শহীদে কারবালা ইমাম হোসাইনের এজিদী স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন
শহীদে কারবালা ইমাম হোসাইনের এজিদী স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন
যুগে যুগে সত্যাশ্রয়ী ও নীতিনিষ্ঠদের ভূমিকা একই ছিল। তারা যে মত ও পথকে সত্য জ্ঞান করেছেন, শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সেই নীতি, মত ও পথের উপর অবিচল থেকেছেন। নীতির প্রশ্নে তারা যেমন কারও সঙ্গে আপোষ করতেন না, তেমনি কে বা কারা এবং কতসংখ্যক লোক তাদের সঙ্গে রয়েছে, সেদিকেও ভ্রূক্ষেপ করতেন না। আর এমনিভাবে একদিন দেখা যায়, কোনো সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় যেখানে মুষ্টিমেয় লোক কাজ করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত সমাজের শত বাধা উপেক্ষার সম্মুখীন হয়েছিল, পরবর্তী পর্যায়ে সেখানে গোটা সমাজ তাদের আদর্শের পতাকা হাতে এগিয়ে এসেছে। শহীদে কারবালা ইমাম হোসাইনের সংগ্রামী জীবনেও আমরা এ সত্যের অভিব্যক্তি দেখতে পাই। তিনিই প্রথম ত্যাগী পুরুষ, যিনি মানুষের জন্যে আল্লাহর দেয়া জীবন-বিধানকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তার প্রাণসত্তা সহকারে অবিকৃত রাখার উদ্দেশ্যে নির্ভীকভাবে সংগ্রাম করে গেছেন। সত্যের ঝান্ডাকে উঁচু করে রাখার সংগ্রামে শত্রুশক্তির বিপুলসংখ্যাধিক্য, হামলার প্রচন্ডতা ও নির্মমতা তাকে এতটুকু নত করতে পারেনি। নিজের এবং প্রাণপ্রিয় মাসুম সন্তানদের বুকের রক্ত দিয়ে তিনি একথা প্রমাণ করে গেছেন যে, আল্লাহ প্রদত্ত রাষ্ট্রীয় বিধানকে তার যথাযথ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত রাখার প্রশ্নে ত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে কোনো মুসলমানের পক্ষে নিজের ও প্রাণপ্রিয় সন্তানদের জীবনাহুতির বিষয়টি অতি তুচ্ছ। কারণ, এরি মাধ্যমে প্রমাণিত হয় খোদাপ্রীতির প্রকৃত স্বরূপ। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ইসলামী খেলাফতের নেতা বাছাইয়ের প্রশ্নে হক কথা না বলে চুপ থাকার নীতি করা হলে, ভবিষ্যতে ইসলামের দুর্যোগ মুহূর্তগুলোতে এর আওয়াজ বুলন্দ করার মতো নির্ভীক মুজাহিদের অভাব ঘটবে। স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে সত্যের পতাকা নিয়ে রুখে না দাঁড়ালে, মানুষ মুলত অনাগত দিনগুলোতে অত্যাচারীর সামনে হক কথা বলার সাহসী কোনো আদর্শ ব্যক্তিত্ব খুঁজে পাবে না। মুলত একটি প্রতিষ্ঠিত রাজশক্তির বিরুদ্ধে অস্ত্রবল ও জনবল শূন্য অবস্থায় কথা বলার পরিণতি কি হতে পারে, সংগ্রামী ইমাম তা ভাল করেই অনুধাবন করেছিলেন। এজন্যেই শুধু একটি বাক্য- ‘ইয়াজীদের আনুগত্য করি' এই বলে কাপুরুষতা দেখাননি, দেখিয়েছেন ঈমানের প্রদীপ্ত শিখা। এছাড়া হোসাইন পরিবারের উন্নত নৈতিক চরিত্র সম্পর্কে ওয়াকিফহাল এমন কোনো মহল একথা বলতে পারবে না যে, ব্যক্তিগত স্বার্থ বা কর্তৃত্ব হাসিলের জন্য তিনি এ পথে পা বাড়িয়েছিলেন।
সাইয়েদুশ-শুহাদা ইমাম হোসাইন ৬২৫ খৃস্টাব্দে মহানবী মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.)-এর কন্যা ফাতেমা (রা.)-এর (৬০৫-৬৩৩) গর্ভে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। হযরত আলী (রা.) ছিলেন তার পিতা।
মাতামহ মহামানব হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হোসাইনকে অপরিসীম স্নেহ করতেন। প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) হোসাইন ও তাঁর ভ্রাতা হাসানকে এতই ভালবাসতেন যে, তারা বাল্যাবস্থায় কোনো কোনো সময় হযরতের পবিত্র গ্রীবাদেশের ওপর চড়ে বসলেও তাতে তিনি বিরক্তিবোধ করতেন না। হযরত ইরশাদ করেছেন : ‘‘হাসান-হোসাইন আমার থেকে আমি হাসান হোসাইন থেকে।’’ মহানবী (সাঃ) তার কন্যা ফাতেমা (রা.) কে ডেকে বলতেন : হে ফাতেমা! হাসান হোসাইনকে কাঁদাবেনা না। এতে আমি মনে ব্যথা পাই। হে আল্লাহ! আমি হাসান-হোসাইনকে ভালবাসি, তুমিও তাদেরকে এবং তাদের প্রতি যারা ভালবাসা পোষণ করে তাদেরকে ভালবাস। হোসাইন এবং তার ভাইয়ের শিক্ষা-দীক্ষার কথা বলতে গেলে এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, তিনি এবং তাঁর ভ্রাতা যে মহান শিক্ষকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ধর্ম, নৈতিকতা এবং রাজনীতি শিক্ষা লাভ করেছেন এবং যে ধরনের শিক্ষা অনুশীলন পরিবেশে দিবারাত্র লালিত পালিত ও বর্ধিত হয়েছেন, দুনিয়ার ইতিহাসে তার অপর কোনো নজির নেই এবং হবেও না। হযরত হোসাইনের শিক্ষক হযরত আলী (রা.) হচ্ছেন বিশ্বমানবের শিক্ষাগুরুর প্রধান ছাত্র। সহপাঠীগণ দুনিয়ার সকল সহপাঠীর চাইতে শ্রেষ্ঠ চরিত্রবান, সহৃদয়, খোদাভীরু এবং স্নেহবাৎসল্যে পরিপূর্ণ আদর্শবান সহচর। এই অতুলনীয় শিক্ষা-পরিবেশে শিক্ষাপ্রাপ্ত, বিশেষ করে মাদরাসা-এ-নবুওয়াতের আল্লাহ প্রেরিত প্রধান অধ্যাপকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শিক্ষালাভের পর একজন ছাত্রের চরিত্র ও জীবনধারা যা হওয়া উচিত, হযরত হোসাইনের জীবনের বহুবিধ বিক্ষিপ্ত ঘটনা ও সর্বশেষ তাঁর ত্যাগী জীবনের অমর রক্তাক্ত ইতিহাসই তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
আধ্যাত্মিক শিক্ষায় সমৃদ্ধ সুমহান চরিত্রের অধিকারী, জ্ঞান গভীর, অভিজ্ঞ ও খোদাপ্রেমিক সুশিক্ষিত আলী (রা) তার নয়নমনি হাসান-হোসাইনকে নিজে শিক্ষা-প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
হযরত আলী (রা)র শাহাদাতের পর মুসলিম বিশ্বের একচ্ছত্র শাসনক হয় মোয়াবিয়া। সে বার্ধক্যে পৌঁছে গেছে। তার পরে ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধানের ক্ষমতা কার হাতে হস্তান্তর করা যায়, তা নিয়ে ভাবছে। অবশেষে নিজ সিদ্ধান্ত মতে আঞ্চলিক শাসকদের প্রতি পরবর্তী শাসক হিসেবে এজিদের জন্যে আনুগত্য আদায়ের নির্দেশ দিল। নিজে হজ্বের মওসুমে দামেস্ক থেকে এক হাজার সৈন্য নিয়ে মক্কা-মদীনায় সফরে আসে। উভয় স্থানের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ যেমন, ইমাম হোসাইন (রা), আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা), আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা) প্রমুখের কাছে উপরোক্ত প্রস্তাব রাখল। তাঁরা মুবিয়ার স্বীয় পুত্রকে নিজের স্থলাভিষিক্তকরণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে
মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে ইয়াজিদকে মুসলিম জাহানের শাসকরূপে ঘোষণা করা হয়। মোয়াবিয়ার ইন্তিকালের পর তার নির্দেশ মোতাবেক ৬১ হিঃ মোতাবেক ৬৮০ খৃঃ এজিদ শাসন ক্ষমতা হাতে নেয় এবং মদীনার বিদ্রোহী প্রধান নেতাদের নিকট হতে বশ্যতা আদায়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এজিদের ঔদ্ধত্য হোসাইনকে স্থির থাকতে দিল না। মুসলিম জনগণও ইয়াজিদের শাসন ক্ষমতা প্রাপ্তিতে বিচলিত হয়ে উঠলো। মোয়াবিয়া এর জীবদ্দশায় ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরোধে বড় ভ্রাতা ইমাম হাসান (রাঃ) তিরোধানের পর জনসমর্থনের ভিত্তিতে খলীফা নির্বাচনের উপর বিরোধ ফয়সালা করেছিলেন। তখন ইসলাম বাহ্যত এতটা বিপন্ন হবার আশংকা না থাকলেও এখন অবস্থা সম্পূর্ণ অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে।
এই সংকটময় মুহূর্তে এজিদের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে নিজের নিরাপত্তা চাইলে ইসলামের আদর্শকে বিসর্জন দিতে হয়। আর ইসলামের কল্যাণ চাইলে এজিদের শাসনকে অস্বীকার করতে হয়। ইমাম হোসাইন এই উভয় সংকটে পড়ে শেষোক্ত ত্যাগের পথই বেছে নিলেন। আর এরই শেষ পরিণতি হিসেবে (৬১ হিঃ ১০ই মুহাররম-মোতাবেক ৬৮০ খৃঃ) কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা সংঘটিত হয়। অন্যথায় শুধু ইসলামই আপন সত্তা হারাতো না, নবী বংশসহ দুনিয়ার সকল মুসলমান কলঙ্কিত হতো এবং শাহাদাতে কারবালার প্রেরণা নিয়ে যুগে যুগে যেসব ইসলামী আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছে, তাও হতো কিনা সন্দেহ।
ইমাম হোসাইনের দূরদর্শিতা : ইমাম হোসাইন তাঁর দূরদৃষ্টি দ্বারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, এজিদ যেভাবে অগণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতায় এসেছেন, তার পরিচালিত পদ্ধতিতে খেলাফত স্বৈরতান্ত্রিক একনায়কত্বমূলক রাষ্ট্রে পরিণত হবে। তাতে গণতান্ত্রিক ইসলামী সমাজ সম্পূর্ণ ভ্রান্তপথে পরিচালিত হবে। ইসলামী রাষ্ট্র, সমাজ ব্যবস্থা এবং তার প্রাণশক্তিতে দেখা দিবে মূল আদর্শের পরিবর্তন ও বিকৃতি। মহানবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের আপ্রাণ চেষ্টা ও ত্যাগের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুপ্রবেশ করবে রাজতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক স্বার্থপরতা, দেখা দিবে মানুষে মানুষে অসাম্য ও ভেদনীতি।
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন