অলৌকিক জ্ঞানের অধিকারী ইমাম মোহাম্মাদ তাক্বি (আ.)
হজরত ইমাম মোহাম্মাদ তাক্বি (আ.)'র অলৌকিক জ্ঞান
ইমাম জাওয়াদ (আ.) এর পিতা ইমাম রেজা (আ.)'র শাহাদতের পর তিনি মাত্র ৮ বছর বয়সে ইমামতের দায়িত্ব পান এবং ১৭ বছর এই পদে দায়িত্ব পালনের পর মাত্র ২৫ বছর বয়সে শাহাদত বরণ করেন। তাঁর জন্ম হয়েছিল আজ হতে ১২৪০ চন্দ্রবছর আগে ১৯৫ হিজরির এই দিনে (১০ই রজব) পবিত্র মদীনায়। আহলে বাইতের অন্য ইমামগণের মত ইমাম জাওয়াদ (আ.)ও ছিলেন উচ্চতর নৈতিক গুণ, জ্ঞান ও পরিপূর্ণতার অধিকারী। তাক্বি বা খোদাভীরু ছিল তাঁর আরেকটি উপাধি।
ইমাম জাওয়াদ (আ) মাত্র আট বছর বয়সে ইমামতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এতো অল্প বয়সে তাঁর ইমামতিত্বের বিষয়টি ছিল যথেষ্ট বিস্ময়কর। ফলে অনেকেই এ বিষয়ে সন্দেহ করতেন। অথচ আল্লাহর তো এই শক্তি আছে যে তিনি মানুষকে তার বয়সের স্বল্পতা সত্ত্বেও পরিপূর্ণ বিবেক-বুদ্ধির পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেন। কোরানের আয়াতের ভিত্তিতে পূর্ববর্তী উম্মাতের মধ্যেও এরকম উদাহরণ বহু আছে। যেমন শিশুকালে হযরত ইয়াহিয়া (আ) এর নবুয়্যত প্রাপ্তি, মায়ের কোলে নবজাতক ঈসা (আ) এর কথা বলা ইত্যাদি আল্লাহর সবর্শক্তিমান ক্ষমতারই নিদর্শন।
ইমাম জাওয়াদ (আ) শৈশব-কৈশোরেই ছিলেন জ্ঞানে-গুণে, ধৈর্য ও সহনশীলতায়, ইবাদাত-বন্দেগিতে, সচেতনতায়, কথাবার্তায় শীর্ষস্থানীয় মহামানব। একবার হজের সময় বাগদাদ এবং অন্যান্য শহরের বিখ্যাত ফকীহদের মধ্য থেকে আশি জন মদীনায় ইমাম জাওয়াদ (আ) এর কাছে গিয়েছিলেন। তাঁরা ইমামকে বহু বিষয়ে জিজ্ঞেস করে অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত ও সন্তোষজনক জবাব পেলেন। ফলে জাওয়াদ (আ) এর ইমামতিত্বের ব্যাপারে তাদের মনে যেসব সন্দেহ ছিল-তা দূর হয়ে যায়।
ইমাম জাওয়াদ (আ) বড়ো বড়ো পণ্ডিতদের সাথে এমন এমন তর্ক-বাহাসে অংশ নিতেন যা ছিল রীতিমতো বিস্ময়কর। একদিন আব্বাসীয় খলিফা মামুন ইমাম জাওয়াদ (আ) এর জ্ঞানের গভীরতা পরীক্ষা করার জন্যে একটি মজলিসের আয়োজন করে। সেখানে তৎকালীন জ্ঞানী-গুণীজনদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ঐ মজলিসে তৎকালীন নামকরা পণ্ডিত ইয়াহিয়া ইবনে আকসাম ইমামকে একটি প্রশ্ন করেন। প্রশ্নটি ছিল এই: যে ব্যক্তি হজ পালনের জন্যে ইহরাম বেঁধেছে, সে যদি কোনো প্রাণী শিকার করে,তাহলে এর কী বিধান হবে? ইমাম জাওয়াদ (আ) এই প্রশ্নটিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে মূল প্রশ্নের সাথে সংশ্লিষ্ট ২২টি দিক তুলে ধরে উত্তরের উপসংহার টানেন। উত্তর পেয়ে উপস্থিত জ্ঞানীজনেরা অভিভূত হয়ে যান এবং ইমামের জ্ঞানগত অলৌকিক ক্ষমতার প্রশংসাও করলেন।
একটি বর্ণনামতে পুরো ঘটনা ছিল এ রকম:
খলিফা মামুন যখন সিদ্ধান্ত নিল নিজ কন্যা উম্মুল ফযল কে আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে আলী আল রেযা তথা ইমাম জাওয়াদ (আ.) এর সাথে বিবাহ দিবেন তখন তার নিকট আত্মীয়রা তাকে এ কাজে বাধা দেয়ার জন্য বললেন : আপনার কন্যা ও নয়নের মণিকে আপনি এমন এক শিশুর সাথে বিবাহ দিচ্ছেন যার এখনো আল্লাহর দ্বীনে জ্ঞান চক্ষু ফোটেনি, যে দ্বীনের হালাল হারাম ও মুস্তাহাব ওয়াজিবকে এখনো চেনে না, (নবম ইমামের বয়স সে সময় নয় বছর ছিল) সুতরাং যদি কিছুদিন অপেক্ষা করতেন যাতে জ্ঞান ও শিষ্টাচার শিখে নিত এবং কোরআন পাঠ করতো, হালাল ও হারামকে বুঝতো। মামুন বললেন : আল্লাহ সম্পর্কে ও তাঁর রাসুলের (সা.) সুন্নাত আর হুকুম আহকামের ক্ষেত্রে সে এখনো তোমাদের চেয়ে বেশি পণ্ডিত ও জ্ঞানী। সে তোমাদের চেয়ে আল্লাহর কোরআনকে উত্তমরূপে পড়ে ও জানে এর মুহকাম ও মুতাশাবিহ, নাসেখ ও মানসুখ, যাহের ও বাতেন, খাস ও আম, তানযীল ও তাবীল সব বিষয়ে তোমাদের চেয়ে বেশি জ্ঞানী। তাকে প্রশ্ন করো। যদি ব্যাপার এমন হয় যেমনটা তোমরা বলছ, তাহলে তোমাদের কথা মেনে নিব।
তারা সেখান থেকে চলে গেল এবং ইয়াহিয়া ইবনে আকসামের কাছে গেল যে সে সময়ে ছিল প্রধান বিচারপতি। তারা তার কাছে তাদের দরকারি কথাটি বললো এবং তাকে নানা উপঢৌকনের প্রলোভন দেখালো যাতে আবু জাফর (আ.) তথা শিশু ইমাম জাওয়াদের মোকাবেলায় উপায় খুঁজে বের করে। তারা তাঁকে এমন এক মাসআলা জিজ্ঞেস করতে বলল যার উত্তর তাঁর জানা না থাকে।
যখন সবাই উপস্থিত হলো এবং নবম ইমামও উপস্থিত হলেন, তারা বাদশাহ মামুনকে বললো : এ হলো বিচারপতি। যদি অনুমতি দেন, তিনি প্রশ্ন করবেন! মামুন বললেন : হে ইয়াহিয়া! একটি ফেকহি মাসআলা আবু জাফরের কাছে জিজ্ঞেস করো যাতে বুঝতে পারো তার ফেকাহর জ্ঞান কোন্ স্তরে।
ইয়াহিয়া বললেন : হে আবু জাফর! আল্লাহ তোমাকে কল্যাণ দিন। (হজের সময় পশু শিকার নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও) ইহরাম পরিধানকারী বা সেই ইহরামকারীর ব্যাপারে তোমার বক্তব্য কি যে কোন শিকার হত্যা করেছে তথা পশু শিকার করেছে? ইমাম বললেন : শিকারটিকে হিল্লা এ (হারামের বাইরে) হত্যা করেছে নাকি হারামের (কাবার চারপাশের নিষিদ্ধ সীমার) মধ্যে? সে মাসআলা জানতো নাকি অজ্ঞ ছিল? ইচ্ছা করে হত্যা করেছে নাকি ভুলবশত? সে ইহরামকারী গোলাম ছিল নাকি আজাদ (মুক্ত)? ছোট (অপ্রাপ্তবয়স্ক) ছিল নাকি বড়? এটা তার প্রথম শিকার ছিল নাকি ইতোপূর্বেও সে শিকার করেছিল? শিকারটি কি পাখী ছিল নাকি অন্য কিছু? ছোট পাখী ছিল নাকি বড় পাখী? ইহরামকারী কি পুনরায় শিকার করার জেদ পোষণ করে নাকি অনুতপ্ত? এ শিকার রাতের বেলায় পাখীদের বাসা থেকে ছিল নাকি দিনের আলোয় প্রকাশ্যে? ইহরাম হজের জন্যে বেঁধে ছিল নাকি ওমরাহর জন্যে? বলা হয় যে ইয়াহিয়া এমনভাবে হতভম্ব হয়ে গেল যে সবার কাছে তা প্রকাশ হয়ে পড়লো। সবাই নবম ইমামের মাথা ঘুরে আসা উত্তরে বিস্মিত হয়ে গেল।
মামুন ঐ মজলিসেই নবম ইমামের কাছে নিজের কন্যাকে বিয়ে দেন ও বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন এবং বিশিষ্টজন, আত্মীয়-স্বজন, সাধারণ লোক, অভিজাত ও কর্মচারী সকলকেই পদবী অনুসারে উপহার দিয়েছিলেন।
যখন বেশিরভাগ লোক চলে গেল তখন মামুন বললেন : হে আবা জাফর! যদি আমাদেরকে বলে দিতে এই সব ধরনের শিকারের জন্য কি কি কাজ করা বা কাফফারা দেয়া ওয়াজিব হয়? উত্তরে ইমাম (আ.) বললেন : ইহরামকারী যখন হিল্লা-এ (হারামের বাইরে) শিকারকে হত্যা করে আর শিকারটি হয় বড় প্রজাতির পাখী বিশেষ তাহলে তার ওপর ওয়াজিব হল একটি দুম্বা। আর যদি তাকে হত্যা করে হারামের মধ্যে তাহলে তার কাফফারা হবে দ্বিগুণ। আর যদি কোন পক্ষী-ছানাকে হিল্লা-এ হত্যা করে তাহলে তার কাফফারা হলো সদ্য দুধ ত্যাগ করা একটি মেষ-শাবক। তার ওপর মূল্য ওয়াজিব নয় এবং যেহেতু এটা হারামের মধ্যে ঘটেনি। আর যদি হারামের সীমার মধ্যে হয়ে থাকে তাহলে মেষ-শাবক ও ছানার মূল্য দুটোই তার ওপর ওয়াজিব হবে। আর যদি সে শিকার কোন বন্যপ্রাণী হয়ে থাকে তাহলে জেব্রা হলো একটি গরু, আর উটপাখী হলে একটি উট কাফফারা দিতে হবে। আর যদি সক্ষম না হয় তাহলে ৬০ জন গরীবকে খাবার দিবে। আর যদি তাও না পারে তাহলে ১৮ দিন রোযা রাখবে। আর শিকার যদি গরু হয় তাহলে তার কাফফারা হবে একটি গরু। যদি সক্ষম না হয় তাহলে ৩০ জন মিসকিনকে খাবার দিবে। যদি তাও না পারে তাহলে ৯ দিন রোজা রাখবে। আর যদি হরিণ হয় তাহলে একটি দুম্বা তার ওপর ওয়াজিব হবে। যদি সক্ষম না হয় তাহলে ১০ জন মিসকিনকে খাওয়াবে। যদি তাও না পারে তাহলে ৩ দিন রোজা রাখবে। আর যদি হারামের সীমায় তাকে শিকার করে থাকে তাহলে কাফফারা হবে দ্বিগুণ এবং সেটা কাবায় পৌছাতে হবে ও কুরবানি করতে হবে। এটা হলো ওয়াজিব হক। যদি হজের ইহরামে থাকে তাহলে কাফফারাকে মিনায় জবেহ করবে যেখানে কুরবানি করার জায়গা রয়েছে। আর যদি ওমরাহর ইহরামে থাকে তাহলে মক্কায় এবং কাবার কাছে। আর তার মূল্যের পরিমাণে সদকাও প্রদান করবে যাতে দ্বিগুণ হয়।
তদ্রূপ যদি কোন খরগোশ বা শিয়ালকে শিকার করে, তার ওপরে একটি দুম্বা ওয়াজিব হবে এবং তার মূল্যের পরিমাণে সদকাও প্রদান করবে। আর যদি হারাম শরীফের সীমায় কোন কবুতরকে হত্যা করে তাহলে এক দেরহাম সদকা প্রদান করবে এবং আরেক দেরহাম দ্বারা খাদ্য ক্রয় করবে হারামের অন্যান্য কবুতরদের জন্যে। আর যদি হারাম ছাড়া অন্য স্থানের হয়ে থাকে তাহলে অর্ধ দেরহাম। আর যদি ডিম হয়ে থাকে তাহলে সিকি দেরহাম। আর ইহরামকারী কোন বরখেলাফ কাজ যদি অজ্ঞতাবশত কিংবা ভুলক্রমে করে থাকে তাহলে কাফফারা নেই কেবল ঐ শিকার ব্যতীত যার কাফফারা রয়েছে, অজ্ঞ থাকুক আর জানা থাকুক, ভুলক্রমে হয় আর ইচ্ছাকৃতভাবে হোক। আর দাস যদি কোন বরখেলাপ করে তাহলে তার কাফফারা পুরোপুরি তার মনিবের ওপরে। আর নাবালেগ শিশু কোন বরখেলাপ করলে তার ওপরে কিছু বর্তাবে না, আর যদি তার দ্বিতীয় বার শিকারের ঘটনা হয় তাহলে আল্লাহ তার থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন। আর ইহরামকারী যদি অন্যকে শিকার দেখিয়ে দেয় এবং সে তাকে হত্যা করে তাহলে তার ওপর কাফফারা নেই। আর যে জেদ করে ও তওবা করেনি তার জন্যে দুনিয়ায় কাফফারার পরে পরকালেও রয়েছে শাস্তি। আর যদি অনুতপ্ত হয় তাহলে দুনিয়ার কাফফারার পরে পরকালে শাস্তি নেই। যদি রাত্রে পাখির বাসা থেকে ভুলক্রমে শিকার করে থাকে তাহলে তার কোনো কাফফারা নেই, যদি না তার মনে শিকারের সংকল্প থাকে। আর যদি ইচ্ছাকৃতভাবে শিকার করে থাকে তাহলে দিনে হোক আর রাতে হোক তার ওপরে কাফফারা বর্তাবে। আর যে হজের জন্যে ইহরাম বেঁধেছে তার উচিত কাফফারাকে মক্কায় কুরবানি করবে।
মামুন নবম ইমাম (আ.) থেকে এ বিধানগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখার নির্দেশ দেন। এরপর তার পরিজনদের দিকে ফিরলেন যারা ইমাম (আ.) এর সাথে রাজকন্যার বিয়ের বিরোধী ছিল, তারপর বললেন : তোমাদের মধ্যে কেউ কি ছিল যে এরূপ উত্তর দিবে? তারা বললো : খোদার কসম! না। বিচারপতিরও সে সাধ্য ছিল না। তখন বলল : আপনি তার বিষয়ে আমাদের চেয়ে বেশি অবগত। মামুন বললেন : ধিক্ তোমাদের! জান না যে এই পরিবারের সদস্যরা অন্যান্য লোকদের শ্রেণীভুক্ত নয়, জান না যে রাসুলুল্লাহ (সা.) হাসান ও হুসাইন (আ.) যখন শিশু ছিলেন তখন তাদের বাইয়াত গ্রহণ করেছিলেন! অন্য কোন শিশুর বাইয়াত গ্রহণ করেন নি? জান না যে তাদের পিতা আলী (আ.) নয় বছর বয়সে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর প্রতি ঈমান এনেছিলেন এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর ঈমানকে গ্রহণ করেছিলেন, অন্য কোন শিশুর থেকে গ্রহণ করেননি এবং অন্য কোন শিশুকে ইসলামের প্রতি দাওয়াত করেননি? জান না যে এরা একে অপরের বংশোদ্ভূত, এদের শেষের জন্য হুকুম সেটাই প্রথমের জন্যে যা?
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন