কিয়ামতে খুব কম মানুষই স্বীয় চেহারা নিয়ে উত্থিত হবে
কিয়ামতে খুব কম মানুষই স্বীয় চেহারা নিয়ে উত্থিত হবে
এক ব্যক্তি ইমাম জাইনুল আবেদীন (আ.)-এর সাথে আরাফাতের ময়দানে ছিলেন। পাহাড়ের ওপর থেকে হাজিতে পূর্ণ ময়দান দেখে ইমামকে বললেন :কত বিপুল সংখ্যক হাজি এ বছর এসেছে আলহামদুলিল্লাহ্। ইমাম বললেন : হৈ-চৈ অনেক বেশি, কিন্তু হাজি খুবই কম। ঐ ব্যক্তি বলেছে, তারপর জানি না ইমাম আমাকে বিশেষ দৃষ্টি শক্তি দান করলেন এবং বললেন : লক্ষ্য কর। ওই ব্যক্তি এবার দেখলেন সম্পূর্ণ ময়দান যেন পশুতে পূর্ণ—যেন চিড়িয়াখানার মধ্যে অল্প কয়েকজন মানুষ চলাচল করছে। ইমাম বললেন : 'এখন দেখ বাতেন বা ভেতরের অপ্রকাশিত দিক কিরূপ!'যারা অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ও আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী তাঁদের কাছে এ বিষয়টি প্রদীপের মতই উজ্জ্বল।
যে মানুষ চতুষ্পদ জন্তুর মত শুধু খাওয়া, ঘুমানো, যৌন চাহিদা পূরণ ছাড়া অন্য কোন চিন্তা করে না, তার আত্মা আসলে এক চতুষ্পদ জন্তু ছাড়া আর কিছুই নয়।
সূরা নাবায় আমরা পড়ি: ‘‘সে দিন যখন শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে তখন তোমরা দলে দলে আসবে। এবং আকাশকে উন্মুক্ত করা হবে ফলে তা বহু দরজায় বিভক্ত হয়ে পড়বে। পর্বতমালাকে বিচলিত করা হবে ফলে তা মরীচিকায় পরিণত হবে।’’ (সূরা নাবা : ১৮-২০) কিয়ামতের দিন মানুষ দলে দলে পুনরুত্থিত ও সমবেত হবে। নবী-রাসূল ও ইমামরা সব সময়ই বলেছেন, শুধু মানুষের একটি দল মানুষের চেহারায় পুনরুত্থিত হবে। কোন কোন দল পিপড়ার মত, কোন দল সাপের মত, কোন দল নেকড়ের মত চেহারা নিয়ে হাশরের ময়দানে আবির্ভূত হবে। পৃথিবীতে মানুষকে ক্ষত বিক্ষত করা ছাড়া যে ব্যক্তির অন্য কোন কাজ ছিল না, সে প্রকৃতই একটি বিষাক্ত বিচ্ছু। তাই সে সেভাবেই পুনরুত্থিত হবে। যে ব্যক্তির বাঁদরামি করাই একমাত্র স্বভাব ছিল কিয়ামতে প্রকৃতই সে বাঁদরের চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হবে। এমনিভাবে যার স্বভাব কুকুরের মতো সে কুকুর হিসেবে পুনরুত্থিত হবে। ‘‘মানুষ তার (কাজের) নিয়্যতের উপর ভিত্তি করেই পুনরুত্থিত হবে।’’ (মুসনাদে আহমদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৯২)
মজান দেয়া হয়েছে এ জন্য যে, এ মাসে ত্রুটিযুক্ত মানুষ নিজেকে ত্রুটিহীন মানুষে এবং ত্রুটিহীন মানুষ নিজেকে পূর্ণ মানুষে পরিণত করবে। এ পবিত্র মাসের পরিকল্পনা হল নাফস বা প্রবৃত্তির পরিশুদ্ধি, মানবীয় ত্রুটি ও অপূর্ণতার সংশোধন,প্রবৃত্তির জৈবিক তাড়নার ওপর বুদ্ধিবৃত্তি, ঈমান ও ইচ্ছাশক্তির বিজয় ও নিয়ন্ত্রণ।
এর জন্য দোয়ার কর্মসূচী, সত্যের পথে ইবাদতের মাধ্যমে খোদামুখী হওয়া, আত্মার উন্নয়নের জন্য কর্মসূচী,আত্মাকে বিকাশমান ও গতিশীল করার পরিকল্পনা দেয়া হয়েছে। যদি এমন হয়, পবিত্র রমজানে মানুষ ত্রিশ দিন ক্ষুধার্ত,তৃষ্ণার্ত ও নিদ্রাহীন থাকল, রাত্রিগুলোতে অনেক সময় জেগে থাকল, এখানে ওখানে নানা অনুষ্ঠানে গেল, তারপর ঈদ আসলো, কিন্তু তার বর্তমান অবস্থায় বিন্দুমাত্র উন্নতি হল না,তাহলে ঐ ‘রোজা’ আসলে তার কোন উপকারই করেনি।
আর এ জন্যই হাদিসে এসেছে,বহু রোজাদার আছে তাদের রোজা শুধু ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকা ছাড়া কিছুই নয়! হালাল খাদ্য থেকে মুখ বন্ধ করার অর্থ মানুষ এ ত্রিশ দিন একনাগাড়ে অনুশীলন করবে হারাম কথা থেকে জিহ্বাকে বিরত রাখার,গিবত না করার,মিথ্যা না বলার ও গালি না দেয়ার।
একদিন এক রোজাদার মহিলা রাসূল (সা.)-এর কাছে আসল। রাসূল(সা.) দুধ অথবা অন্য কিছু খেতে তাকে অনুরোধ করে তার দিকে তা এগিয়ে দিয়ে বললেন,‘‘নাও পান কর।’’ সে বলল,‘‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমি রোজা রেখেছি।’’ রাসূল(সা.) বললেন,‘‘তুমি রোজা রাখনি এবং এ বলে আবারও তাকে খেতে বললেন।’’ মহিলা বলল, ‘‘আসলেই আমি রোজা রেখেছি।’’(যেহেতু তার বিবেচনায় সে রোজাদার ছিল বলে মনে করেছিল,যেমন বাহ্যিক রোজা আমরা রাখি)। এরপর রাসূল বললেন,
‘‘তুমি কেমন রোজা রেখেছ যে,কিছুক্ষণ আগেই তোমার মুমিন ভাই বা বোনের মাংস খেয়েছ (অর্থাৎ গিবত করেছ)। তুমি কি দেখতে চাও যে, মাংস খেয়েছ? ভেতর থেকে এখনই তা বের করে ফেল।’’ তখনই সে বমি করল ও এক টুকরা মাংস তার মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ল। মানুষ রোজা রেখে গীবত করে। ফলে যদিও তার মুখকে হালাল খাদ্য থেকে বঞ্চিত করে, কিন্তু তার আত্মার মুখকে হারাম খাদ্য দিয়ে পূর্ণ করে।
একই কারণে বলা হয়েছে,যদি মানুষ একটা মিথ্যা বলে তবে তার মুখের দুর্গন্ধে সাত আসমান পর্যন্ত ফেরেশতারা কষ্ট পান। যেমন বলা হয় যখন মানুষ জাহান্নামে থাকবে তখন জাহান্নাম প্রচণ্ড দুর্গন্ধ ছড়াবে। এ দুর্গন্ধ প্রকৃতপক্ষে এ দুনিয়াতেই আমরা সৃষ্টি করেছি মিথ্যা কথা বলা,গালি দেয়া,অপবাদ ও পরনিন্দা চর্চার মাধ্যমে।
পরনিন্দা ও অপবাদ আরোপ গিবত থেকেও নিকৃষ্ট,যেহেতু পরনিন্দার মাধ্যমে যেমন মিথ্যাও বলা হয় তেমন গিবতও করা হয়। কিন্তু যে মিথ্যা বলে সে শুধু মিথ্যাই বলে,গিবত করে না। তাই পরনিন্দায় দু’টি কবিরা গুনাহ এক সঙ্গে করা হয়।
রমজানে একে অপরের বিরুদ্ধে নিন্দা ও অপবাদ আরোপ অত্যন্ত নিন্দনীয়। রমজান মাস ঐক্যের মাস। এ মাস দেয়া হয়েছে এজন্য যে, মুসলমানরা বেশি বেশি সমবেত হবে,সম্মিলিতভাবে ইবাদত করবে, মসজিদে মিলিত হবে ও একে অপরকে দূরে সরাবে না।
সুতরাং আমাদেরকে কেয়ামতের কথা স্মরণে রেখে নিজেদের নৈতিকতার সংশোধন এবং আমল করতে হবে।
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন