ইসলামের শত্রু ইয়াযিদ
ইসলামের শত্রু ইয়াযিদ
আজ হতে ১৩৭১ বছর আগে ৬৪ হিজরির ১৪ ই রবিউল আউয়াল জালিম ও খোদাদ্রোহী শাসক ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া মারা যায়। (মহান আল্লাহর অনন্ত অভিশাপ তার ওপর বর্ষিত হোক)
ইয়াজিদ তার তিন বছর নয় মাসের অবৈধ শাসনামলে অন্তত: তিনটি মহাপাপ ও অপরাধযজ্ঞের জন্য ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে কুখ্যাত ও ঘৃণিত ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে। এই তিনটি মহাপাপের মধ্যে প্রথমটি হল ৬১ হিজরিতে কারবালায় বিশ্বনবী (সা.)এর প্রিয় নাতী হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)ও তাঁর ছয় মাসের শিশুপুত্র হযরত আলী আসগরসহ নবী (দরুদ) বংশের ১৮ জন সদস্যকে নৃশংসভাবে পিপাসার্ত অবস্থায় শহীদ করা। কারবালায় ইমামের আরো প্রায় ৬০ জন সমর্থকও বীরের মত লড়াই করে শহীদ হয়েছিলেন।
ইমাম শিবিরের জন্য কয়েকদিন ধরে পানি সরবরাহ নিষিদ্ধকারী ইয়াজিদ বাহিনী ইমাম হুসাইন (আ.)এর পবিত্র লাশসহ নবী-পরিবারের সদস্যদের লাশের ওপর ঘোড়া ছুটিয়ে লাশগুলো দলিত-মথিত করেছিল এবং তাঁদের মস্তক ছিন্ন করে বর্শার আগায় বিদ্ধ করেছিল। তারা কারবালায় ইমাম শিবিরের তাঁবুগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে লুটপাট চালিয়েছিল। এ ছাড়াও নবী-বংশের নারী ও শিশুদেরকেও টেনে হিঁচড়ে শিকল পরিয়ে বন্দী অবস্থায় কুফার গভর্নরের দরবারে ও দামেস্কে ইয়াজিদের দরবারে নিয়ে গিয়েছিল খোদাদ্রোহী ইয়াজিদ বাহিনী।
ইয়াজিদের দ্বিতীয় মহাপাপটি ছিল পবিত্র মদীনা শহরে হামলা এবং মসজিদে নববীর অবমাননা ও তিন দিন ধরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে মদীনায় লুট-পাট আর গণহত্যা চালানোসহ গণ-ধর্ষণের অনুমতি দেয়া। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন ভারত উপমহাদেশের বিখ্যাত আলেম মাওলানা শাহ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলাভী-র. প্রণীত 'কারবালার পর পবিত্র মক্কা ও মদীনায় ইয়াজিদি তাণ্ডবলীলা'শীর্ষক প্রবন্ধ)
ইয়াজিদের তৃতীয় মহাপাপটি ছিল পবিত্র মক্কার কাবা ঘরে হামলা চালিয়ে তা ধ্বংস করে দেয়া। পাষণ্ড ইয়াজিদের বর্বর সেনারা (কারবালার মহাঅপরাধযজ্ঞ সম্পাদনের তিন বছর পর) পবিত্র মক্কা অবরোধ করে। তারা মহান আল্লাহর ঘরে তথা পবিত্র কাবায় জ্বলন্ত ন্যাপথালিনযুক্ত অগ্নি-গোলা নিক্ষেপ করে কাবা ঘর জ্বালিয়ে দেয়। ফলে মক্কার বিশিষ্ট সাহাবীদের কাছে ইয়াজিদের খোদাদ্রোহী চরিত্রের বিষয়টি আবারও স্পষ্ট হয়।
পবিত্র কাবাঘরে হামলার পরই খবর আসে যে কুখ্যাত জালিম ও কাফির ইয়াজিদ মারা গেছে।
কারবালার ঘটনার পর নরাধম ইয়াজিদ তীব্র মাথা-ব্যথা রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। একদিন সে মাতাল অবস্থায় শৌচাগারে পড়ে যায় এবং সেখানেই প্রাণ ত্যাগ করে। এ সময় তার বয়স হয়েছিল ৩৭ বছর এবং তার পুরো শরীর আলকাতরার মত কালো হয়ে গিয়েছিল।
অবশ্য মহাপাপী ও অভিশপ্ত ইয়াজিদের মৃত্যু সম্পর্কে কয়েকটি বর্ণনা রয়েছে।
কয়েকটি বর্ণনায় (সামান্য পার্থক্যসহ) এসেছে, ইয়াজিদ ৬৪ হিজরিতে একবার তার বেশ কিছু লোকজন নিয়ে পশু শিকারের জন্য রাজধানীর বাইরে যায়। কয়েক দিনের পথ অতিক্রমের পর এক জায়গায় একটি অতি সুন্দর হরিন দেখতে পায় সে। এ অবস্থায় ইয়াজিদ একাই ওই হরিন ধরবে বলে ঘোষণা করে এবং এ কাজে কারো সহযোগিতার দরকার নেই ও কেউ যেন তার সঙ্গে না আসে বলেও সে অন্যদের নির্দেশ দেয়।
কিন্তু হরিনটিকে ধরতে বা শিকার করতে গিয়ে ইয়াজিদ উপত্যকা থেকে উপত্যকা পর্যন্ত ঘোড়া ছুটিয়েও সফল হয়নি এবং এক পর্যায়ে হরিনটি বহু দূরের এক উপত্যকায় অদৃশ্য হয়ে গেলে ইয়াজিদ নিজেকে হারিয়ে ফেলে। ইয়াজিদের লোকজন আরো আগে তাকে হারিয়ে ফেলেছিল।
পাষণ্ড ইয়াজিদ এক ভয়াবহ প্রান্তরে তীব্র পিপাসার্ত অবস্থায় পানি খুঁজতে থাকে। কিন্তু কোথাও সে পানি খুঁজে পায়নি।
এক পর্যায়ে সে পানির পাত্র হাতে এক আরব ব্যক্তিকে দেখতে পায়। সে তাকে পানি দেয়ার অনুরোধ জানায় এবং বলে যে, আমাকে চিনতে পারলে পানি দেয়া ছাড়াও তুমি অনেক সম্মানও করবে।
ওই আরব ব্যক্তি বলেন: কে আপনি?
ইয়াজিদ বলে: আমি আমিরুল মু'মিনিন ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া।
এ কথা শুনে ওই আরব ব্যক্তি মহাক্ষিপ্ত হয়ে বলে: খোদার শপথ, তুই হলি ইমাম হুসাইন ইবনে আলী (আ.)'র হত্যাকারী, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) শত্রু! আর এ কথা বলেই সে তরবারি বের করে ইয়াজিদকে হত্যা করতে এগিয়ে আসে।
এ অবস্থায় ইয়াজিদের ঘোড়া মারাত্মভাবে ভীত হয়ে পালাতে চাইলে ইয়াজিদ ঘোড়ার পিঠ থেকে উল্টে পড়ে এবং তার একটি পা ঘোড়ার রেকাবে আটকে যায়। এ অবস্থায় ভীত-সন্ত্রস্ত ঘোড়াটি ইয়াজিদকে নিয়ে কাঁটাযুক্ত বন ও এবড়ো থেবড়ো পাথরের ওপর দিয়ে পালাতে থাকায় তার দেহ থেতলে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। (অন্য বর্ণনা অনুযায়ী নিজ ঘোড়ার পায়ের তলেই পিষ্ট হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায় ইয়াজিদ।)
ওদিকে ইয়াজিদের বিশেষ প্রহরীদের একটি দল তাকে খুজতে এসে দেখে যে ইয়াজিদের শরীর বলতে আর কিছু নেই কেবল তার একটি রান বা পায়ের অংশ বিশেষ ঘোড়ার রেকাবের মধ্যে আটকে ঝুলে আছে। (লোহুফ, সাইয়্যেদ ইবনে তাউস)
শেইখ সাদুক্বের বর্ণনা অনুযায়ী ইয়াজিদ এক রাতে মাতাল অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তার শরীর এতটা কালো হয়ে পড়েছিল যে মনে হয় যেন আলকাতরা মাখানো হয়েছিল এই পাষণ্ডের গায়ে। তাকে দামেস্কের বাব আস সাগিরে দাফন করা হয়।
'আলকামিল ফিততারিখ' বইয়ে ইয়াজিদের মৃত্যু সম্পর্কে এসেছে: মিনজানিক (বা পাথর নিক্ষেপক কামান জাতীয় অস্ত্র) থেকে পাথরের একটি টুকরো ইয়াজিদের মুখের এক পাশে আঘাত করায় সে কিছুকাল অসুস্থ থেকে মারা যায়।
আবার কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, বিশ্বনবী (সা.) ও আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.)'র বিশিষ্ট সাহাবি হুজর বিন উদাই কিন্দির (মুয়াবিয়া তাঁকে শহীদ করেছিল) কন্য সালামি হুজরের ভাতিজা আবদুর রহমানের সহায়তায় ইয়াজিদকে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে জাহান্নামে পাঠিয়েছিলেন।
তিন বছর সাড়ে নয় মাস শাসনের পর রাজা ইয়াজিদ ৩৭ বছর বয়সে জাহান্নামবাসী হয়।
মুয়াবিয়ার এক খ্রিস্টান উপপত্নীর গর্ভে জন্ম নিয়েছিল ইয়াজিদ। ইয়াজিদের মায়ের নাম ছিল মাইসুন বিনতে বাইদাল আল কুলাইবি আন-নাসরানিয়া। সে ছিল এক সিরিয় বেদুইন। সিরিয়ার গভর্নর থাকাকালে মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান এই নারীকে অপহরণ করে এবং পরে পরিত্যাগ করে। অনেকের মতে ইয়াজিদ ছিল এক অবৈধ বা জারজ সন্তান।
ইয়াজিদকে দুধ পান করিয়েছিল বেশ কয়েকজন চরিত্রহীন মহিলা। মুয়াবিয়ার কোনো ছেলে বা পুত্র সন্তান না থাকায় বহু বছর পর ইয়াজিদকে দামেস্কে নিয়ে আসে। মুয়াবিয়া বিশ্বনবী (সা.)'র বড় নাতি ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.)'র সঙ্গে সন্ধির শর্ত লঙ্ঘন করে ইয়াজিদকে নিজের উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করেছিল।
ইয়াজিদ কোনো ধর্মে বিশ্বাস করত না, যদিও তার গলায় ঝুলত মায়ের দেয়া একটি ক্রুশের লকেট। সে মাত্রাতিরিক্ত মদ পান করে মাতাল হয়ে থাকত এবং তার সঙ্গে সমকামে লিপ্ত হতে নিজের চাকরদের আহ্বান জানাত।
ইয়াজিদের মৃত্যুর ৫৮ বছর পর ১৩২ হিজরিতে আব্বাসীয় খলিফা আবুল আব্বাস আস সাফ্ফাহ উমাইয়া খলিফাদের কবর খুঁড়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল। ফলে আমির মুয়াবিয়াসহ তার পরের সব উমাইয়া রাজার কবর খুঁড়ে ফেলা হয়। ইয়াজিদের কবরে কেবল তার পায়ের একটি হাড় পাওয়া যায়, আর সবই ছিল কয়লার মত কালো হয়ে যাওয়া ছাইতুল্য মাটি। অর্থাত কবরের আজাবে তার পুরো শরীর ও হাঁড় পুড়ে গিয়েছিল।
সুন্নি ও শিয়া মুসলিম আলেমদের মতে ইয়াজিদ ছিল কাফের। কারণ, সে প্রকাশ্যেই বলেছিল নবী এবং ওহী বলতে কখনও কিছু ছিল না। অভিশপ্ত ইয়াজিদের সামনে যখন ইমাম হুসাইন (আ.)এর পবিত্র শির মুবারক আনা হয় তখন সে বলেছিল, আহা! আমার (কাফের)পূর্বপুরুষরা যদি আজ বেঁচে থাকত তাহলে তারা দেখতে পেতেন যে কিভাবে আমি বদর এবং ওহুদ যুদ্ধে (মুসলমানদের হাতে) নিহত আমার (দাদা আবু সুফিয়ানের) আত্মীয়-স্বজনদের রক্তের বদলা নিয়েছি মুহাম্মদের কাছ থেকে! এই নরাধম (ইয়াজিদ) আরো বলেছিল, হুসাইনকে হত্যার মাধ্যমে আমরা মুহাম্মদকেই হত্যা করেছি!
(উল্লেখ্য, নবীবংশকে তথা হযরত আলী (আ.) ও নবী নন্দিনী খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমা (সা.) এর পুত্র বেহেশতী যুবকদের সর্দার ইমাম হুসাইন-আ.এর বংশধরদের কাছে ইসলামী খেলাফত ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলে আব্বাসীয়রা জনগণের সমর্থন নিয়ে উমাইয়া রাজবংশকে উতখাত করলেও আব্বাসীয়রাও নবী-বংশের কোনো ইমামের কাছে কখনও ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়নি। বরং আব্বাসীয়রা নবীবংশের ওপর জুলুম অত্যাচারের ব্যাপারে উমাইয়াদেরকেও ছাড়িয়ে যায় এবং তাদের হাতে নবী-বংশের ৬ জন ইমাম শাহাদত বরণ করেছেন।)
সূত্রঃ বার্তা সংস্থা আবনা
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন