বিশ্ব কুদস দিবস ও ফিলিস্তিন
বিশ্ব কুদস দিবস ও ফিলিস্তিন
মুসলিম ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঙ্গে এর সংশিস্নষ্টতা রয়েছে। অসংখ্য নবী রাসুলের পদধূলিতে ধন্য এই নগরী। মিরাজ রজনীতে এই মসজিদেই রাসুল (সা.) সমস্ত নবীগণের ইমামতি করেছিলেন। জিনদের মাধ্যমে হযরত সুলায়মান (আ.) সর্বপ্রথম এই মসজিদ নির্মাণ করেন। অসংখ্য নবী রাসুলের দাওয়াতী মিশন পরিচালিত হয়েছে এই মসজিদকে কেন্দ্র করে। জেরুজালেম নগরী বিশ্বের অন্যতম পবিত্র স্থান। সকল ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ এই নগরীকে শ্রদ্ধা করে থাকেন। এক হাদীসে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন "বায়তুল মোকাদ্দাসে এক রাকাত নামাজ পড়লে পঞ্চাশ হাজার রাকাত নামাজের সওয়াব হয়।" কিন্তু আফসোসের কথা হচ্ছে মুসলমানরা আজ সেই সওয়াব থেকে বঞ্চিত। বায়তুল মুকাদ্দাস ও জেরুজালেম নগরীতে আজ মুসলমানদের বিচরণ নিষিদ্ধ। নিজেদের পবিত্র স্থানে যেতেও তারা আজ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। ফিলিস্তিনের জনগণের জন্যও সেখানে যাওয়া নিয়ন্ত্রিত। অভিশপ্ত ইহুদীরা জবরদখল করে আছে সেই স্থানটিতে। বছরের পর বছর ধরে মুসলমানরা সেখানে যেতে পারছে না। হাজার বছরের মুসলিম ঐতিহ্যমণ্ডিত এই নগরীতে মুসলমানরাই আজ নিগৃহিত। অথচ অবৈধ ও অনৈতিকভাবে উড়ে এসে জুড়ে বসা ইহুদীরা সেখানে দীরদর্পে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের কর্তৃত্ব। শুধু ফিলিস্তিনবাসীর জন্যই নয় বরং সমগ্র মুসলিম জাতীর জন্য এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক। ফিলিস্তিন আয়তনগত দিক থেকে তেমন বড় রাষ্ট্র নয়। এর মোট আয়তন মাত্র ২৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার। কিন্তু ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে এর গুরুত্ব অপরিসীম ইহুদী-খৃষ্টান ও মুসলমান তিন ধর্মের লোকদের কাছেই ফিলিস্তিন পুণ্যভূমি হিসেবে গণ্য। ফলে এর কর্তৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত চলে আসছে শুরু থেকেই ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে ইহুদী ও খৃষ্টানদের মধ্যে এ নিয়ে অনেক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। প্রাচীন যুগের রীতি অনুযায়ী ক্ষতার লড়াইয়ে যারা বিজয়ী হয়েছে তারাই এর কর্তৃত্ব করেছে। ইসলামের আবির্ভাবের পর ইসলাম অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। নবী (সা) এর ওফাতের কিয়দকাল পরে ফিলিস্তিন মুসলমানদের দখলে আসে। মাঝে বিশ্বব্যাপী ক্রুসেড চলাকালে স্বল্প সময়ের জন্য আল কুদস্ খৃষ্টানদের দখলে গিয়েছিল। কিন্তু ইতিহাসখ্যাত বীর সেনানী সালাহউদ্দীন আইয়ূবী তা পুনরুদ্ধার করেন। এরপর থেকে মুসলমানরা নির্বিঘ্নে পবিত্র এই নগরীতে তাদের নিজেদের ধর্মকর্ম আঞ্জাম দিয়ে আসছে। এর সঙ্গে সমস্ত মুসলিম জাতির একটি নিবিড় সম্পর্ক কায়েম হয়েছে। একে কেন্দ্র করে আরব বিশ্ব তথা মুসলিম দেশসমূহে গড়ে উঠেছে ঐতিহ্যের আবহ। মধ্যপ্রাচ্যের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে ফিলিস্তিন নগরী। কিন্তু বিপত্তি বাধে বিগত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা যাযাবর জাতি ইহুদীদের একটি স্থানে জড়ো করার দাবি উঠে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেন এ ব্যাপারে জোর তৎপরতা চালায়। মুসলমানদেরকে নিগৃহিত করার হীন উদ্দেশ্যে মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদীদের পুনর্বাসন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সে লক্ষে তারা নিজেদের প্রতক্ষ্য মদদে মধ্যপ্রাচ্যের নোলক ফিলিস্তিন নগরীতে ইহুদীদের এনে জড়ো করে। একটি স্বাধীন ইহুদী রাষ্ট্র গঠনের সব ব্যবস্থা নেয়া হয়। জাতিসংঘও এতে সহযোগিতা যোগায়। তখন বলা হয়েছিল এখানে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রও গঠন করা হবে। কিন্তু সেই আশার কথার চিড়ে আজও ভিজেনি। এরপর থেকে ফিলিস্তিনের সমস্যা দিন দিন ঘনীভূত হয়েছে। ফিলিস্তিন পরিণত হয়েছে একটি নরক কুণ্ডে। প্রতিদিনই ঝরছে নিষ্পাপ ফিলিস্তিনিদের রক্ত। ইসরাইলী সেনাবাহিনীর বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা হচ্ছে অসংখ্য মুসলিমের বুক। গুড়িয়ে দেখা হচ্ছে তাদের ঘর বাড়ি। বাধ্য হয়ে মুসলিম যুবকেরা অস্ত্র হাতে নিচ্ছে। এমনকি আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত নিতেও তারা পিছপা হচ্ছে না। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্নে তারা আজ বিভোর। কিন্তু তাদের সেই আশা দিন দিন দুরাশায় ঘনীভূত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদীদের সূক্ষ্ম চালের কারণে ফিলিস্তিন ও মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি হচ্ছে। সারা বিশ্বের মুসলমানেরা আজ তাকিয়ে আছে ফিলিস্তিনের দিকে। কবে মুক্ত হবে আল কুদ্স। কবে মুসলমানরা আবার তাদের পূণ্যস্থান বায়তুল মোকাদ্দাসে স্বাধীনভাবে ইবাদত বন্দেগী করতে পারবে। মুসলমানদের সেই আশা পূরণের আপাতত কোনো ঝিলিক দেখতে পাওয়া না গেলেও নৈরাশ্যের কোন কারণ নেই। হয়ত অচিরেই মুসলমানদের মধ্যে জন্ম হবে আরেক সালাহউদ্দিন আইয়ূবীর। যিনি আবার মুসলমানদের সেই পূর্ণভূমি ফিরিয়ে দিবে মুসলমানদের হাতে। সেই আশা মুসলমানরা করতে পারেন, কারণ তাদের জন্য রয়েছে খোদায়ী প্রতিশ্রুতি 'তোমরা ভেঙ্গে পড়োনা, দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়োনা, তোমরাই একদিন বিজয়ী হবে- যদি তোমরা প্রকৃত মুমীন হয়ে থাক।' খোদার দরবারে মিনতি জানাচ্ছি তিনি যেন আমাদের প্রথম কেবলা আবার আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেন।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেনি (রহ.) ইরানের ইসলামীবিপ্লবের নজির বিহীন সাফল্যের পর পবিত্র রমজান মাসের শেষ শুক্রবারকে বিশ্ব আলকুদস দিবস হিসেবে পালন করার আহবান জানিয়েছিলেন৷ তার সে আহবানে সাড়া দিয়ে বিশ্ববাসী বিশেষ করে মুসলমানরা প্রতিবছর এ দিনটি বিশ্ব কুদস দিবস উপলক্ষ্যে উদযাপন করে আসছে৷ ইহুদীবাদী ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে মুসলিম বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকী তা ইমাম খোমেনী (রঃ) দুইযুগ আগেই বলেছিলেন এবং একথা আজও প্রমাণিত৷ আমেরিকা শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য নয় গোটা বিশ্ব মানবতার শত্রু৷ তারা বিনা বিচারে মানবাধিকার লংঙ্ঘন করে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় আগ্রাসন চালাচেছ৷ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদুত শায়ের মোহাম্মদ বলেন, ইসরাইলী বাহিনী প্রতিদিন নিরপরাধ ফিলিস্তিনি সাধারণ নাগরিকদের হত্যা করে চলেছে৷ আজ পশ্চিমা বিশ্ব মানবাধিকারের দোহাই তুলে শক্তিশালী ইসরাইলী বাহিনীর সামনে অসহায় ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মরক্ষার অধিকারটুকু কেড়ে নিয়েছে৷ ফিলিস্তিনি জনগণ যখন ইসরাইলী বাহিনীর বর্বরচিত আক্রমণের সামনে ঢিল ছুড়ে তখন পশ্চিমা বিশ্বে ফলাও করে প্রচার করে বলা হয় এরা সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত ৷ এরা মানবাধিকার লঙঘন করছে৷ অথচ ইসরাইলী সৈন্যরা যখন ফিলিস্তিনি জনগণের ঢিলের জবাবে অত্যাধুনিক রাইফেলের বুলেট দিয়ে শিশু বৃদ্ধ ও মহিলাদের হত্যা করে তখন মানবাধিকার লঙঘনের কোন প্রশ্ন করা হয় না৷ আর এভাবেই যুগের পর যুগ চলছে ফিলিস্তিনিদের মাতৃভুমি রক্ষার আন্দোলন৷ ইমাম খোমেনী (রঃ) বিশ্ব মুসলিমের ঐক্যের জন্য যে কুদস দিবসের ঘোষণা দিয়েছিলেন তা আজ মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় এক অন্যন্য উদাহরণ৷ বিশ্বে কোটি কোটি মুসলমান থাকা সত্ত্বে গুটি কয়েক ইহুদী বাইতুল মোকাদ্দাস দখল করে রেখেছে৷ একমাত্র মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্যের জন্যই আজ বিশ্বে মুসলমানরা নির্যাতিত৷ মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যই পারে তাদের হারানো ঐতিহ্য ও বাইতুল মোকাদ্দাসকে ইহুদীদের হাত থেকে উদ্ধার করতে৷ তাই ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর ডাকে প্রতি রমযানের শেষ শুক্রবার বিশ্ব কুদস দিবসে বিশ্বের সকল মুসলমান এই দিনটিতে নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় প্রেরণা হিসেবে মনে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের মান মর্যাদা কেবল ফিলিস্তিনের মধ্যেই সীমাবন্ধ নয় বরং এটা মানবজাতি ও বিশ্ববাসীর মান মর্যাদার বিষয়৷
ইঙ্গ-মার্কিন মদদপুষ্ট ইহুদিবাদী ইসরাইলের পাশবিক নির্যাতন এবং কিছু কিছু আরব দেশের অসহযোগিতার কারণে ফিলিস্তিনিরা বর্তমান শতাব্দীতে বিশ্বের সবচেয়ে মজলুম জাতিতে পরিণত হয়েছে ৷ আমেরিকা এ পর্যন্ত ইসরাইল বিরোধী ৩০টি প্রস্তাবে ভেটো প্রদান করেছে ৷ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অর্ধেকের বেশি প্রস্তাবে আমেরিকা ভেটো দিয়েছে যার অধিকাংশ প্রস্তাবই ছিলো ফিলিস্তিন সম্পর্কিত ৷ শরণার্থীদেরকে তাদের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে জাতিসংঘের ইশতেহারের প্রতি কর্ণপাত না করে মূলত এ সংস্থাকে হাসির পাত্রে পরিণত করেছে ৷ ইহুদিবাদী ইসরাইল বিভিন্ন ঘাঁটি তৈরি করে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি এবং যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে এই দেশুগুলোর তেল বিক্রির অর্জিত অর্থ হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে ৷
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর দৃষ্টিতে নির্যাতিত ফিলিস্তিনীদের প্রতি সহমর্মীতা ও সত্য প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে বিশ্ব কুদস দিবস সব সময়ই বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী৷ তাই পশ্চিমা ও ইসরাইলী গণমাধ্যমগুলো সব সময়ই বিশ্ব কুদস দিবসকে খাটো করে দেখানো এবং এ ব্যাপারে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করলেও এ দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত মিছিলে লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতির বিষয়টিকে তারা কখনই জনগণের দৃষ্টি থেকে আড়াল করতে পারেনি৷ এবছরও এর ব্যতিক্রম হবে না।
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন