যান।

কতক লোক দু’ টি দ্বীনী বিষয়কে পরস্পরের সাথে গুলিয়ে ফেলে লোকদের মনে সন্দেহ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে থাকে। তারা প্রশ্ন তোলেঃ বেলায়াতে ফকীহ্ কি নির্বাচনের বিষয়,নাকি মনোনয়নের বিষয়? তাহলে এ ক্ষেত্রে জনগণের ভূমিকা কী? নির্বাচন অনুষ্ঠান কেন?

ফকীহ শাসক আল্লাহ্ তা‘ আলার পক্ষ থেকে মনোনীত,তবে এ ব্যাপারে জনগণের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ্ তা‘ আলার পক্ষ থেকে মনোনীত ফকীহ শাসককে ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে জনগণের পক্ষ থেকে সমর্থন ও সহায়তা প্রদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের সহায়তা ও সমর্থন না পাওয়া পর্যন্ত হযরত আলী (আ.) রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকেন এবং তাদের সমর্থনক্রমে রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে নেন ও কুফাকে কেন্দ্র করে ন্যায়বিচারের হুকুমাত প্রতিষ্ঠা করেন ও যুলুম-অত্যাচারের প্রতিরোধ করেন।

জনগণের এ ক্ষমতা আছে যে,তারা তার প্রতি সমর্থন ও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাকে রাষ্ট্রক্ষমতা বিচ্ছিন্ন অবস্থা থেকে মুক্ত করে আনবে এবং এমন এক অবস্থানে অধিষ্ঠিত করবে যেখান থেকে তিনি ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু জনগণ শাসন ক্ষমতার মূল(অধিকারী) হিসেবে তাকে নিয়োগ ও তার উপর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করার শরীয়তসম্মত কর্তৃপক্ষ নয়,বরং এটা হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘ আলার বিশেষ এখতিয়ার। তাই তিনি যাকে এমন এখতিয়ার দিবেন কেবল সেই তার পক্ষ থেকে অন্য কাউকে এমন অধিকার প্রদান করতে পারবেন। হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.) যেহেতু আল্লাহ্ তা‘ আলার পক্ষ থেকে জনগণের ইমাম ও শাসক হিসেবে মনোনীত ছিলেন,সেহেতু তিনিও এ বিশেষ এখতিয়ারের অধিকারী ছিলেন। এ কারণেই তিনি ফকীহকে নিজের পক্ষ থেকে শাসক ও বিচারক নিয়োগ কওে বলেছেন যে,যারা তার মনোনীত শাসক ও বিচারককে প্রত্যাখ্যান করলো তারা আল্লাহর হুকুমকেই প্রত্যাখ্যান করলো।

হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর নবুওয়াতের দায়িত্বে অভিষিক্ত হবার পর প্রথম দিককার একটি ঘটনা। একজন আরব গোত্রপতি তাকে প্রশ্ন করলেনঃ“ আপনার নিজের পরে মুসলমানদের নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের বিষয়টি কি আমাদের ওপর ছেড়ে দেবেন?” তার প্রশ্নের জবাবে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) বললেনঃ“ শাসন-কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের বিষয়টি আল্লাহ্ তা‘ আলার এখতিয়ার(ইচ্ছাধীন বিষয়)। তিনি যাকে চাইবেন এ দায়িত্বের জন্য মনোনীত করবেন।”

হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মগোপনরত থাকার যুগে ইসলামী সমাজের সামগ্রিক নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের অধিকার হচ্ছে ন্যায়নিষ্ঠ ও যুগসচেতন ফকীহ-এর। প্রকৃত পক্ষে তিনি মা‘ ছূমগণ (আ.) ও হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর পক্ষ থেকে মনোনীত এবং সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার যে এখতিয়ার হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর,তা তার ওপর অর্পিত। ইমাম (আ.) স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘ আলার পক্ষ থেকে এ এখতিয়ারের অধিকারী এবং ফকীহকে এ দায়িত্বের জন্যে মনোনীত করার বিষয়টিও আল্লাহ্ তা‘ আলার অনুমতিক্রমেই সম্পাদিত হয়েছে।

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন