সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৮১-৮৪
সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৮১-৮৪
সূরা বনী ইসরাইলের ৮১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَقُلْ جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوقًا (81)
“আর ঘোষণা করে দাও, সত্য এসে গেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়ে গেছে, মিথ্যার তো বিলুপ্ত হবারই কথা।” (১৭:৮১)
এ আয়াতটিতে ইসলামের নবীকে উদ্দেশ্য করে এবং তাঁকে দায়িত্ব দিয়ে বলা হয়েছেঃ আপনি সুসংবাদ দিয়ে দিন যে সথ্যের বিজয় হয়েছে আর বাতিলের বিলুপ্তি ঘটে গেছে। এ আয়াতে মুমিনদেরকে সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে যে, শত কষ্ট আর প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ভবিষ্যতের ব্যাপারে যেন আশাবাদী হয় এবং বাতিল শক্তির বাহ্যিক জাকজমক সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তার পরাজয় ঘটবেই এবং তার আর অস্তিত্বই থাকবে না। ‘হক’ মানেই হলো স্থায়ী। যেহেতু একমাত্র সত্ত্বা আল্লাহর অস্তিত্বই স্থায়ী এবং অবিচল আর সবকিছুই পরিবর্তনশীল। সেজন্যে আল্লাহর একটি নাম হলো হক। অবশ্য তাঁর পক্ষ থেকে যা কিছুই অবতীর্ণ হয় সবই হক অর্থাৎ দৃঢ় এবং চিরস্থায়ী।
এ আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ
এক. সত্যের স্থায়িত্ব আর বাতিলের ধ্বংস একটা ঐশী নীতি, যারাই সত্যের অনুসারী তাদের সংখ্যা সামান্য আর বাতিলের অনুসারী অনেক।
দুই. সত্যের আগমনে বাতিলের বিলুপ্তি ঘটে। তাই সত্যের অনুসারীদের উচিত সমাজে সত্য ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালানো।
সূরা বনী ইসরাইলের ৮২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآَنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ وَلَا يَزِيدُ الظَّالِمِينَ إِلَّا خَسَارًا (82)
“আমি এ কুরআনের অবতরণ প্রক্রিয়ায় এমন সব বিষয় অবতীর্ণ করছি যা মুমিনদের জন্য নিরাময় ও রহমত এবং জালিমদের জন্য ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করে না।” (১৭:৮২)
আগের আয়াতে সত্যের স্থায়িত্ব আর মিথ্যার বিলোপের কথা বলা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় এ আয়াতে হকের সুস্পষ্ট একটি মানদণ্ডের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে, যে কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে, তা কেবল হকের অনুসারী অর্থাৎ মুমিনদের জন্যেই কল্যাণকর ও উপকারী। তাঁরা কুরআনের আলোকে নূর এবং হেদায়াত থেকে উপকৃত হন এবং এর সাহায্যে তাঁদের আত্মিক রোগব্যাধির নিরাময়ের পাশাপাশি আল্লাহর বিশেষ রহমতের অন্তর্ভুক্ত হন। তবে কাফের মুশরিকরা এবং বিরোধীরা কুরআনের সত্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাদের নিজেদের আত্মাকে কালিমালিপ্ত করে এবং ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমনটি উর্বর জমিতে বৃষ্টির পানির ফলে ফসল ভালো হয় অথচ ঐ বৃষ্টির পানিই যদি লোনা জমিতে পড়ে তাহলে ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ নেই।
তবে কুরআন কেবলমাত্র মানুষের অন্তরাত্মারই নিরাময় করে না বরং বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে মানুষের শারীরিক অনেক রোগব্যাধিও ভালো হয়ে যায়।
এ আয়াত থেকে আমরা শিখবোঃ
এক. আল্লাহর ওপর ঈমান আনার মধ্য দিয়ে আল্লাহর বিশেষ রহমত ও দয়া লাভ করার ক্ষেত্র তৈরি হয়।
দুই. কাফেররা যেহেতু ঐশী আদেশ অনুযায়ী চলে না, সেহেতু তাদের বিরোধিতা তাদের অপরাধের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং তাদের কুফরির পরিমাণও বৃদ্ধি করে। পরিণতিতে তাদের ক্ষতির মাত্রাও বেড়ে যায়।
সূরা বনী ইসরাইলের ৮৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَإِذَا أَنْعَمْنَا عَلَى الْإِنْسَانِ أَعْرَضَ وَنَأَى بِجَانِبِهِ وَإِذَا مَسَّهُ الشَّرُّ كَانَ يَئُوسًا (83)
“যখনই আমি মানুষকে নিয়ামত দান করি তখনই তারা গর্ব ভরে ঘাড় ফিরিয়ে নেয় আর যখনই সামান্য বিপদের মুখোমুখি হয় তখনই হতাশ হয়ে যায়।” (১৭:৮৩)
এ আয়াতে ঐশী এবং দ্বীনি প্রশিক্ষণহীন মানুষের আরেকটি স্বাভাবিক প্রবণতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে যেহেতু সকল নিয়ামতই আল্লাহর পক্ষ থেকে, কিন্তু অহংকারের বশবর্তী হয়ে বহু মানুষ নিয়ামত দানকারীকে ভুলে যায়। এমনকি আল্লাহর বরাবরে অহংকারের সাথে দাঁড়ায় এবং তাঁর আদেশ নিষেধের বিরোধিতা করে। স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের লোকেরা বিপদে পড়লে শক্ত কোনো নির্ভরতা না থাকার কারণে নিজেদের হাত পা গুটিয়ে নেয় এবং হতাশ পয়ে পড়ে। কিন্তু ঈমানদারগণ আল্লাহর ওপর নির্ভর করে সকল প্রকার প্রতিকূলতার মোকাবেলা করে এবং কখনোই ভবিষ্যতের ব্যাপারে হতাশ হয় না।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ
এক. মানুষ সাধারণত আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার পরিবর্তে তার অর্জনগুলোকে নিজস্ব মেধা ও শ্রমের ফসল বলে মনে করে এবং আল্লাহকে ভুলে যায়। বহু মানুষের ভেতরেই এই অনুভূতি কাজ করে থাকতে পারে।
দুই. আল্লাহর সাহায্য ব্যতিত মানুষ খুবই দুর্বল। কম মেধা সম্পন্ন মানুষেরা নিজেদের কল্যাণের ব্যাপারে উদাসীন থাকে আর বিপদাপদে হতাশ হয়ে পড়ে।
সূরা বনী ইসরাইলের ৮৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قُلْ كُلٌّ يَعْمَلُ عَلَى شَاكِلَتِهِ فَرَبُّكُمْ أَعْلَمُ بِمَنْ هُوَ أَهْدَى سَبِيلًا (84)
“হে নবী! এদেরকে বলে দাও, প্রত্যেকে নিজ নিজ স্বভাব প্রবণতা অনুযায়ী কাজ করছে, একমাত্র তোমাদের রবই ভালো জানেন কে সরল সঠিক পথে আছে।” (১৭:৮৪)
এ আয়াতে মানুষের কাজে কর্মে এবং আচার আচরণে তাঁদের সৃজনশীলতার প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছেঃ সৃজনশীলতা এবং মানুষের ভেতরকার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মানুষ তাদের জীবন পদ্ধতি, তাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম আচার আচরণ করে থাকে। তবে এই সৃজনশীলতা নির্ভর করে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি চালিকাশক্তির ওপর। একটি হলো উত্তরাধিকার এবং অপরটি প্রশিক্ষণ। প্রথম বৈশিষ্ট্যটি অর্জিত হয় নিজ পরিবার থেকে আর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটি অর্জিত হয় পরিবার, সমাজ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। তবে বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ উভয় দিকের ওপর যে বিষয়টি প্রভাব বিস্তার করে তা হলো নিজের ইচ্ছাশক্তি। এই ইচ্ছাশক্তি উভয় দিকের ওপরই আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম। সবোর্পরি বলা যায় উত্তরাধিকার, প্রশিক্ষণ এবং ব্যক্তির ইচ্ছাশক্তিই আত্মগঠন করে এবং আচরণগত বৈশিষ্ট্য রচনা করে।
এ আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ
এক. মানুষের ব্যবহার বা আচরণের মধ্যেই তার নৈতিক, আত্মিক বৈশিষ্ট্য এবং ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন ঘটে।
দুই. অসৎ উদ্দেশ্য বা চিন্তা-চেতনা পাপ কিংবা অন্যায় আচরণের ক্ষেত্র তৈরি করে। সুতরাং অসৎ চিন্তা পরিত্যাগ করা উচিত।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন