সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৯৪-৯৭
সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৯৪-৯৭
সূরা বনী ইসরাইলের ৯৪ তম আয়াতে আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেছেন:
وَمَا مَنَعَ النَّاسَ أَنْ يُؤْمِنُوا إِذْ جَاءَهُمُ الْهُدَى إِلَّا أَنْ قَالُوا أَبَعَثَ اللَّهُ بَشَرًا رَسُولًا (94)
“যখন জনগণের কাছে পথনির্দেশ আসে, তখন শুধুমাত্র একটি বিষয় তাদেরকে ঈমান আনা থেকে বিরত রাখে। আর তা হচ্ছে- তারা বলে: আল্লাহ্ কি আমাদেরই মত একজন লোককে তাঁর রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছেন?"(১৭:৯৪)
আগের আসরে আমরা বলেছি, মক্কার কাফেররা ঈমান আনার শর্ত হিসেবে বিশ্বনবীকে বলত: তুমি আল্লাহ এবং ফেরেশতাদেরকে দুনিয়াতে নিয়ে এসো, আমরা তাদেরকে দেখব; অথবা তুমি নিজে আসমানে চলে যাও এবং আমাদের জন্য কিতাব নিয়ে এসো, আমরা ওই কিতাব পড়ে দেখার পর ঈমান আনব। আর এ আয়াতে এসব অজুহাতের মূল কারণ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। কাফেরদের ধারনা ছিল, আল্লাহ অথবা আল্লাহর ফেরেশতারা সরাসরি এসে তাদের সঙ্গে কথা বলবেন এবং হেদায়েত দান করবেন। কিন্তু আল্লাহতায়ালা মানুষের হেদায়েতের জন্য মানুষের মধ্য থেকেই একজনকে রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছেন, যাতে মৌখিক আহ্বানের পাশাপাশি তিনি নিজের ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের সামনে আদর্শ স্থাপন করতে পারেন। মানুষকে তিনি দেখিয়েছেন যে, তিনি তাদের মতই একজন মানুষ। তিনি যা কিছু বলেন তা নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করেন। কাজেই অন্য মানুষের পক্ষেও এসব বিধিনিষেধ পালন করা সম্ভব।
অন্য ভাষায় বলা যায়, কাফেররা যে বিষয়টিকে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর দুর্বলতা ভাবত প্রকৃতপক্ষে সেটি ছিল তাঁর শক্তিশালী দিক। কারণ, সব ধরনের মানবীয় প্রবৃত্তি নিজের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তিনি পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত হতে পেরেছিলেন।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
এক. রাসূল (স.) এর যুক্তিসঙ্গত কথা অমান্য করার জন্য যদি কেউ অজুহাত খোঁজে তাহলে সে নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর ফলে সে হেদায়েত থেকে বঞ্চিত হবে।
দুই. পৃথিবীতে মানুষের মর্যাদা এতটা উঁচু হতে পারে যে সে আল্লাহ-তায়ালার পক্ষ থেকে রেসালাতের দায়িত্ব পর্যন্ত লাভ করতে পারে।
সূরা বনী ইসরাইলের ৯৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قُلْ لَوْ كَانَ فِي الْأَرْضِ مَلَائِكَةٌ يَمْشُونَ مُطْمَئِنِّينَ لَنَزَّلْنَا عَلَيْهِمْ مِنَ السَّمَاءِ مَلَكًا رَسُولًا (95)
“হে রাসূল! (আপনি ওদের) বলুন: "যদি পৃথিবীতে শান্ত ও নিশ্চিন্তভাবে বিচরণ করা ফেরেশতাদের জন্য নির্দিষ্ট করা হতো;তাহলে অবশ্যই আমি তাদের জন্য আসমান থেকে কোনো ফেরেশতাকেই নবী করে পাঠাতাম।" (১৭:৯৫)
আগের আয়াতের সঙ্গে মিল রেখে মক্কার মুশরিকদের অজুহাত সৃষ্টির প্রতিক্রিয়ায় এ আয়াতে আল্লাহ বলেন: যদি পৃথিবীতে মানুষের জায়গায় ফেরেশতারা বসবাস করত তাহলে তাদের হেদায়েতের জন্য ফেরেশতাদেরকেই নবী করে দুনিয়াতে পাঠাতাম। আল্লাহর নিয়ম হচ্ছে, মানুষের জন্য মানুষকেই রাসূল করে পাঠানো; যাতে মৌখিকভাবে দাওয়াত দেয়ার পাশাপাশি নিজ ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষকে পরিপূর্ণ মানব হওয়ার আদর্শ দেখাতে পারেন।
এ আয়াতে মানুষের জন্য নবী-রাসূল পাঠানোর প্রয়োজনীয়তার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন: যদি পৃথিবীর সব বাসিন্দা ফেরেশতা হত, আর সবাই সুখে-শান্তিতে জীবন-যাপন করত, তারপরও তাদের কাছে কোনো ফেরেশতাকে নবী করে পাঠাতাম। কারণ পরিপূর্ণতার বিষয়টি শুধুমাত্র সুখ-শান্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং বান্দাকে আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতাও অর্জন করতে হবে যা নবী-রাসূলের উপস্থিতি ও তাঁদের দিক-নির্দেশনা ছাড়া সম্ভব নয়।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল :
এক. কাউকে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য প্রয়োজন তারই সম-মর্যাদার শিক্ষক। তা না হলে শুধুমাত্র মুখের কথায় ফল পাওয়া যাবে না।
দুই. বান্দার হেদায়েতের জন্য নবী-রাসূল পাঠানোকে আল্লাহ নিজের জন্য বাধ্যতামূলক রীতি করে নিয়েছেন।
সূরা বনী ইসরাইলের ৯৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন :
قُلْ كَفَى بِاللَّهِ شَهِيدًا بَيْنِي وَبَيْنَكُمْ إِنَّهُ كَانَ بِعِبَادِهِ خَبِيرًا بَصِيرًا (96)
“হে রাসূল (আপনি ওদের) বলুন: তোমাদের ও আমার মাঝে সাক্ষী হিসেবে আল্লাহ-ই যথেষ্ট। তিনি তাঁর বান্দাদের সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন এবং সব কিছু দেখেন।" (১৭:৯৬)
আল্লাহ-তায়ালা এ আয়াতে কাফেরদের অযৌক্তিক অজুহাত ও গোঁড়ামির বিপরীতে রাসূল (সা.)কে সান্ত্বনা দেন। তিনি বলেন, তাদের এ ধরনের অযৌক্তিক কথায় আপনি কষ্ট পাবেন না; বরং তাদের বলুন: তোমাদের ঈমান আনা বা না আনায় আমার কিছু যায় আসে না এবং তোমাদের সমর্থনেরও কোনো প্রয়োজন আমার নেই। তোমরা ঈমান আনো বা না আনো, আমার সম্পর্কে আল্লাহ ভালভাবেই জানেন। তিনি আমার রেসালতের প্রত্যক্ষদর্শী।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
এক. নবী-রাসূলরা আল্লাহর ওপর ভরসা করেন বলে নিজেদের কথার ওপর অবিচল থাকেন এবং শত্রুদের বিরোধিতার তোয়াক্কা করেন না।
দুই. নবী-রাসূল, মুমিন ও কাফের সবার কাজের প্রতি আল্লাহর দৃষ্টি রয়েছে। কোনো কিছুই আল্লাহর অজানা থাকে না।
সূরা বনী ইসরাইলের ৯৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন :
وَمَنْ يَهْدِ اللَّهُ فَهُوَ الْمُهْتَدِ وَمَنْ يُضْلِلْ فَلَنْ تَجِدَ لَهُمْ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِهِ وَنَحْشُرُهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى وُجُوهِهِمْ عُمْيًا وَبُكْمًا وَصُمًّا مَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ كُلَّمَا خَبَتْ زِدْنَاهُمْ سَعِيرًا (97)
“আল্লাহ যাকে পথ নির্দেশ করেন সেই তো সত্য পথ প্রাপ্ত। কিন্তু তিনি যাদের বিপথে ছেড়ে দেন,তুমি তাদের জন্য আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে রক্ষাকারী পাবে না। শেষ বিচারের দিনে আমি তাদের সমবেত করব নতমুখে,অন্ধ,বোবা এবং বধির অবস্থায়। তাদের আবাসস্থল হবে জাহান্নাম। যখনই সেখানকার আগুন থেমে আসবে তখনই আমি তার প্রচণ্ডতা বাড়িয়ে দেব।” (১৭:৯৭)
রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গে কাফেরদের তর্ক-বিতর্কের পর আল্লাহ-তায়ালা এই আয়াতে তাঁর একটি সামগ্রিক নীতি ঘোষণা করেন। তিনি বলেন: যে ব্যক্তি নবী-রাসূলদের মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো বার্তা গ্রহণ করে হেদায়েত লাভ করে সেই প্রকৃতপক্ষে সঠিক পথপ্রাপ্ত হয়েছে। অন্যদিকে যে ব্যক্তি নবী-রাসূলদের বিরুদ্ধাচরণ করবে সে নিশ্চিতভাবে পথভ্রষ্ট হবে। আর সে যদি নিজে আল্লাহর পথে ফিরে না আসে তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত পুরুষরাও তাদেরকে হেদায়েত করতে পারবে না। যারা নবী-রাসূলদের কথা শুনবে না তারা শেষ বিচারের দিনে নতমুখে,অন্ধ,বোবা এবং বধির অবস্থায় আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে। দুনিয়ায় কৃতকর্মের জন্য তাদের চিরস্থায়ী আবাস হবে জাহান্নামের আগুন।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
এক. নবী-রাসূলদের প্রদর্শিত পথ ছেড়ে যারা অন্য কাউকে নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছে তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।
দুই. দুনিয়াতে মানুষ যে কাজ করেছে আখেরাতে তারই প্রতিদান পাবে। আমরা দুনিয়াতে যে ধরনের কাজ করব কেয়ামতের দিন আমাদেরকে সেই ধরনের চেহারা নিয়ে পুনরুত্থিত হতে হবে।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন