ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আ) জ্ঞানের বিকাশ দানকারী
ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আ) জ্ঞানের বিকাশ দানকারী
ইসলামের পঞ্চম পথ প্রদর্শক,আধ্যাত্মিকতার অন্যতম পুরোধা,ইমাম আবু জা’ফর,৫৭ হিজরীর রজব মাসের ১ তারিখে শুক্রবার মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন।১ তাঁর নাম মুহাম্মদ,কুনিয়া আবু জা’ফর ও উপাধি বাকেরুল উলুম (জ্ঞানের বিকাশদানকারী)।
চাঁদের চতুর্দিকে অনেক সময় যে আলোকবৃত্ত পরিদৃষ্ট হয় এই শিশুর জন্মের সময় তাঁর নুরের ছটাও তদ্রুপ তার পরিবারের সকলকে বেষ্টন করেছিল এবং অন্যান্য ইমামগণের ন্যায় তিনিও পাক-পবিত্র অবস্থায় দুনিয়ায় আসেন।
ইমাম বাকের (আ.) বংশীয় ভাবে পিতা ও মাতা উভয়ের দিক দিয়েই নবী (সা.),আলী (আ.) ও ফাতেমা (সা.)-এর সাথে সম্পৃক্ততা রাখেন। কেননা তাঁর পিতা ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) ইমাম হুসাইন (আ.)-এর সন্তান এবং তাঁর মাতা সম্মানিতা নারী ‘উম্মে আবদুল্লাহ্’২ ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.)-এর কন্যা।
ইমাম বাকের (আ.)-এর মহত্ব ও ব্যক্তিত্বের কথা সকল স্তরের মানুষের মুখে মুখে ছিল,যেখানেই হাশেমী,ফাতেমী ও আলী বংশের মান-মর্যাদা নিয়ে কথা উঠতো সেখানেই তাঁকে ঐ সকল পবিত্রতার,সাহসিকতার ও মহানুভবতার একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে স্মরণ করতো এবং হাশেমী,আলাভী ও ফাতেমী হিসেবে চিনতো। সত্যবাদিতা,চেহারায় আকর্ষণ ও অধিক উদারতা তার বৈশিষ্ট্যগুলির অন্যতম।
এখানে আমরা তাঁর মহান ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার ব্যাপারে কিছু জানবো :
মহানবী (সা.) তাঁর এক মহান সাহাবীকে (জাবির বিন আবদুল্লাহ্ আনসারী) বলেছিলেন : হে জাবির! তুমি আমার সন্তান ‘মুহাম্মদ বিন আলী বিন হুসাইন বিন আলী বিন আবি তালিব’ যার নাম তৌরাতে ‘বাকের’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে তাকে দেখা পর্যন্ত জীবিত থাকবে। যখন তোমার সাথে তাঁর দেখা হবে তাকে আমার সালাম পৌঁছে দিও।
নবী (সা.)-এর ওফাতের পর তার ভবিষ্যত বাণী অনুযায়ী জাবির অনেক দিন জীবিত ছিলেন। একদিন ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.)-এর বাড়ীতে এসে শিশু অবস্থায় ইমাম বাকেরকে দেখে বললেন : কাছে এসো... ইমাম বাকের (আ.) তার কাছে এলে তিনি তাঁকে ফিরে যেতে বললেন. ইমাম ফিরে গেলেন। জাবির তাঁর পবিত্র দেহ ও পথ চলাকে লক্ষ্য করে বললেন : কাবার প্রভূর কসম! অবিকল নবী (সা.)-এর মত দেখতে হয়েছে। তারপর তিনি ইমাম সাজ্জাদকে জিজ্ঞাসা করলেন,এই শিশু কে?
ইমাম বললেন : আমার সন্তান ‘মুহাম্মদ বাকের’' যে আমার পরে ইমাম।
জাবির উঠে দাঁড়ালেন এবং ইমাম বাকের (আ.)-এর পায়ে চুম্বন দিয়ে বললেন : হে নবী (সা.)-এর সন্তান,আপনার জন্য আমার জীবন উৎসর্গিত হোক। আপনার প্রপিতা নবী (সা.)-এর সালাম ও দরুদ গ্রহণ করুন কেননা তিনি আপনাকে সালাম দিয়েছেন।
ইমাম বাকের (আ.)-এর দৃষ্টি মোবারক পানিতে ভরে গেল। তিনি বললেন : সালাম ও দরুদ আমার পিতা নবী (সা.)-এর উপর,যতদিন এই আকাশ মণ্ডলী ও জমিন অবশিষ্ট থাকবে। আর আপনার উপরেও সালাম ও দরুদ হে জাবির। যেহেতু আপনি তাঁর সালামকে আমার কাছে পৌঁছিয়েছেন।৩
ইমামের জ্ঞান
ইমাম বাকের (আ.)-এর জ্ঞানও অন্যান্য ইমামগণের ন্যায় আল্লাহ্ প্রদত্ত ছিল। তাঁদের কোন শিক্ষক ছিল না বা অন্য মানুষদের মত কারো নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেন নি। জাবির বিন আবদুল্লাহ্ প্রতিনিয়ত তাঁর কাছে এসে শিক্ষা লাভ করতেন আর প্রায়ই তাঁকে বলতেন : হে দীন ও দুনিয়ার জ্ঞানের বিকাশ দানকারী! সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি শৈশব থেকেই আল্লাহর দেয়া জ্ঞানে জ্ঞানী। ৪
আবদুল্লাহ্ বিন আতা মাক্কী বলেন : কখনও কোন মনীষীকে কারো কাছে এমন ছোট হতে দেখিনি যতটা ইমাম বাকের (আ.)-এর কাছে তাদেরকে হতে দেখেছি। হাকাম বিন উতাইবাহ্ যিনি সকলের কাছে জ্ঞানের দিক দিয়ে অতি সম্মানের পর্যায়ে ছিলেন,তাকেও ইমামের সামনে শিশুর মত বসে থাকতে দেখেছি। ঠিক একজন বিজ্ঞ শিক্ষকের সামনে ছাত্রের বসে থাকার মত।৫
ইমাম বাকের (আ.)-এর ঐশী ব্যক্তিত্ব এতটা আকর্ষণীয় ছিল যে,জাবির বিন ইয়াযিদ জোফি তাঁর উদ্ধৃতি দিয়ে হাদীস উল্লেখ করতে গিয়ে এমন বলেন : নবিগণের স্থলাভিষিক্ত এবং নবিগণের জ্ঞানের উত্তরসূরী মুহাম্মদ বিন আলী বিন হুসাইন আমাকে এমন বলেছেন...।৬
আবদুল্লাহ্ ইবনে উমরের কাছে এক লোক একটি বিষয়ে প্রশ্ন করলে সে উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়ে ইমামকে দেখিয়ে দিল এবং বলল এই শিশুর কাছে জিজ্ঞেস কর,আর তার দেয়া উত্তরটি আমাকে অবহিত কর। ঐ লোক ইমামের কাছে প্রশ্ন করল এবং তার উপযুক্ত জবাবও পেল। সে আবদুল্লাহ্ ইবনে উমরকে এই জবাব সমন্ধে অবহিত করলে আবদুল্লাহ্ বলেন : তাঁরা এমন বংশের যাদের জ্ঞান আল্লাহ্ কর্তৃক প্রদত্ত।৭
আবু বাসির বলেন : ইমাম বাকের (আ.)-এর সাথে মদীনার মসজিদে প্রবেশ করলাম। লোকজন যাওয়া-আসার মধ্যে ছিল। ইমাম আমাকে বললেন : সবার কাছে জিজ্ঞেস কর আমাকে কি তারা দেখতে পাচ্ছে? যার কাছেই জিজ্ঞেস করলাম,তার কাছ থেকেই না সূচক জবাব পেলাম। কিন্তু ইমাম আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। ঠিক ঐ সময় ইমামের এক ঘনিষ্ঠ সাহাবী (আবু হারুন) যে কিনা অন্ধ ছিল মসজিদে প্রবেশ করল। ইমাম বললেন : তার কাছেও জিজ্ঞেস কর।
আবু হারুনের কাছেও জিজ্ঞাসা করলাম : তুমি কি আবু জা’ফারকে দেখেছো?
সে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল : তবে তিনি কি তোমার পাশে দাঁড়িয়ে নেই?
বললাম : কিভাবে বুঝলে?
বলল : কেন বুঝতে পারব না,তিনি তো দীপ্তমান নুরের শিখা। সূর্যের আলোর ন্যায় উজ্জ্বল।৮
আবু বাসির আরও বলেন : ইমাম বাকের (আ.) তাঁর এক আফ্রিকান অনুসারী রাশেদের এর ব্যাপারে জানতে চাইলেন। কেউ তার জবাবে বলল ভাল আছে এবং আপনাকে সালাম দিয়েছে।
ইমাম : তার উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক।
সে আশ্চর্য হয়ে বলল : তবে কি সে মারা গেছে?
ইমাম : হ্যাঁ।
ঐ ব্যক্তি : কখন মারা গেছে?
ইমাম : তুমি তার কাছ থেকে চলে আসার দুই দিন পর।
ঐ ব্যক্তি : আল্লাহর কসম! সে অসুস্থ ছিলনা...।
ইমাম : তবে কি যারা মারা যায় সবাই অসুস্থতার কারণে?
তখন আবু বাসির ইমামের কাছে তার মৃত্যুর ব্যাপারে প্রশ্ন করল।
ইমাম : সে আমাদের বন্ধু ও অনুসারী ছিল। তোমরা ভেবে নিয়েছো যে তোমাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টি বা মনোযোগ নেই,এটা ঠিক নয়। আল্লাহর কসম! তোমাদের কোন কিছুই আমাদের কাছে গোপন নয়। সুতরাং আমাদেরকে তোমাদের কাছে উপস্থিত মনে করবে। তোমরা নিজেরা ভাল কাজ করার অভ্যাস করবে ও ভালদের সারিতে শামিল হবে। আর যেন ভাল হিসাবেই পরিচিত হও এটাই আমার কাম্য। আমি আমার সন্তানদের ও অনুসারীদেরকে এই কর্মসূচীর প্রতি নির্দেশ দিচ্ছি।৯
একজন হাদীস বর্ণনাকারী বলেন,কুফাতে এক মহিলাকে কোরআন শিক্ষা দিতাম। একদিন তার সাথে রসিকতা করেছিলাম। পরে ইমাম বাকেরকে দেখতে গেলে তিনি বললেন :
যে কেউ (যদিও সে) গোপনে পাপ কাজে লিপ্ত হয় আল্লাহ্ তায়ালা তার দিকে আর কোন খেয়াল রাখেন না। ঐ মহিলাকে কি বলেছো?
এ কথা শুনতেই লজ্জায় আমার মাথা নিচু হয়ে গেল। ইমামের সামনে তওবা করলাম। তিনি বললেন : পুনরাবৃত্তি করো না।১০
ইমামের নৈতিক গুণাবলী
শামের এক অধিবাসী মদীনায় বসবাস করত এবং ইমামের বাড়ীতে প্রায়ই আসা-যাওয়া করত। সে প্রায়ই ইমামকে বলত : পৃথিবীতে তোমার মত আর কারো প্রতি আমার এত বেশি ঘৃণা,বিদ্বেষ বা আক্রোশ নেই। আর তুমি ও তোমার বংশের সাথে ছাড়া অন্য কোন বংশের লোকের সাথে এত শত্রুতা করিনা। আমার বিশ্বাস এটাই যে তোমার সাথে শত্রুতাই হচ্ছে আল্লাহ্,নবী ও মুমিনদের নেতার অনুসরণ। তোমার বাড়ীতে আসা-যাওয়া করি শুধুমাত্র এ কারণেই যে তুমি একজন উত্তম বক্তা,সাহিত্যিক ও মিষ্টভাষী।
এত কিছু বলার পরও ইমাম তার সাথে সদ্ভাব বজায় রেখে কোমল ভাষায় কথা বলতেন। কিছু দিন না যেতেই শামের ঐ অধিবাসী অসুস্থ হয়ে পড়ে। মৃত্যুকে অনুভব করতে পেরে সে জীবনের আশা ছেড়ে দিল। এমতাবস্থায় সে তার শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করল যে,মৃত্যুর পর যেন আবু জা’ফর (ইমাম বাকের) তার জানাযার নামাজ পড়ান।
মধ্যরাতে তার পরিবারের লোকেরা তাকে মৃত অবস্থায় পেল। ফজরের নামাজের সময় তার উকিল মসজিদে এসে ইমামকে নামাজ শেষ করে দোয়ায় বসে থাকতে দেখল। তিনি সর্বদা নামাজের পরে দোয়া ও আল্লাহর জিকির করতেন।
সে বলল : শামের ঐ অধিবাসী মারা গেছে এবং সে তার শেষ ইচ্ছাতে এটাই চেয়েছে যে আপনি যেন তার জানাযার নামাজ পড়ান।
ইমাম : সে মারা গেছে... আমি না আসা পর্যন্ত তাড়াহুড়া করো না।
তিনি দ্বিতীয় বারের মত অজু করে পবিত্র হয়ে দুই রাকাত নামাজ পড়ে হাত তুলে দোয়া করলেন। তারপর সেজদায় গেলেন এবং সূর্য উদয় হওয়া পর্যন্ত সেজদায় রত থাকলেন। তারপর ঐ লোকের বাড়ীতে আসলেন। তার মাথার কাছে বসে তাকে ডাকলেন আর সে ইমামের ডাকে সাড়াও দিল। ইমাম তাকে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে শরবত আনতে বললেন। তার পরিবারের কেউ একজন শরবত আনলে ইমাম ঐ শরবত তার মুখে ঢেলে দিলেন। তার পরিবারের লোকদেরকে তাকে ঠাণ্ডা খাবার দিতে বলে তিনি ফিরে গেলেন।
অল্প সময় পরই সে আরোগ্য লাভ করল এবং ইমামের কাছে এসে বলল : সাক্ষ্য দিচ্ছি যে তুমি মানুষের জন্য আল্লাহর প্রতিনিধি।১১
মুহাম্মদ বিন মুনকাদের (ঐ সময়কার সুফি) বলেন : এক প্রচণ্ড গরমের দিনে মদীনার বাইরে গিয়েছিলাম। ইমামকে ঐ গরমের ভিতরে কাজ করতে দেখলাম। তার শরীর দিয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছিল। তাকে অপমানিত করার উদ্দেশ্যে বললাম : আল্লাহ্ তোমাকে সুস্থ রাখুন। তোমার মতো ব্যক্তিত্ব এই সময়,এই অবস্থায় দুনিয়ার চিন্তায় মগ্ন! যদি এই অবস্থায় তোমার মৃত্যু আসে কি করবে?
ইমাম : আল্লাহর কসম! যদি এ অবস্থায় মৃত্যু আসে তবে তা তাঁর আনুগত্যের মধ্যেই হবে। কারণ আমি এই কাজের মাধ্যমে তোমার ও অন্যদের থেকে অমুখাপেক্ষী রয়েছি। মৃত্যু ঐ সময় ভয়ানক কেউ যখন পাপ কাজে ব্যস্ত থাকবে।
বললাম : আল্লাহর রহমত হোক আপনার উপর। চেয়েছিলাম যে আপনাকে লজ্জিত করব কিন্তু আপনি এই কথা বলে আমাকে লজ্জিত ও সতর্ক করলেন।১২
ইমাম ও উমাইয়্যা খেলাফত
ইমাম গৃহে অবস্থান করুন অথবা সমাজের মধ্যে নেতা হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালন করুন না কেন তার ইমামতের মর্যাদার ক্ষেত্রে কোন তফাৎ হয় না। কেননা ইমামত হচ্ছে রেসালতের অনুরূপ এমন একটি পদ,যা আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত। আর এটা মানুষের হাতে নয় যে তারা তাদের ইচ্ছা মত ইমাম নির্বাচন করবে।
স্বৈরাচারী ও সীমা লংঘনকারীরা সর্বদা ইমামদের মর্যাদার সমকক্ষ হওয়ার চেষ্টা করত। যে কোন উপায়ে ক্ষমতা বা খেলাফতকে যা ইমামগণের বিশেষ অধিকার ছিল তা দখল করার জন্য চেষ্টা করত। আর এসব পাওয়ার আশায় এমন কোন অত্যাচার ছিলনা যে তারা করেনি। যে কোন ধরনের কাজ করতে তাদের কোন ভয়ও ছিলনা।
ইমাম বাকের (আ.)-এর ইমামতকাল ছিল অত্যাচারী উমাইয়্যা শাসক হিশাম বিন আবদুল মালেক এর সমকালীন যুগে। হিশাম ও অন্যান্য উমাইয়্যা শাসকরা ভাল করেই জানতো যে,যদিও অন্যায়ভাবে ও জোরপূর্বক এই ক্ষমতাকে হস্তগত করেছে,তথাপিও এই ক্ষমতা দিয়ে মানুষের অন্তর থেকে নবী (সা.)-এর পরিবারের প্রতি তাদের ভালবাসাকে ছিনিয়ে নেয়া যাবে না।
ইমামগণের আধ্যাত্মিক শান ও মর্যাদার পরিমাণ এত অধিক ছিল যে কারণে সব সময় তাঁর শত্রু ও অবৈধ ক্ষমতা হস্তগতকারীরা ভীতসন্ত্রস্ত থাকত। তাঁর সম্মানে উঠে দাঁড়াত। হিশাম কোন এক বছর হজ করতে যায়। ইমাম বাকের ও ইমাম সাদেকও ঐ বছর হজে গিয়েছিলেন। সে বারে ইমাম সাদেক (আ.) হজের ময়দানে খোৎবা দেন যা ছিল এরূপ :
‘আল্লাহর অশেষ কৃপা যে মুহাম্মদ (সা.)-কে সত্য দীন দিয়ে পাঠিয়েছেন। আর তার উসিলায় আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন। সুতরাং আমরা আল্লাহর পক্ষ হতে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে নির্বাচিত ব্যক্তি। আর দুনিয়াতে তার প্রতিনিধি। মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি তারাই যারা আমাদেরকে অনুসরণ করবে এবং দুর্ভাগা তারাই যারা আমাদের সাথে শত্রুতা করবে।’
ইমাম সাদেক (আ.) হজ থেকে ফেরার অনেক দিন পরে বললেন : আমার বক্তব্যকে হিশামের কাছে পৌঁছানো হয়েছিল। কিন্তু সে কোন প্রতিবাদ না করেই দামেস্কে ফিরে যায়। আমরাও মদীনায় ফিরে আসি। এসে জানতে পারলাম হিশাম তার মদীনার গভর্ণরকে এই মর্মে নির্দেশ দিয়েছে যে,আমরা হজ থেকে ফিরে এলেই আমাদেরকে (আমাকে ও আমার পিতাকে) যেন দামেস্কে পাঠায়।
আমরা দামেস্কে গেলাম। হিশাম তিন দিন পর্যন্ত আমাদেরকে কোন পাত্তাই দিল না। চতুর্থ দিনে তার দরবারে গেলাম। হিশাম সিংহাসনে বসে ছিল এবং দরবারের লোকেরা তার সম্মুখে তীর নিক্ষেপের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। হিশাম আমার বাবাকে তাঁর নাম ধরে ডেকে বলল : এসো তোমার বংশের সম্মানিত ব্যক্তিদের সাথে প্রতিযোগিতা কর।
আমার বাবা বললেন : আমার বয়স হয়েছে,তীর নিক্ষেপের প্রতিযোগিতা করার বয়সও চলে গেছে,আমাকে একাজ থেকে বিরত রাখ। হিশাম অনেক চাপাচাপি করল এবং এক প্রকার তাঁকে বাধ্যই করল এই কাজ করার জন্য। সে উমাইয়্যা বংশের এক বৃদ্ধকে তার তীর ধনুকটি বাবাকে দিতে বলল। বাবা ধনুকটি নিয়ে তাতে তীর লাগিয়ে লক্ষ্য বস্তুর দিকে ছুঁড়লেন। প্রথম তীরটি ঠিক লক্ষ্য বস্তুর মধ্যখানে গিয়ে বিদ্ধ হল। দ্বিতীয়টি প্রথমটির পশ্চাৎভাগে গিয়ে বিধলো এবং প্রথম তীরটিকে বিভক্ত করে ফেললো। তৃতীয়টি দ্বিতীয়টি,চতুর্থটি তৃতীয়টি,পঞ্চমটি চতুর্থটি,.... এভাবে নবমটি অষ্টমটির পশ্চাৎভাগে বিধলো,উপস্থিত সবাই চিৎকার ধ্বনি দিয়ে উঠলো। হিশাম হতভম্ব হয়ে চিৎকার দিয়ে বলল : সাবাস আবু জা’ফর! তুমি আরব ও অনারবদের মধ্যে তীর নিক্ষেপে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। তুমি কেমন করে ভাবলে যে তোমার তীর নিক্ষেপের বয়স শেষ হয়ে গেছে? ... এ কথাগুলি যখন বলছিল ঠিক তখনই মনে মনে বাবাকে হত্যার পরিকল্পনা করল। মাথা নিচের দিকে দিয়ে চিন্তায় মগ্ন ছিল। আর আমরা তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইলাম। আমরা অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। তার এ কাজের কারণে বাবা ভীষণ রেগে গেলেন। তিনি অতিরিক্ত রেগে যাওয়াতে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কিন্তু তার রাগান্বিত ভাবটি চেহারায় ফুটে উঠেছিল। হিশাম তার রাগান্বিত হওয়াটা বুঝতে পেরে আমাদেরকে তার সিংহাসনের দিকে যাওয়ার ইশারা করল। আমরা তার দিকে অগ্রসর হতেই সে নিজে উঠে দাঁড়িয়ে বাবাকে ধরে তার ডান পাশে অবস্থিত আসনে ও আমাকে বাবার ডান পাশে রাখা আরেকটি আসনে বসালো। তারপর সে আমার বাবার সাথে কথা বলতে শুরু করল : কুরাইশ বংশের গর্ব যে তোমার মত লোক তাদের মধ্যে আছে। সাবাস তোমাকে। এমন নিখুঁত তীর নিক্ষেপ কোথা থেকে এবং কত সময় ধরে শিখেছো?
বাবা বললেন : তুমি তো জানো যে মদীনাবাসীদের তীর নিক্ষেপে বিশেষ দক্ষতা আছে। আর আমি যুবক বয়সের কিছু সময় এটা শেখার কাজে লিপ্ত ছিলাম। পরে আর এটার চর্চা করিনি,যা আজ এতদিন পরে তুমি করতে বললে।
হিশাম : যেদিন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকে এমন তীর নিক্ষেপ আর কখনও কোথাও দেখিনি। আমি মনে করি না যে এই পৃথিবীতে কেউ আর তোমার মত এভাবে তীর নিক্ষেপ করতে পারে। তোমার ছেলে জা’ফরও কি তোমার মতই তীর নিক্ষেপ করতে পারে?
বাবা বললেন : আমরা পূর্ণতার বিষয়সমূহ উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। যে পরিপূর্ণতা ও সম্পূর্ণতাকে আল্লাহ্ তাঁর নবীকে দিয়েছিলেন,যেমন আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে বলেছেন :
) اَليَومَ اَكمَلتُ لَكُم دِينَكُم و اَتمَمتُ عَلَيكُم نِعمَتي و رَضيتُ لَكُم الاِسلامَ دِيناً(
“আজ তোমাদের দীনকে আমি সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি নেয়ামত পরিপূর্ণ করলাম আর ইসলামকে তোমাদের মনোনীত দীন হিসাবে গ্রহণ করলাম।”১৩
আর যারা এ ধরনের কাজে পারদর্শী তাদের থেকে পৃথিবী কখনও দূরে থাকে না।
এই বাক্যগুলি শোনার সাথে সাথে হিশামের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। অতিরিক্ত রাগের কারণে তার চেহারা লাল হয়ে গেল। কিছু সময়ের জন্য মাথা নিচু করে থাকার পরে পুনরায় মাথা তুলে বলল : তবে কি তোমরা ও আমরা সম্মানিত ও অভিজাত একই বংশের (আবদে মানাফ) নই,তার সঙ্গে সম্পর্কের দিক দিয়ে আমরা একে অপরের সমান নই?
ইমাম : হ্যাঁ,কিন্তু আল্লাহ্ আমাদেরকে বিশেষত্ব দিয়েছেন যা অন্য কাউকে দেন নি।
জিজ্ঞেস করল : তাহলে কি আল্লাহ্ নবী (সা.)-কে আবদে মানাফ এর বংশে সকল মানুষের উদ্দেশ্যে পাঠায় নি? তুমি কিভাবে এই জ্ঞানকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছো নবী (সা.)-এর পর আর কোন নবী আসে নি আর তোমরা তো নবীও নও ?
ইমাম : আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে তার নবীকে বলেছেন :
) لاَ تُحَرِّك بِهِ لِسَانَكَ لِتَعجَلَ بِهِ(
-“(হে নবী!) তোমার জিহ্বাকে কিছু বলার জন্য নাড়িও না যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমার উপর ওহী নাজিল হয়। ১৪”
এই আয়াত অনুযায়ী নবী (সা.)-এর কথা ওহী বৈ অন্য কিছুই নয়। এ বিশেষত্ব আমাদেরকে দিয়েছেন যা অন্যদেরকে দেননি। আর এ কারণেই তিনি তার ভাই আলী (আ.)-এর সাথে গোপন সবকিছু বলতেন যা অন্য কাউকে কখনও বলতেন না। আল্লাহ্ এ ব্যাপারে বলছেন :
) وَ تَعِيَهَا اُذُنٌ واعِيَةُ(
-“আর অধিক ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন কান তা ধারণ করবে।১৫ ”
আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) আলী (আ.)-কে বললেন : গোপন সকল বিষয় তোমাকে অবহিত করার জন্য আল্লাহর কাছে অনুমতি চেয়েছিলাম তখন ঐ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় ও আমি আলীর জন্য এ প্রার্থনা করেছিলাম। আর সে কারণেই আলী বিন আবি তালিব (আ.) কুফায় বলেছিলেন : রাসূলুল্লাহ্ আমার জন্য এক হাজারটি জ্ঞানের দ্বার উন্মোচন করেছেন যার প্রতিটি দ্বার থেকে আবার হাজারটি দ্বার উন্মোচিত হয়... যেমনভাবে মহান আল্লাহ্ রাসূল (সা.)-কে বিশেষ পরিপূর্ণতা দিয়েছেন ও মনোনীত করেছেন তদ্রুপ রাসূল (সা.) আলী (আ.)-কেও (তাঁর ইচ্ছায়) মনোনীত করেছিলেন এবং এমন কিছু শিখিয়েছেন যা অন্যরা শিখেনি। আর আমাদের জ্ঞান ঐ উৎস বা সূত্র থেকে এসেছে এবং শুধুমাত্র আমরাই উত্তরাধিকারী হিসাবে পেয়েছি না অন্যরা।
হিশাম : আলী ইলমে গায়েবের দাবিদার ছিল। কিন্তু আল্লাহ্ এখনও পর্যন্ত কাউকে ইলমে গায়েবের অধিকারী করেন নি।
বাবা : মহান আল্লাহ্ তার নবী (সা.)-এর উপর আসমানী কিতাব পাঠিয়েছেন। যার মধ্যে অতীত,বর্তমান,ভবিষ্যৎ অর্থাৎ কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত কিছুর বর্ণনা করেছেন। কেননা পবিত্র কোরআনে আছে :
) وَ نَزَّلنَا عَلَيكَ الكِتَابَ تِبتاَناً لِكُلِّ شيءٍ(
তোমার কাছে এমন কিতাব (কোরআন) পাঠিয়েছি যা সব বিষয়ের ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা রাখে।১৬
এবং অন্য আরেক জায়গায় এসেছে যে,
) وَ نَكْتُبُ ماَ قَدَّمُوا وَ اَثَارَهُم وَ كُلَّ شَئْيٍ اَحْصَيْنَهُ في اِماَمٍ مُّبِيْنٍ(
এবং সমস্ত কিছুকে কিতাবে (কোরআনে) পরিস্কার ভাবে উল্লেখ করেছি।১৭
এবং অন্য আরেক জায়গায় এসেছে যে,
) ماَ فَرَّطْناَ في الْكِتَبِ مِنْ شَيءٍ (
... এমন কোন কিছু নেই যা এই কিতাবে (কোরআনে) আমরা আনয়ন করি নি।১৮
আর কোরআনের সমস্ত গোপন জ্ঞানকে আলী (আ.)-কে শিখানোর জন্য আল্লাহ্ তায়ালা নবী (সা.)-কে নির্দেশ দিয়েছেন। নবী (সা.) উম্মতের প্রতি বলেছেন : আলী তোমাদের সবার থেকে বিচার কার্যে পারদর্শী...। হিশাম নীরব রইল...। আর আমরা তার দরবার থেকে বেরিয়ে এলাম।১৯
বিরুদ্ধবাদীদের নিকট ইমামের যুক্তি প্রমাণ পেশ
আলী (আ.)-এর আবদুল্লাহ্ বিন নাফে নামক এক শত্রু ছিল। সে বলত যদি এই পৃথিবীর কেউ আমাকে বোঝাতে পারে যে খারেজীদেরকে হত্যা করে আলী সঠিক কাজ করেছে তবে আমি তার পক্ষে যাব। যদিও সে পৃথিবীর পূর্বে ও পশ্চিমে অবস্থান করে।
কেউ তাকে বলল : তুমি কি মনে কর যে আলী (আ.)-এর সন্তানরাও এটাকে প্রমাণ করতে পারবে না?
নাফে : তার সন্তানদের মধ্যে কি কেউ এমন মনীষী আছে যে আমাকে বোঝাতে পারে?
বলল : এটাই তোমার মুর্খতার একটা বড় পরিচয়। আর এটা কি সম্ভব যে আলী (আ.)-এর সম্ভ্রান্ত বংশে কোন মনীষী থাকবে না?
নাফে : এখন তার বংশের মনীষী কে?
ঐ ব্যক্তি তার কাছে ইমাম বাকের (আ.)-এর পরিচয় তুলে ধরল। সে তার সঙ্গী সাথিদের নিয়ে মদীনায় এসে ইমামের সাথে দেখা করার জন্য অনুমতি চাইল...।
ইমাম তার মালামালগুলিকে উটের পিঠ থেকে নিচে নামানোর জন্য এক ভৃত্যকে নির্দেশ দিলেন। আর তাকে পরের দিন ইমামের কাছে উপস্থিত হতে বললেন।
পরের দিন সকালে আবদুল্লাহ্ তার সাথিদের সহ ইমামের বৈঠক খানায় আসল। এদিকে তিনি নিজের সন্তানদের,মুহাজির ও আনসারদের উত্তরসূরীদেরকেও ঐ বৈঠকে উপস্থিত হতে নির্দেশ দিলেন। যখন সবাই সেখানে জমা হলো। ইমামের গায়ে তখন লাল বর্ণের একটি পোশাক ছিল। ফলে তাঁকে দেখতে আকর্ষণীয় ও সুদর্শন লাগছিল। তিনি বললেন : মহান আল্লাহর অশেষ প্রশংসা। যিনি স্থান,কাল,পাত্র সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা। প্রশংসা সেই আল্লাহ্ তায়ালার,যার না নিদ্রা আছে,না নিদ্রার ভাব। আর যা কিছু এই আসমান ও জমিনে আছে তিনি এ সব কিছুরই মালিক...। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি এই যে,আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন মা’বুদ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) সৃষ্টির মধ্য হতে বাছাইকৃত তাঁর বান্দা ও রাসূল। কৃতজ্ঞতা মহান আল্লাহর যিনি তাঁকে নবুওয়াত দান করে আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন। আর আলী (আ.)-কে তাঁর নবী (সা.)-এর খলিফা নিযুক্ত করে আমাদেরকে বিশিষ্ট করেছেন।
হে মুহাজির ও আনসারদের সন্তানেরা! তোমাদের মধ্য থেকে যে যতটুকুই আলী বিন আবি তালিবের মর্যাদা সম্বন্ধে জান বল। উপস্থিতদের মধ্য থেকে একজন আলী (আ.)-এর মর্যাদা ফজিলত বর্ণনা করতে করতে খাইবারের হাদীসে পৌঁছে,বলল : নবী (সা.) খাইবারের ইহুদীদের সাথে যুদ্ধের সময় বলেছিলেন :
(لَاُعْطِيَنَّ الرَّايَةَ غَداً رَجُلاً يُحِبُ اللَّهَ وَ رَسُولَهُ وَ يُحِبُّهُ اللَّهُ وَ رَسُولُهُ,كَرَّاراً غَيْرَ فرَّار لاَ يَرْجِعُ حَتَّى يَفْتَحَ اللَّهُ عَلى يَدَيْهِ )
আগামীকাল ইসলামের পতাকা এমন একজনের হাতে দিব যে আল্লাহ্ ও তাঁর নবীকে ভালবাসে এবং আল্লাহ্ ও তাঁর নবীও তাকে ভালবাসে। যুদ্ধ পারদর্শী যে কখনও যুদ্ধ থেকে পলায়ন করে না এবং আগামীকাল যুদ্ধ থেকে খালি হাতে ফিরে আসবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহ্ তাঁর হাতে ইহুদীদের পরাজয় ঘটান।
পরের দিন ইসলামের পতাকাটিকে আমিরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর হাতে দিলেন। তিনি যুদ্ধে বিস্ময় সৃষ্টি করে ইহুদীদেরকে পরাজিত ও পলায়নে বাধ্য করলেন। আর তাদের বৃহৎ দুর্গের দরজাকে খুলে ফেললেন।
ইমাম বাকের (আ.) আবদুল্লাহ্ বিন নাফেকে বললেন : এই হাদীসের ব্যাপারে তোমার ধারণা কি?
নাফে : হাদীসটি সত্য কিন্তু আলী পরে কাফের হয়ে গিয়েছিল এবং খারেজীদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে।
ইমাম : তোমার জন্য তোমার মাকে ক্রন্দন করা উচিত। আল্লাহ্ যখন আলীকে ভালবাসতেন তখন তিনি কি জানতেন না যে সে খারেজীদেরকে হত্যা করবে? যদি বল আল্লাহ্ জানতেন না কাফের হয়ে যাবে।
নাফে : আল্লাহ্ জানতেন।
ইমাম : আল্লাহ্ তাঁকে কি তাঁর নির্দেশ মেনে চলার জন্য ভালবাসতেন নাকি তাঁর নির্দেশ অমান্য করে চলার কারণে?
নাফে : যেহেতু সে আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলত সে কারণেই আল্লাহ্ তাকে ভালবাসতেন (অর্থাৎ যদি ভবিষ্যতে সে পাপী হয়ে যেত তাও আল্লাহ্ জানতেন এবং কখনও তাকে ভালবাসতেন না,সুতরাং এটা পরিষ্কার যে খারেজীদেরকে হত্যা করা আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যেই হয়েছিল)।
ইমাম : তুমি চলে যাও পরাজিত হয়েছো,কারণ এ ব্যাপারে তোমার কাছে কোন জবাব নেই। আবদুল্লাহ্ উঠে যাওয়ার সময় এই আয়াতটি তেলাওয়াত করল :
) حَتًّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْاَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْاَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ(
যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমাদের না তোমাদের কাছ থেকে সুবহে সাদেকের সাদা রেখা,কাল রেখা হতে পৃথক হয়ে যায়।২০
এ বিষয়টিকে রাতের অন্ধকার ঠেলে দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার দিকে ইশারা করে বলল : আল্লাহ্ই ভাল জানেন যে তাঁর রিসালতের দায়িত্ব কোন পরিবারের উপর ন্যস্ত করবেন।২১
ইমামের নির্দেশে ইসলামী মুদ্রার প্রচলন ২২
হিজরী শতাব্দীর প্রথম দিকে কাগজ শিল্প রোমানদের হাতে ছিল। মিশরের খৃস্টানরাও রোমানদের নীতিকৌশল অবলম্বন করেই কাগজ তৈরী করত। আর তাতে খৃস্টানদের বিশ্বাস অনুযায়ী ত্রিত্ববাদ ইঙ্গিতকারী বিশেষ চিহ্ন সংযোজন করত। উমাইয়্যা শাসক আবদুল মালেক ছিল অতি চালাক প্রকৃতির। এই ধরনের কাগজ দেখে তার উপর সংযোজনকৃত চিহ্নটির ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য নির্দেশ দিল। যখন তার প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারল অত্যন্ত রাগান্বিত হল। এ কারণে যে মিশর একটি ইসলামী রাষ্ট্র। আর এ রাষ্ট্রে ব্যবহৃত শিল্পজাতদ্রব্যে এ ধরনের প্রতীক থাকবে এটা হতে পারে না। সাথে সাথে মিশরের গভর্ণরকে নির্দেশ দিল যে এ ধরনের কাগজগুলিকে নষ্ট করে তার স্থানে তৌহিদের শ্লোগানشَهِدَ اللَّه اَنَّهُ لاَ اِلَهَ الاَّ هُو. সম্বলিত কাগজ তৈরি করতে। আর পার্শ্ববর্তী সব ইসলামী প্রদেশগুলিকেও খৃস্টানদের অংশীবাদী বিশ্বাসের প্রতীক সম্বলিত কাগজ নষ্ট করে ফেলে নতুন কাগজ ব্যবহারের জন্য নির্দেশ পাঠাতে বলল।
তৌহিদী উক্তি সম্বলিত কাগজের ব্যবহার বেশ প্রচার পেল। সেই কাগজ রোমের বিভিন্ন শহরেও পৌঁছাল। এই খবর রোমের সম্রাটের কাছে পৌঁছালে সে আবদুল মালেকের কাছে এ মর্মে একটি চিঠি পাঠাল : কাগজের মুদ্রা সর্বদা খৃস্টানদের প্রতীক সম্বলিত ছিল। তা পাল্টানোর সিদ্ধান্ত যদি তোমার হয়ে থাকে,তাহলে তোমার আগের খলিফারা ভুল করেছে। আর যদি তারা ঠিক করে থাকে তাহলে তুমি ভুল করছো।২৩আমি এই চিঠির সাথে তোমার জন্য উপযুক্ত উপঢৌকন পাঠালাম যেন তাতে তুমি সন্তুষ্ট হও। আর প্রতীক সম্বলিত কাগজের প্রচলন যেন আগের মতই থাকে। জবাব হ্যাঁ সূচক হলে তোমার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা থাকবে। আবদুল মালেক উপঢৌকন সামগ্রী গ্রহণ করল না এবং রোমের সম্রাটের বিশেষ দূতকে বলল : এই চিঠির কোন উত্তর নেই।
আবদুল মালেকের কাছে রোমের বাদশার পক্ষ থেকে দ্বিতীয়বারের মত দ্বিগুণ পরিমান উপঢৌকন প্রেরিত হলো। তার সাথে আরও একটি চিঠি পাঠাল : আমার মনে হয় উপঢৌকন সামগ্রী অল্প হওয়াতে তুমি গ্রহণ করনি। এখন দিগুণ পরিমানে পাঠালাম আশা করব যে এই উপঢৌকনের কারণে তোমার কাছে আমার আগের চাওয়া বিষয়টিও গ্রহণযোগ্যতা পাবে। আবদুল মালেক প্রথমবারের ন্যায় এবারও উপহার সামগ্রী গ্রহণ করল না এবং চিঠির জবাবও দিল না।
রোমের সম্রাটের পক্ষ থেকে আবার আবদুল মালেকের কাছে চিঠি আসল : দুইবার আমার পাঠানো উপহার গ্রহণ করলে না। আমার ইচ্ছাও পূর্ণ করলে না। তৃতীয়বারের মত কয়েকগুণ বেশি উপঢৌকন পাঠালাম। ঈসার কসম যদি প্রতীক সম্বলিত কাগজের ব্যবহার আগের পর্যায়ে ফিরিয়ে না আন তাহলে নবী মুহাম্মদের নামের সাথে অপমানকর বাক্য সম্বলিত স্বর্ণ ও রোপ্য মুদ্রা তৈরী করার নির্দেশ দেব। আর তুমি তো এটা ভাল করেই জান যে রোমানরা মুদ্রা তৈরীতে বিশেষ পারদর্শী। যখন তোমরা তোমাদের নবীর নামে অপমানকর বাক্য সম্বলিত মুদ্রাগুলি দেখবে তখন লজ্জায় তোমাদের কপাল ঘামে ভিজে যাবে। সুতরাং এটাই ভাল যে উপঢৌকনগুলি গ্রহণ করে আমাদের ইচ্ছাটিকে পূরণ কর। যেন আমাদের অতীতের বন্ধুত্ব আগের মতই থাকে।
আবদুল মালেক তার চিঠির জবাবে উপায়হীন হয়ে বলল আমার ধারণা এটাই যে,মুসলমানদের মধ্যে যদি কোন নিকৃষ্ট ব্যক্তি জন্ম গ্রহণ করে থাকে আমিই সেই ব্যক্তি। কেননা আমিই এই কাজের কারণ হয়েছি যে রাসূল (সা.)-কে অবমাননা করবে। মুসলমানদের সাথে আলোচনা করল কিন্তু কেউ কোন উপায় বের করতে পারল না। তাদের একজন বলল : তুমি নিজেও এর উপায় জান কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে সে উপায়কে গ্রহণ করছো না।
আবদুল মালেক : এই হতভাগা,তুমি বলছো আমি সে উপায়টি জানি। কিন্তু সেটা কি?
বলল : নবী পরিবারের বাকেরের কাছ থেকে থেকে এই সমস্যার সমাধান চাও,অবশ্যই তিনি এর সমাধান দিতে পারবেন।
আবদুল মালেক তার কথাকে মেনে নিল। ইমাম বাকের (আ.)-কে অত্যন্ত সম্মানের সাথে সিরিয়ায় পাঠানোর জন্য মদীনার গভর্ণরকে নির্দেশ পাঠাল। রোমের সম্রাটের পাঠানো বিশেষ দূতকে ইমাম আসা পর্যন্ত সেখানেই রেখে দিল। ইমাম শামে(সিরিয়ায়) এলে তার কাছে ঘটনার বর্ণনা দিলে তিনি বললেন :
নবী (সা.)-এর অবমাননার ব্যাপারে রোমের সম্রাটের পক্ষ থেকে যে হুমকি এসেছে তা বাস্তবায়িত হবে না। কেননা আল্লাহ্ এই কাজ তাকে করতে দিবেন না। আর এই সমস্যার সমাধানের পথও অত্যন্ত সহজ। এখন সমস্ত শিল্পীদেরকে এক জায়গায় একত্রিত কর যেন তারা মুদ্রা তৈরীর কাজে লাগতে পারে। মুদ্রার এক পিঠে সূরা ইখলাছ ও অন্য পিঠে নবী (সা.)-এর নাম লেখ। আর এভাবেই আমরা রোমানদের ধাতবমুদ্রা থেকে অমুখাপেক্ষী হবো। মুদ্রার ওজন সম্পর্কেও তিনি এভাবে ব্যাখ্যা দেন যে,দশ দেরহাম করে তিন ধরনের মুদ্রা তৈরী করবে যার প্রতিটির ওজন হবে সাত মিসকাল।২৪ তিনি আরও বললেন,যে শহর থেকে মুদ্রা তৈরী করা হবে সে শহরের নাম,তারিখ ও বছর যেন তাতে উল্লেখ করা হয়।
আবদুল মালেক ইমামের নির্দেশকে বাস্তবায়ন করল এবং প্রতিটি ইসলামী প্রদেশগুলিতে সংবাদ পাঠাল যে সব ধরনের বেচা-কেনাতে যেন নতুন মুদ্রা ব্যবহার করা হয়। এখনও যাদের কাছে আগের মুদ্রা আছে ফেরত দিয়ে তাদেরকে ইসলামী মুদ্রা গ্রহণ করার জন্য জানাল। আর সম্রাটের বিশেষ দূতকে এ বিষয়ে অবগত করে পাঠিয়ে দিল।
সম্রাটকে এই ঘটনা সম্বন্ধে অবগত করা হলো। দরবারের লোকেরা তাকে আবদুল মালেককে দেয়া অতীতের হুমকিকে কার্যে পরিণত করার জন্য অনুরোধ জানালে সে বলল : আমি শুধুমাত্র তাকে রাগাতে চেয়েছিলাম মাত্র। কিন্তু এ কাজ এখন অনর্থক কেননা ইসলামী দেশগুলিতে এখন আর রোমান মুদ্রার ব্যবহার হবে না।২৫
ইমামের সাহাবাগণ
ইমাম আবু জা’ফর বাকেরুল উলুমের শিক্ষালয়ে যে সকল উন্নত ও উপযুক্ত ছাত্র তৈরী হয়েছিল এখানে তাদের কয়েক জনের ব্যক্তিত্ব তুলে ধরা হলো :
১.আবান বিন তাগলিব : তিনি তিন ইমামের সংর্স্পশ লাভে ধন্য হয়েছেন- ইমাম যয়নুল আবেদীন,ইমাম মুহাম্মদ বাকের ও ইমাম জা’ফর সাদেক (আ.)। তিনি তার যুগের একজন জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব হিসাবে পরিচিত ছিলেন। কেননা তিনি তাফসীর,হাদীস,ফিকাহ্ শাস্ত্র,কেরাআত (পঠন শাস্ত্র) ও আভিধানিক জ্ঞানে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তার জ্ঞানের এতটা গভীরতা ছিল যে ইমাম বাকের (আ.) তাকে মদীনার মসজিদে বসে মানুষের উদ্দেশ্যে ফতোয়া দিতে বলেছিলেন। তিনি বলেন : আমি পছন্দ করি যে মানুষ তোমার মত আমাদের অনুসারীদেরকে দেখুক বা চিনুক।
আবান যখনই মদীনায় আসতেন অন্যান্য জ্ঞানের আসরগুলি ভেঙ্গে যেত। আর মসজিদে যেখানে নবী (সা.) খোৎবা দিতেন সে স্থানটি অন্যরা তার শিক্ষাদনের জন্য খালি করে দিত।
আবানের মৃত্যুর সংবাদ ইমাম সাদেক (আ.)-এর কাছে পৌঁছালে তিনি বললেন : আল্লাহর কসম! আবানের মৃত্যুর সংবাদে আমার হৃদয়ে ব্যথা শুরু হয়েছে।২৬
২.যুরারাহ্ : ইমাম বাকের ও ইমাম সাদিক (আ.)-এর মাধ্যমে প্রশিক্ষিত শিয়া মনীষীদের মধ্যে ছয়জনকে বিশেষ মর্যাদার মনে করা হয়। যুরারাহ্ তাদের মধ্যে একজন। ইমাম সাদেক (আ.) নিজে বলেছেন : যদি বোরাইদ বিন মুয়াবিয়া,আবু বাসির,মুহাম্মদ বিন মুসলিম ও যুরারাহ্ না থাকত তাহলে নবী (সা.)-এর নিদর্শন (শিয়াদের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা) সব শেষ হয়ে যেত। তারা আল্লাহর হারাম-হালালের ব্যাখ্যায় বিশ্বস্ত।
আরও বলেন : বোরাইদ,যুরারাহ্,মুসলিম ও আহওয়াল জীবিত ও মৃত উভয় অবস্থায় আমার অতি প্রিয়ভাজন ব্যক্তিত্ব।
ইমামের প্রতি যুরারার ভালবাসা এতই গভীর ছিল যে ইমাম সাদেক (আ.) তার জীবন বাঁচানোর জন্য উপায়হীন হয়ে তার ব্যাপারে মন্দ বলা ও তার সাথে কৃত্রিম ব্যবহার করা শুরু করলেন। কিন্তু গোপনে তাকে খবর দিলেন যে,তোমার ব্যাপারে মন্দ বলছি এ জন্য যে তোমার প্রতি বিশ্বাস রাখি। কেননা শত্রুরা আমাদের প্রতি অন্যদের ভালবাসার কথা জানতে পারলে তাকে নানাভাবে অত্যাচার করবে। আর আমাদের ভালবাসাকে প্রকাশ করার ব্যাপারে তোমার প্রসিদ্ধি আছে। এ কারণে আমার পক্ষে এরূপ কৃত্রিম ব্যবহার করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। যুরারাহ্ কেরাআত,ফিকাহ্,কালাম শাস্ত্র,কবিতা ও আরবী সাহিত্যে সুপণ্ডিত ছিলেন এবং তার মর্যাদা ও দীনদারী সম্পর্কে সকলেই জানত।২৭
৩.কুমায়েত আসাদী : তিনি একজন প্রসিদ্ধ কবি ছিলেন। স্পষ্ট ভাষার মাধ্যমে আহলে বাইতের পক্ষে গভীর অর্থ সম্বলিত কবিতা রচনা করতেন। তার কবিতা উমাইয়্যা শাসকদের বিরুদ্ধে এমন মারাত্মক ও অপমানজনক ছিল যার কারণে উমাইয়্যা খলিফার পক্ষ থেকে তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়।
সত্য বর্ণনা করা এবং নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের পক্ষে কথা বলা ঐ যুগে এত দুরূহ ব্যাপার ছিল যে অত্যন্ত সাহসী ও প্রভাবশালী লোকও এ ধরনের কাজে সাহস পেত না। কুমায়েত এমন এক সাহসিকতার প্রতিচ্ছবি যে উমাইয়্যা খেলাফতের সময় মৃত্যুকে ভয় না পেয়ে তার শক্তি ও সামর্থ্য অনুযায়ী সত্য বর্ণনা করত। মানুষের সামনে উমাইয়্যা খেলাফতের স্বরূপ উন্মোচন করত।
কুমায়েত তার কিছু কবিতায় ইমামগণকে বনি উমাইয়্যাদের বিপক্ষে এমনভাবে পরিচয় করিয়েছে : এই ন্যায়পরায়ণ পথ পরিচালক বা নেতাগণ বনি উমাইয়্যাদের মত নন যে মানুষ ও পশুদেরকে একই রকম মনে করবে। তাঁরা আবদুল মালেক,ওয়ালিদ, সোলাইমান ও হিশামের মত নন যে মিম্বারে বসে এমন কথা বলেন না যা তা নিজেরা করেন না। উমাইয়্যারা তাদের বক্তব্যে নবীর কথা বলে কিন্তু নিজেরা জাহেলিয়াতের যুগের ন্যায় কাজ করে থাকে।২৮
কুমায়েত ইমাম বাকের (আ.)-এর অত্যন্ত ভক্ত ছিলেন। আর এই ভালবাসার পথে নিজেকে ভুলে গিয়েছিলেন। একদিন ইমামের সামনে তাঁকে নিয়ে রচিত একটি কবিতা পাঠ করল। ইমাম কা’বার দিকে ফিরে তিনবার বললেন : ইয়া আল্লাহ্! তুমি কুমায়েতের প্রতি করুণা কর। আর কুমায়েতকে বললেন তোমার জন্য আমরা পরিবারের সবাই মিলে একশ দেরহাম জমা করেছি।
কুমায়েত : আল্লাহর কসম! কখনও স্বর্ণ ও রৌপ্য চাইনা। শুধুমাত্র আপনার একটি জামা আমাকে দিন। ইমাম তাঁর গায়ের জামাটি খুলে তাকে দিলেন।২৯
অন্য আরেকদিন তিনি ইমামের পাশে বসে ছিল। ইমাম তাঁর যুগের করুণ অবস্থা বর্ণনা করে এই কবিতাটি বললেন :
ذَهَبَ الَّذِينَ يُعاَشُ فِى اَكْناَفِهِمْ لَمْ يَبْقَ اِلاَّ شاَتِمٌ اَوْحَاسِدٌ
অর্থাৎ যারা উদার প্রাণ ব্যক্তি ছিল,যাদের আশ্রয়ে মানুষ জীবন যাপন করত,তারা সবাই চলে গেছে,শুধুমাত্র হিংসুক আর নষ্টরা ছাড়া কেউ নেই।
কুমায়েত সাথে সাথে জবাব দিলেন :
وَبَقىَ عَلىَ ظَهْرِ الْبَسِيطَةِ واحِدٌ فَهُوَا الْمُرادُ وَ اَنْتَ ذاكَ الْواحِدُ
কিন্তু এই দুনিয়ায় একজন মহামানব আছেন যাকে দুনিয়ার সবাই জানে আর সে ব্যক্তি হচ্ছেন আপনি।৩০
৪.মুহাম্মদ বিন মুসলিম : তিনি ফকীহ্৩১ এবং ইমাম বাকের ও ইমাম সাদেক (আ.)-এর সহচারী ছিলেন। যেমনটি পূর্বে উল্লেখ করেছি ইমাম সাদেক (আ.) তাকে ঐ চার জনের মধ্যে একজন হিসাব করতেন যাদের কারণে নবী (সা.)-এর নিদর্শন টিকে আছে।
তিনি ছিলেন কুফাবাসী। ইমাম বাকের (আ.)-এর সীমাহীন জ্ঞান থেকে নিজের জ্ঞান বিকাশের লক্ষ্যে মদীনায় আসেন এবং চার বছর মদীনায় থাকেন।
আবদুল্লাহ্ বিন আবি ইয়া’ফুর বলেন : ইমাম সাদেক (আ.)-এর কাছে বলেছিলাম যে,কেউ কেউ কখনও আমার কাছে প্রশ্ন করে যার উত্তর আমি জানি না। আর আপনাকেও সে সময় পাই না। এমতাবস্থায় আমি কি করব?
ইমাম,মুহাম্মদ বিন মুসলিমকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন : কেন তার কাছ থেকে তোমার অজানা জবাবগুলি জেনে নাও না ।৩২
কুফায় একরাতে এক মহিলা মুহাম্মদ বিন মুসলিমের বাসায় এসে বলল : আমার ছেলের স্ত্রী,গর্ভে বাচ্চা নিয়ে মারা গেছে এবং যে বাচ্চা তার গর্ভে আছে সে জীবিত,আমাদের এখন কি করণীয়?
মুহাম্মদ : যেভাবে ইমাম বাকের (আ.) বলেছেন সে অনুযায়ী তার পেট কেটে বাচ্চাকে বাইরে এনে তারপর তাকে মাটি দিতে হবে। অতঃপর ঐ মহিলাকে জিজ্ঞেস করল যে,সে তাকে কিভাবে চিনে?
মহিলা : এই বিষয়টিকে ‘আবু হানিফার’ কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে বলল এই বিষয়ে আমি কিছু জানিনা। আর আমাকে আপনার কাছে আসার পরামর্শ দিল। এও বলল যদি আপনি এ ব্যাপারে কোন ফতোয়া দেন তাহলে আমি যেন তাকে জানাই.।
অন্য আরেকদিন মুহাম্মদ বিন মুসলিম কুফার মসজিদে আবু হানিফাকে দেখলো যে কিছু ব্যক্তির মধ্যে সে ঐ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছে। ঐ সমস্যার সমাধানটি নিজে দিয়েছে এমনটিই বোঝাতে চাইলো তাদেরকে। মুহাম্মদ আস্তে করে কাশি দিল। ওদিকে আবু হানিফা বুঝতে পেরে বলল,‘আল্লাহ্ তোমাকে ক্ষমা করুন আমাকে জীবন যাপন করতে দাও।’৩৩
ইমামের শাহাদাত
মহান ইমাম বাকেরুল উলুম ৫৭ বছর বয়সে ১১৪ হিজরী যিলহজ মাসের ৭ তারিখে অত্যাচারী উমাইয়্যা শাসক আবদুল মালেকের শাসনামলে বিষ প্রয়োগে শহীদ হন। শাহাদাতের দিন সন্ধ্যায় ইমাম সাদেক (আ.)-কে বললেন : আমি আজ রাতে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যাব। এখনই আমি (স্বপ্নে) দেখতে পেলাম আমার বাবা আমার কাছে শরবত নিয়ে আসলেন,আর আমি তা পান করলাম।তিনি আমাকে চিরন্তন আশ্রয়ে যাওয়ার ও আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভের সুসংবাদ দিলেন।
পরদিন আল্লাহ্ প্রদত্ত সীমাহীন জ্ঞানের এই পবিত্র ব্যক্তিটিকে বাকি নামক কবরস্থানে ইমাম হাসান মুজতাবা ও ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর সমাধিস্থানের পাশে দাফন করা হলো। তাঁর উপর আল্লাহর সালাম বর্ষিত হোক।৩৪
এখন এই শেষ পর্যায়ে এই মহামানবের জ্ঞানের সমুদ্র থেকে শিক্ষণীয় কিছু বিষয় তুলে ধরব :
i. মিথ্যাকে পরিহার করাই ঈমান।৩৫
ii. মুমিন ব্যক্তি ভীতু,লোভী বা কৃপণ হয় না।৩৬
iii. দুনিয়ার প্রতি লোভ রেশম পোকার গুটির ন্যায়,যতই তার উপর সুতার আবরণ তৈরী করবে ততই তা থেকে তার বেরিয়ে আসা অতিশয় কষ্টকর হবে।৩৭
iv. মুমিনদের তিরস্কার করা থেকে দূরে থেকো।৩৮
v. তোমার মুসলমান ভাইদেরকে ভালবাসবে এবং যা কিছু নিজের জন্য চাও তা তাদের জন্যও চাইবে আর যা কিছু নিজের জন্য পছন্দ কর না তা তাদের জন্যও পছন্দ করবে না।৩৯
vi. যদি এক মুসলমান অন্য এক মুসলমানের বাড়ীতে কোন কিছু চাইতে বা তার সাথে দেখা করতে যায়,আর সে বাড়ীতে থাকে কিন্তু তাকে ঢোকার অনুমতি না দেয় এবং নিজে তার সাথে দেখা করতে না যায়,এই বাড়ীর কর্তার উপর আল্লাহর গজব পড়তে থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা একে অপরের সাথে মিলিত হয় ।৪০
vii. আল্লাহ্ তায়ালা লজ্জা ও সহনশীলতাকে পছন্দ করেন।৪১
viii. যারা মানুষের প্রতি রাগকে ভুলে যায় আল্লাহ্ তার থেকে কিয়ামতের আজাবকে তুলে নেন।৪২
ix. যারা ভাল কাজে উপদেশ দান ও খারাপ কাজে বাধা দান করাকে ত্রুটি বলে মনে করে তারা খারাপ লোক।৪৩
x. কোন বাড়ীতে শত্রু প্রবেশ করলে ঐ বাড়ীর কর্তা যদি সেই শত্রুর সাথে মুকাবিলা না করে তবে সেই বান্দার সাথে আল্লাহ্ শত্রুতা পোষণ করেন।৪৪
তথ্যসূত্র :
১। মেসবাহুল মোতাহাজ্জেদ, শেখ তুসি, পৃ. ৫৫৭ ।
২।ইমাম সাদেক (আ.) উম্মে আবদুল্লাহ্র ব্যাপারে বলেছেন : তিনি একজন ঈমানদার, পরহেজগার ও সতী-সাধ্বী নারী ছিলেন... তাওয়ারিখুন্নাবী, তুসতারী, পৃ. ৪৭ ।
৩। আমালি, শেখ সাদুক, পৃ. ২১১।
৪। ইলালুশ শারায়ে, শেখ সাদুক, পৃ. ২২২ ।
৫। এরশাদ, শেখ মুফিদ, পৃ. ২৪৬ ।
৬। প্রাগুক্ত
৭। মানাকেব, ইবনে শাহ্রে আশুব, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩২৯ ।
৮। বিহারুল আনওয়ার, ৪৬তম খণ্ড, পৃ. ২৪৩ ।
৯। বিহারুল আনওয়ার, ৪৬তম খণ্ড, পৃ. ২৪৩ ।
১০। প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৭ ।
১১। আমালি, শেখ তুসি, পৃ. ২৬১ ।
১২। ইরশাদ, শেখ মুফিদ, পৃ. ২৪৭ ।
১৩। সূরা মায়েদা, আয়াত : ৩ ।
১৪। সূরা আল কিয়ামাহ্ : ১৬ ।
১৫। সূরা আল হাক্কাহ্ : ১২ ।
১৬। সূরা নাহল : ৮৯।
১৭। সূরা ইয়াসীন : ১২।
১৮। সূরা আনআম : ৩৮।
১৯। দালায়েলুল ইমামাহ্ ,তাবারি, পৃ. ১০৪-১০৬।
২০। সূরা বাকারা : ১৮৭।
২১। সূরা আনআম : ১২৪, ও কাফি, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৩৪৯।
২২। বিস্তারিত জানার জন্য আল আকদুল মুনির, খণ্ড - ১।
২৩। রোম সম্রাট তার কথার মাধ্যমে আবদুল মালেকের পূর্ববর্তী খলিফাদের প্রতি গোঁড়ামীকে উস্কে দিতে চাইলো, এ জন্য যে রোমের কাগজের ব্যবহার পূর্বে প্রচলিত থাকলেও অতীত খলিফাদের কোনরূপ আপত্তি ছিলনা।
২৪। ইমাম বাকের (আ.) বলেন : তিন ধরনের মুদ্রা তৈরী হবে, প্রথমটি প্রতি এক দেরহাম এক মেসকাল এবং এভাবে দশ দেরহাম দশ মেসকাল, দ্বিতীয়টি প্রতি দশ দেরহাম ছয় মেসকাল এবং তৃতীয়টি প্রতি দশ দেরহাম পাঁচ মেসকাল হবে। আর এভাবে ঐ তিন ধরনের মুদ্রা হতে প্রতি ত্রিশ দেরহামে একুশ মেসকাল হতো। এটা রোমের মুদ্রার সমমান ছিল। মুসলমানরা বাধ্য ছিল যে রোমানদের ত্রিশ দেরহাম যা একুশ মেসকাল হতো তা ফেরত দিয়ে নতুন ত্রিশ দেরহাম নেওয়ার জন্য।
২৫। আল মাহাসেন ওয়াল মাসাভী, বাইহাকি, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩২-২৩৬, মিশর থেকে প্রকাশিত।
বিঃ দ্রঃ- আমরা এই ঘটনায় দেখেছি যে ইসলামী মুদ্রা ইমাম বাকের (আ.)-এর সময়ে তাঁর সুব্যবস্থাপনায় তৈরী ও প্রচলন হয়। অন্যান্য কিছু সংখ্যক বইতে এভাবে এসেছে যে, ইমাম আলী (আ.)-এর সময়ে তার নির্দেশে বসরাতে ইসলামী মুদ্রা তৈরী করা হয়। এ বিষয়টির সাথে উল্লিখিত বিষয়ের কোন প্রকার বৈপরীত্য নেই, এ কারণে যে ধরে নেয়া যেতে পারে ইসলামী মুদ্রা তৈরীর কাজ ইমাম আলী (আ.)-এর সময় থেকে শুরু হয়েছে কিন্তু তার পরিপূর্ণতা ইমাম বাকের (আ.)-এর সময়ে। এ বিষয়ে আরো বেশি জানার জন্য মরহুম সারদার কাবুলির ‘গায়াতুত তা’দিল’ বইটির ১৬ নং পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
২৬। জামেয়ুর রোয়াত, ১ম খণ্ড, পৃ. ৯ ।
২৭। জামেয়ুর রোয়াত, ১ম খণ্ড, পৃ. ১১৭, ৩২৪, ৩২৫।
২৮। আশশিয়াতু ওয়াল হাকিমুন, পৃ. ১২৮।
২৯। সাফিনাতুল বিহার, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৯৬।
৩০। মুনতাহাল আমাল, ২য় খণ্ড, পৃঃ - ৭।
৩১। যে ফিকাহ্ শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য লাভ করেছে তাকে ফকীহ্ বলা হয়।
৩২। তোহ্ফাতুল আহবাব, মুহাদ্দিস কোমী, পৃ. ৩৫১।
৩৩। রেজালে কাশি, পৃ. ১৬২।
৩৪। কাফি, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৬৯, বাছায়েরুদ দারাজাত, পৃ. ১৪১, তাওয়ারিখুন নাবী ওয়াল আল, তুসতারি, পৃ. ৪০, আনওয়ারুল বাহিয়াহ্. মুহাদ্দেস কোমী, পৃ. ৬৯।
৩৫। ওয়াসাইলুশ শিয়া, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩৩।
৩৬। ওয়াসাইলুশ শিয়া, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬।
৩৭ । প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭৪।
৩৮। প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪০।
৩৯। ওয়াসাইলুশ শিয়া, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৯।
৪০। প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩১।
৪১। প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৫।
৪২। প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬৯ ।
৪৩। ফুরুয়ে কাফি, পৃ. ৩৪৩ ।
৪৪। ওয়াসাইলুশ শিয়া, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৩৩ ।
সূত্রঃ ইন্টারনেট
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন