যিকর’এর মর্যাদা ও গুরুত্ব
যিকর’এর মর্যাদা ও গুরুত্ব
জিকির একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। জিকির শব্দের অর্থ স্মরণ করা। জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের সহজ উপায়। জিকির অন্তরকে যাবতীয় গোনাহ, অসৎ স্বভাব এবং কুরিপু থেকে মুক্ত ও পবিত্র রাখার একক মাধ্যম। উন্নতির শীর্ষস্থান ও দিদারে ইলাহি লাভ করার নিকটতম উসিলা। যার সম্পর্ক হলো অন্তরের সঙ্গে। তবে জিহ্বা যেহেতু অন্তরের মুখপাত্র কাজেই মুখে স্মরণ করাকেও জিকির বলা যায়। এতে বোঝা যায়, সে মৌখিক জিকিরই গ্রহণযোগ্য, যার সঙ্গে মনেও আল্লাহর স্মরণ বিদ্যমান থাকবে।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا اللَّهَ ذِكْرًا كَثِيرًا
হে মুমিনরা! তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করো।(সূরা আহযাব, আয়াত নং ৪১)
পক্ষান্তরে আল্লাহর জিকির এমন ইবাদত, যার কোনো সীমা বা সংখ্যা নির্ধারিত নেই। বিশেষ সময় ও কাল নির্ধারিত নেই। সুস্থ থাকুক বা অসুস্থ, রাত হোক বা দিন সর্বাবস্থায় আল্লাহর জিকিরের হুকুম রয়েছে। প্রিয় নবী (সা.) সাহাবায়ে কেরামদের লক্ষ্য করে বললেন, আমি কি তোমাদের এমন কোনো আমলের সন্ধান দেব না, যা তোমাদের যাবতীয় আমলের চেয়ে উত্তম, তোমাদের প্রভুর কাছে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য, তোমাদের মর্যাদা বিশেষভাবে বৃদ্ধিকারী, আল্লাহর রাস্তায় সোনা-রুপা দান করা এবং জেহাদ থেকেও বেশি পুণ্যজনক? সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.)! সেটা কোন আমল? প্রিয় নবী (সা.) বললেন, মহীয়ান-গরিয়ান আল্লাহ পাকের জিকির।
فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ وَاشْكُرُواْ لِي وَلاَ تَكْفُرُونِ
তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদের স্মরণ রাখব অর্থাৎ তোমরা যদি আমার হুকুমের মাধ্যমে আমাকে স্মরণ করো। আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর অকৃতজ্ঞ হয়ো না। (সূরা বাকারা, আয়াত নং ১৫২)
الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىَ جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ
যাঁরা দাঁড়িয়ে, বসে, ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা গবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষয়ে।(সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং ১৯১)
অর্থাৎ সর্বদা যারা আল্লাহকে স্মরণ করে, তার জিকিরে মশগুল থাকে, তারাই বুদ্ধিমান এবং তার প্রিয় বান্দা। এতে বোঝা যায়, সেসব লোকই বুদ্ধিমান যারা আল্লাহকে সর্বাবস্থায় সর্বক্ষণ স্মরণ করেন।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَن ذِكْرِ اللَّهِ وَمَن يَفْعَلْ ذَلِكَ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ
হে মোমিনরা! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদের আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল না করে। যারা এ কারণে গাফেল হয় তারা ক্ষতিগ্রস্ত। (সূরা মুনাফিকুন, আয়াত নং ৯)
যেসব বিষয় মানুষকে দুনিয়াতে আল্লাহ থেকে গাফেল করে, এর মধ্যে প্রধান দুটি হলো ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি। কিন্তু সর্বদা খেয়াল রাখতে হবে, এসব বস্তু যেন মানুষকে আল্লাহর স্বরণ থেকে গাফেল না করে। যারা গাফেল হবে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত। এক ব্যক্তি প্রিয় নবী (সা.)-এর কাছে আরজ করল যে, ইসলামের আমল তথা ওয়াজিব তো অসংখ্য। আপনি আমাকে এমন একটি সংক্ষিপ্ত অথচ সবকিছু অন্তর্ভুক্তকারী আমলের কথা বলে দিন, যা সুদৃঢ়ভাবে উত্তমরূপে হৃদয়ঙ্গম করে নিতে পারি। প্রিয় নবী (সা.) বললেন, তোমার জবান যেন সর্বদা আল্লাহর জিকিরে তরতাজা থাকে। (মুসনাদে আহমদ, ইবনে কাসির)।
মৃত লোকদের মধ্যে জীবিত মানুষের যে অবস্থা, শুষ্ক তৃণলতার মধ্যে সতেজ-সবুজ বৃক্ষ যেমন, মোহমুগ্ধ ও গাফেল লোকদের মধ্যে আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণকরী ব্যক্তির অবস্থা ঠিক তেমনি। প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেন, ‘আল্লাহর জিকিরকারী জীবিত লোকের মতো এবং জিকির থেকে গাফেল ব্যক্তি মৃত লোকের মতো।
প্রিয় নবী (সা.) প্রায় বলতেনঃ ‘প্রত্যেক বস্তু পরিষ্কার করার যন্ত্র রয়েছে, আর অন্তরকে পরিষ্কার ও পবিত্র করার যন্ত্র হলো জিকির। আল্লাহর জিকির অপেক্ষা তার আজাব থেকে অধিক মুক্তিদাতা আর কোনো ইবাদত নেই।’ হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেন, ‘শয়তান আদম সন্তানের কলবের ওপর জেঁকে বসে, যখন সে আল্লাহ পাকের স্মরণ করে তখনই সরে যায়। আর যখন সে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল হয়ে যায়, তখন শয়তান তার দিলে ওয়াসওয়াসা (কুমন্ত্রণা) দিতে থাকে।
জিকির শয়তানের জন্য দাহ। জিকির করলে এ তাপদাহে সে জ্বলে যায় বলেই বনি আদমের অন্তর থেকে সরে যায়। পক্ষান্তরে জিকির বিহীন অবস্থা শয়তানের জন্য আরামদায়ক। কাজেই সে বসে থাকে। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, ‘প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেছেন, তোমরা বেহেশতের বাগিচায় পৌঁছে তার ফল ভক্ষণ করবে।’ সাহাবা কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.)! বেহেশতের বাগিচা কী? উত্তরে প্রিয় নবী (সা.) বললেন, জিকিরের মজলিস।
জান্নাত হলো পবিত্র জায়গা সেখানে ঈর্ষা, মোহ, হিংসা-বিদ্বেষ থাকবে না। তদ্রূপ দুনিয়ায় মানুষ যখন জিকিরের মজলিসে বসে তখন সেখানে ওইসব জিনিস থাকে না। এজন্যই জিকিরের মজলিসকে জান্নাতের বাগান বলা হয়েছে।
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا
আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, যারা ঈমানদার, তারা এমন যে, যখন আল্লাহর নাম স্মরণ করা হয়, তখন তাদের অন্তর ভীত হয়ে পড়ে। আর যখন তাদের সামনে পাঠ কার হয় কালাম, তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায়। (সূরা আনফাল, আয়াত নং ২)
অর্থাৎ তাদের সামনে যখন আল্লাহর স্মরণ করা হয়, তখন তাদের অন্তর ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে এবং আল্লাহ তায়ালার মহব্বত ও প্রেমে ভরপুর হয়ে যায়। কোরআনুল কারিমের অন্য স্থানে খোদাপ্রেমীদের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে, বলা হয়েছে, হে নবী (সা.) সুসংবাদ দিয়ে দিন সেসব বিনয়ী কোমল প্রাণ লোকদের, যাদের অন্তর তখন ভীতসন্ত্রন্ত হয়ে ওঠে, যখন তাদের সম্মুখে আল্লাহ তায়ালার স্মরণ করা হয়।’ আয়াতে যে ভয়ভীতির কথা বলা হয়েছে, তা মনের প্রশান্তি ও স্বস্তির পরিপন্থী নয়, যেমন- হিংস্র জীবজন্তু কিংবা শত্রুর ভয় মানুষের মনের শান্তিকে ধ্বংস করে দেয়। আল্লাহর জিকিরের দরুন অন্তরে সৃষ্ট ভয় তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা কারণ।
الَّذِينَ آمَنُواْ وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُم بِذِكْرِ اللّهِ أَلاَ بِذِكْرِ اللّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ
যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর যিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রাখ, আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়।(সূরা রাদ, আয়াত নং ২৮)
হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী (সা.) বলেন, সর্বোত্তম জিকির হলো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু। আল্লাহ সার্বক্ষণিক জিকির আল্লাহ তায়ালাকে সন্তুষ্ট করে, শয়তানকে পরাভূত করে, দুশ্চিন্তা দূর করে, অন্তরে শান্তি সৃষ্টি করে, শরীর ও কলবকে শক্তিশালী করে, আল্লাহর ভয়ভীতি ও ভালোবাসা অর্জনে সহায়তা করে। আর জিকির হলো দ্বীন ইসলামের রূহ তথা মৌলিক প্রাণশক্তি। জিকির দ্বারা মহান আল্লাহ তায়ালা অন্তরের ময়লা দূর করে ঈমানি নূর দান করেন।
মহান আল্লাহ তায়ালার আরও নিকটবর্তী হওয়ার মাধ্যম হলো তাসবিহ তাহলিল পাঠ করা।
সুতরাং আমাদের উচিত আমরা যেন সর্বদা খোদার যিকর করাতে নিজেকে নিয়োজিত রাখি।
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন