সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ১০২-১০৬

সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ১০২-১০৬


সূরা বনী ইসরাইলের ১০২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন :
قَالَ لَقَدْ عَلِمْتَ مَا أَنْزَلَ هَؤُلَاءِ إِلَّا رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ بَصَائِرَ وَإِنِّي لَأَظُنُّكَ يَا فِرْعَوْنُ مَثْبُورًا (102)
“মুসা বলল: (হে ফেরাউন!) তুমি তো ভালোভাবেই জানো যে, এই সব অলৌকিক নিদর্শন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর প্রভুই অবতীর্ণ করেছেন প্রত্যক্ষ প্রমাণস্বরূপ এবং হে ফেরাউন! আমি প্রকৃতই মনে করি তোমার ধ্বংস আসন্ন।" (১৭:১০২)

আগের আয়াতে আমরা বলেছি, মিশরের অত্যাচারী শাসক ফেরাউন আল্লাহর নবী হযরত মুসা (আ.)এর মুজিযা দেখে ঈমান আনার পরিবর্তে তাকে জাদুকর বলে উপহাস করে। এর উত্তরে হযরত মুসা বলেন: আমি যা প্রদর্শন করেছি জাদু ছিল না, বরং এটি ছিল মানুষের ক্ষমতার উর্ধ্বে এমন একটি কাজ যা আমি বিশ্বজাহানের প্রতিপালকের নির্দেশে করেছি। এটা আমি ক্ষমতা প্রদর্শন বা সম্পদ ও সুনাম অর্জনের জন্য করিনি, বরং এটা আমি আল্লাহর নির্দেশে পালন করেছি, যাতে তাঁর পক্ষ থেকে পাঠানো সত্যবাণী মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। আর এটাই স্বাভাবিক যারা এ সত্যবানী'ও স্পষ্ট নিদর্শণ গ্রহণ করবে না তারা ধ্বংস হয়ে যাবে।

এ আয়াতে আমাদের জন্য যেসব শিক্ষণীয় দিক রয়েছে-তার কয়েকটি হচ্ছে :
এক. কখনও কখনও মানুষ সত্যকে জেনেও না জানার ভান করে। ফেরাউন জানত যে, মুসা (আ.) সত্য বলছেন, তারপরও সে তা গ্রহণ করে আল্লাহর অস্তিত্ব মেনে নেয়নি।
দুই. যে সব দেশ ও সমাজে অত্যাচারী ও দুর্নীতিপরায়ণ শাসক রয়েছে, সে সব সমাজে ধর্ম প্রচারের দায়িত্ব শুরু করতে হবে শাসকদের মাধ্যমে। কারণ, এ ধরনের সমাজের সাধারণ মানুষের সংস্কার শাসকের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। এ কারণে হযরত মুসা (আ.) প্রথমে ফেরাউনের কাছে গিয়েছিলেন।

সূরা বনী ইসরাইলের ১০৩ ও ১০৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
فَأَرَادَ أَنْ يَسْتَفِزَّهُمْ مِنَ الْأَرْضِ فَأَغْرَقْنَاهُ وَمَنْ مَعَهُ جَمِيعًا (103) وَقُلْنَا مِنْ بَعْدِهِ لِبَنِي إِسْرَائِيلَ اسْكُنُوا الْأَرْضَ فَإِذَا جَاءَ وَعْدُ الْآَخِرَةِ جِئْنَا بِكُمْ لَفِيفًا (104)
“সুতরাং ফেরাউন তাদের পৃথিবীর বুক (মিশর) থেকে উচ্ছেদ করতে চাইল। কিন্তু আমি ফেরাউনকে ও তার সঙ্গীসাথীদের সবাইকে নিমজ্জিত করলাম।” (১৭:১০৩)
“এবং এরপর আমি বনী ইসরাইলীদের বলেছিলাম,প্রতিশ্রুত দেশে তোমরা নিরাপদে বাস কর। কিন্তু যখন কেয়ামতের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে,তখন আমি তোমাদের সবাইকে একত্রিত করে উপস্থিত করব।” (১৭:১০৪)

অত্যাচারী সরকারের পদ্ধতি হল, আল্লাহর প্রেরিত বান্দাদের হত্যা করা অথবা নির্বাসনে পাঠানো, যাতে করে আল্লাহর সত্যবাণী মানুষের কাছে পৌঁছাতে না পারে। ফেরাউনও এ কাজই করেছে। কিন্তু ফেরাউন জানত না, মুসা (আ.) এর সঙ্গে তার পালনকর্তা রয়েছেন, যিনি সারাক্ষণ তাঁকে সহযোগিতা ও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। এজন্য যখন ফেরাউন তার বাহিনী নিয়ে হযরত মুসা (আ.) ও তাঁর সঙ্গীদেরকে মিশর থেকে বহিস্কার করার জন্য তাড়া করে, তখন ফেরাউন তার বাহিনীসহ নীল দরিয়ায় ডুবে ধ্বংস হয়ে যায়। আর এভাবেই আল্লাহ তার ক্ষমতা প্রদর্শন করেন।

এভাবে মক্কার কাফেররা রাসূলুল্লাহ (সা.)কে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করলে তিনি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হন। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি মদিনায় সর্বপ্রথম ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করেন এবং ইসলাম প্রচারের কাজে প্রসার ঘটান।
পরবর্তীতে মক্কা বিজয়ের মধ্যদিয়ে রাসূল (স.) সম্মানিত হন এবং কাফেররা চরম অপমানিত হয়।

এ আয়াতে আল্লাহ আরো বলেন: ফেরাউনের ধ্বংসের পর বনী ইসরাইল জাতি নিজেদের দেশে বসবাস করতে লাগল এবং ফেরাউনের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেল। অবশ্য কেয়ামতের দিন এ দু’পক্ষকে একত্রে হাজির কোরে বিচার করা হবে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:
এক. অত্যাচারী শাসকদের ইচ্ছার ওপর নিজের সিদ্ধান্ত বহাল করা এবং তাদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয়া হচ্ছে আল্লাহর বিধান।
দুই. পার্থিব জীবনে সব কাজের প্রতিফল দেয়া সম্ভব নয়। তাই আল্লাহ কেয়ামতের দিন সবাইকে হাজির করে সঠিক বিচার করবেন এবং যার যার প্রাপ্য অনুযায়ী পুরস্কার ও শাস্তি দেবেন।

সূরা বনী ইসরাইলের ১০৫ ও ১০৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَبِالْحَقِّ أَنْزَلْنَاهُ وَبِالْحَقِّ نَزَلَ وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا مُبَشِّرًا وَنَذِيرًا (105) وَقُرْآَنًا فَرَقْنَاهُ لِتَقْرَأَهُ عَلَى النَّاسِ عَلَى مُكْثٍ وَنَزَّلْنَاهُ تَنْزِيلًا (106)
“আমি সত্যসহ কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং তা সত্যসহ অবতীর্ণ হয়েছে। আমি তো পাপীদের জন্য তোমাকে প্রেরণ করেছি কেবলমাত্র সুসংবাদদাতা ও সর্তককারীরূপে।” (১৭:১০৫)
“এবং আমি তো কুরআনকে খণ্ড খণ্ড রূপে ভাগ করেছি যাতে তুমি তা মানুষের সামনে ধাপে ধাপে আবৃত্তি করতে পার। আমি তা (যথাযথভাবেই) ধাপে ধাপে অবতীর্ণ করেছি।” (১৭:১০৬)

হযরত মুসা (আ.) ও ফেরাউনের ঘটনা বর্ণনা করার পর এ আয়াতে আবারও পবিত্র কুরআন ও বিশ্বনবীর রেসালতের মর্যাদার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এ কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিল হয়েছে যাতে কোনো সন্দেহ নেই। অনুরূপভাবে এটি হযরত জিব্রাইলের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহর প্রতি নাজিল হয়েছে বলে এতে কোনো ধরনের বিকৃতি ঘটেনি। রাসূল (সা.)ও এ কুরআন প্রচারের সময় কোনোরকম বিকৃতি ছাড়াই তা প্রচার করেছেন। তাই এ কুরআনের বিষয়বস্তুতে কোনো ধরনের সন্দেহের অবকাশ নেই।

এ আয়াতে আল্লাহ আরো বলেন: মানুষের মনে যাতে পবিত্র কুরআনের উচ্চ অর্থবোধক বাণী গেঁথে যায় এবং তারা সহজে বুঝতে পারে তাই আমি এটি ধাপে ধাপে অবতীর্ণ করেছি। একটি একটি করে আয়াত ও একটি একটি করে সূরা নাজিল করেছি। এভাবে আল্লাহ তার নির্দেশাবলী মানুষে ধারণক্ষমতা অনুযায়ী নাজিল করেন যাতে তারা সহজে বুঝতে পারে। হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সব নবী-রাসূলের কাছে আসমানি কিতাব পাঠানোর ধরন দেখেও বোঝা যায়, মহান আল্লাহ ধাপে ধাপে তার বাণী মানব জাতির কাছে পাঠিয়েছেন এবং শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর যুগে এসে এই বাণী পরিপূর্ণতা পেয়েছে।
কাজেই ধীরে ধীরে কুরআন অবতীর্ণ হওয়া এই মহাগ্রন্থের কোনো দুর্বলতা নয় বরং এটি পবিত্র কুরআনের শক্তিশালী দিক। কাফেররা পুরো কুরআন একবারে নাজিল করার যে দাবি জানিয়েছিল, তারই জবাবে এ উত্তর দেয়া হয়েছে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:
এক. পবিত্র কুরআনের বিশুদ্ধতা আল্লাহ নিজের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করেছেন এবং তাঁর বাণী সঠিকভাবেই মানুষের কাছে পৌঁছেছে।
দুই. শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ হতে হবে ধাপে ধাপে বিভিন্ন পর্যায়ে। এর ফলে তা মানুষ উপলব্ধি করতে ও তা থেকে উপকৃত হতে পারবে।
তিন. ধীরে ধীরে সব কাজ করা আল্লাহর রীতি। তিনি এক মুহূর্তে পুরো বিশ্বজগত সৃষ্টি করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি তা ৬ ধাপে সৃষ্টি করেন। পবিত্র কুরআনও একত্রে এক সময়ে নাজিল করাও আল্লাহর পক্ষে কোনো কষ্টকর ব্যাপার ছিল না। কিন্তু তিনি তা দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে অবতীর্ণ করেন।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

 

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন