সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৮৫-৮৮

সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৮৫-৮৮


সূরা বনী ইসরাইলের ৮৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الرُّوحِ قُلِ الرُّوحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّي وَمَا أُوتِيتُمْ مِنَ الْعِلْمِ إِلَّا قَلِيلًا (85)
“এরা তোমাকে রূহ সম্পর্কে প্রশ্ন করছে৷ বলে দাও,এ রূহ আমার রবের হুকুমে আসে কিন্তু তোমরা সামান্য জ্ঞানই লাভ করেছো।” (১৭:৮৫)

নবী কারিম (সা.) সবসময়ই জনগণের বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতেন এবং তিনি প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিয়ে মানুষের জ্ঞানের চাহিদা মেটাতেন। মুমিনগণও দ্বীনকে সঠিকভাবে জানার জন্যে নবীজীর কাছে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন রাখতেন। কিন্তু বিরোধীরা অর্থাৎ কাফির মুশরিকরা জনগণের মাঝে দ্বিধা-সন্দেহ জাগিয়ে তোলার জন্যে এবং তাদের মাঝে রাসূলের অবস্থান দুর্বল করার জন্যে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করত। এই আয়াতে তেমনি একটি প্রশ্নের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছেঃ রূহ সম্পর্কে নবীজীকে প্রশ্ন করা হতো। পবিত্র কুরআনে অন্তত বিশবার ‘রূহ’ শব্দটি তিনটি প্রসঙ্গে এসেছে। প্রথমত ‘রূহ’ হলো সেই অলৌকিক বস্তু যা মানুষের ভেতর ফুঁ দিয়ে প্রাণের সঞ্চার করা হয়। দ্বিতীয়ত ‘রূহ’ শব্দটি ওহীর দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতা হযরত জিব্রাইল (আ.) এর প্রসঙ্গে এসেছে। তৃতীয়ত ‘রূহ’ শব্দটি এসেছে স্বয়ং কুরআন এবং আল্লাহর ওহী সম্পর্কে, যেই ওহী রাসূলে খোদার ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল। রূহ অর্থ হলো প্রাণ। আর যে তিনটি প্রসঙ্গে এই ‘রূহ’ শব্দটি এসেছে প্রতিটি প্রসঙ্গই মানুষের জীবন এবং মানব সমাজের প্রাণের উৎস।

প্রশ্নকারীরা রাসূলে খোদাকে মানুষের ‘রূহ’ সম্পর্কে প্রশ্ন করত যে ‘রুহ’ জিনিসটা আসলে কী বা কেমন? কিংবা প্রশ্ন করত যেই ফেরেশতা কুরআন অবতীর্ণ করার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন, সেই ফেরেশতা কীভাবে নবীজীর ওপর ওহী নাযিল করতেন?

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নবীজীকে বললেনঃ প্রশ্নকারীদের ঐসব প্রশ্নের জবাবে বলুন! ‘রূহ’ বস্তুগত কিংবা অনুভবগ্রাহ্য কোনো জিনিস নয় যে তোমরা তা উপলব্ধি করতে পারবে, বরং রূপ সম্পূর্ণ অবস্তুগত একটি জিনিস যা আল্লাহ পাক সৃষ্টি করেছেন এবং রূহ বিষয় কী বা কেমন তা তোমাদের উপলব্ধি ক্ষমতার বাইরে। এই বিশ্বভূবনের সত্যাসত্য সম্পর্কে তোমাদের জ্ঞান খুবই সীমিত এবং উপলব্ধি ক্ষমতাও যৎসামান্য। তোমরা ভেব না যে তোমরা সবকিছুই জানো কিংবা জানতে সক্ষম।

এ আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ
এক. রূহ হচ্ছে একটি জটিল এবং অজানা অচেনা বিষয়। রূহ ঐশী রহস্যের এমন একটি প্রসঙ্গ যা মানবীয় জ্ঞানের উর্ধ্বে।
দুই. মানবীয় সকল জ্ঞানই আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্যে একটি উপহারমাত্র।

সূরা বনী ইসরাইলের ৮৬ ও ৮৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَلَئِنْ شِئْنَا لَنَذْهَبَنَّ بِالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ ثُمَّ لَا تَجِدُ لَكَ بِهِ عَلَيْنَا وَكِيلًا (86) إِلَّا رَحْمَةً مِنْ رَبِّكَ إِنَّ فَضْلَهُ كَانَ عَلَيْكَ كَبِيرًا (87)
“আর হে মুহাম্মদ! আমি চাইলে আপনার কাছ থেকে সবকিছুই ছিনিয়ে নিতে পারতাম, যা আমি ওহীর মাধ্যমে আপনাকে দিয়েছি, তারপর আপনি আমার মোকাবেলায় কোনো সহায়ক পাবেন না, যে তা ফিরিয়ে আনতে পারে৷” (১৭:৮৬)
“এই যে যা কিছু আপনি লাভ করেছেন, এসব আপনার রবের হুকুম, আসলে তাঁর অনুগ্রহ আপনার প্রতি অনেক বড়।”(১৭:৮৭)

এ দুই আয়াতে নবীজীকে একদিকে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে অপরদিকে সতর্কও করা হয়েছে। একত্ববাদের ব্যাপারেই ছিল এই প্রেরণা বা সতর্কতা। এ আয়াত দু’টিতে আরো বলা হয়েছে নবুয়্যত, ওহী এবং পয়গাম্বরির সমাপ্তি সবকিছুই ঐশী ফযীলত এবং দয়া বা অনুগ্রহমাত্র। আসলে নবীজীর নিজস্ব বলতে কিচ্ছু নেই যা কিছু তাঁর মাঝে ছিল সবকিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া অনুগ্রহ। আল্লাহ চাইলে যা কিছুই তিনি নবীজীকে দান করেছেন সবকিছুই ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন।
তবে নিঃসন্দেহে একথা সত্য যে নবীজী কখনো কোনোধরনের ভুল করেন নি কিংবা আয়াতগুলো নাযিল হবার ব্যাপারে অহেতুক কোনোরকম সন্দেহ করেন নি। বরং আল্লাহ পাকেএইসব আয়াত নাযিলের মধ্য দিয়ে চেয়েছেন মুমিনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে যে, নবীজী সম্পর্কে যেন কোনোরকম উগ্রতা কিংবা চরমপন্থা অবলম্বন করা না হয়, যেভাবে খ্রিস্টানরা ঈসা (আ.) এর প্রশংসা করতে গিয়ে চরমপন্থা অবলম্বন করেছিল কিংবা অতিশয়োক্তি করেছিল।

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলোঃ
এক. আল্লাহর নিয়ামত বা অনুগ্রহের স্থায়িত্ব কিংবা অবক্ষয় আল্লাহর হাতে ন্যস্ত। তাই নিজেদের সম্পদ নিয়ে বড়াই কিংবা অহংকার করা অনুচিৎ। কেননা আল্লাহ চাইলে মুহূর্তের মধ্যেই সবকিছুই হাতছাড়া করে ফেলতে পারি।
দুই. কুরআন আল্লাহর মহান অনুগ্রহগুলোর অন্যতম। প্রথমত নবীজী এবং তারপর সকল মানুষ ঐশী এই অনুগ্রহের শামিল।

এই সূরার ৮৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قُلْ لَئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى أَنْ يَأْتُوا بِمِثْلِ هَذَا الْقُرْآَنِ لَا يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا (88)
“বলে দাও, যদি মানুষ ও জিন সবাই মিলে কুরআনের মতো কোনো একটি জিনিস আনার চেষ্টা করে তারা তা আনতে পারবে না, তারা পরস্পরের সাহায্যকারী হয়ে গেলেও।” (১৭:৮৮)

আগের আয়াতে বলা হয়েছিলঃ কুরআন নবীজীর পক্ষ থেকে নয় বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। আল্লাহ যদি চান তাহলে নবীজীর কাছ থেকে তা নিয়েও যেতে পারতেন। ঐ আয়াতেরই ধারাবাহিকতায় বলা হচ্ছেঃ কোনো কোনো বিরাধীপক্ষ কীভাবে কুরআনকে নবীজী কিংবা অন্যান্য মানুষের সাথে সম্পর্কিত বলে! অথচ কেবল মানুষই নয় বরং জ্বীনেরাও যদি একত্রিত হয়ে মানুষকে সহযোগিতা করে তারপরও কুরআনের মতো এমনকি একটি কালামও আনতে পারবে না। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে কুরআন হচ্ছে স্রষ্টার বাণী আর সকল মানুষ ও জ্বীনজাতি সেই স্রষ্টারই সৃষ্টি। যদি সকল মানুষ ও জ্বীন একত্রিত হয় তাহলেও তাদের পক্ষে কি এমন কোনো কিছু করা সম্ভব যার ফলে আল্লাহর সাহায্য সহযোগিতা না নিয়ে পারা যাবে?

অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমান পৃথিবীর ধর্মনিরপেক্ষতার নামধারী সেক্যুলার ব্যবস্থাগুলো আল্লাহর ওহীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে না। তাদের দাবি হলো সামষ্টিক জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে পৃথিবীর সকল সমস্যার সমাধান দেওয়া সম্ভব। তাদের ধারণা সামষ্টিক প্রজ্ঞা ওহীর মতোই মূল্যবান তাই তা ওহীর স্থলাভিষিক্ত হতে পারে। কুরআনে কারিম এ আয়াতে ঘোষণা করছেঃ কেবল সকল মানুষের সামষ্টিক প্রজ্ঞাই নয় বরং মানুষের সাথে যদি সমগ্র জ্বীন জাতিকেও কাজে লাগানো হয় তারপরও সেইসব প্রজ্ঞা কখনোই ঐশী জ্ঞানে সমৃদ্ধ ওহীর মতো হবে না।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ
এক. কুরআন হচ্ছে আল্লাহর চিরন্তন মোযেজা। এই কুরআন সবসময় বিরোধীদের চ্যালেঞ্জ করেছে যে যদি পার এ ধরনের একটি গ্রন্থ নিয়ে আসো। কুরআনের এই আহ্বান কেবল নবীজীর সমকালীন বিরোধীদের জন্যেই নির্দিষ্ট নয় বরং আজ পর্যন্তও এই চ্যালেঞ্জ প্রযোজ্য।
দুই. মানুষের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা-চাই তা ব্যক্তিগত কিংবা সামষ্টিকই হোক-ঐশী জ্ঞান কিংবা ওহীর মতো কিছু সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে না।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

 

 

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন