সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৭৮-৮০
সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৭৮-৮০
সূরা বনী ইসরাইলের ৭৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
أَقِمِ الصَّلَاةَ لِدُلُوكِ الشَّمْسِ إِلَى غَسَقِ اللَّيْلِ وَقُرْآَنَ الْفَجْرِ إِنَّ قُرْآَنَ الْفَجْرِ كَانَ مَشْهُودًا (78)
“নামায কায়েম কর সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে নিয়ে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত এবং ফজরে কুরআন পড়ারও ব্যবস্থা কর, কারণ ফজরের কুরআন পাঠ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।” (১৭:৭৮)
এ আয়াতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সময়সূচির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে- দুপুর থেকে জোহরের সময় শুরু হয় এবং সূর্যাস্ত পর্যন্ত আসরের নামাযের সময় থাকে। আয়াতের শেষাংশে নামাযের শেষ সময়কে মধ্যরাত পর্যন্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ সময়সীমার মধ্যে মাগরিব এবং এশার নামায আদায় করার কথা বলা হয়েছে। এই চারটি নামায অর্থাৎ জোহর, আসর, মাগরিব এবং এশা পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত। মধ্যরাত্রি আসার সাথে সাথে এশার নামাযের সময়সীমা শেষ হয়ে যায় এবং ফযরের সময় পর্যন্ত মানুষের ওপর আর কোনো ফরয নামায পড়ার দায়িত্ব নেই। অবশ্য সূর্যোদয় পর্যন্ত ফযরের নামাযের সময় থাকে। হামদ এবং সূরার পর কুরআনের যে আয়াত তিলাওয়াত করা হয় তাকে ‘কুরআনুল ফাযর’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আয়াতের শেষাংশে এই মজার বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছেঃ সকালের নামাযটি দর্শনীয় অর্থাৎ দেখা যায়। বর্ণনা অনুযায়ী দর্শনীয় বলতে বোঝানো হয়েছে রাত এবং দিনের ফেরেশতাগণ এই নামায দেখেন। রাতের ফেরেশতাদের যাবার সময় হয় আবার দিনের ফেরেশতাদের আসার সময় হলো ফজরের সময়। তাই ফেরেশতাদের উভয় দলই ফযরের নামায আদায়কারীদের দেখেন।
এ আয়াত থেকে আমাদের জণ্যে শিক্ষণীয় হলোঃ
এক. শরয়ী বিধি-বিধানগুলোর মানদণ্ড হলো চাঁদ সূর্যের মতো প্রাকৃতিক সৃষ্টি। এর ফলে সকল মানুষের জন্যেই সেগুলো সহজলভ্য এবং সকল মানুষ তা বুঝতে এবং উপলব্ধি করতে পারে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের মানদণ্ডও তাই সূযোর্দয়, সূর্যের হেলে পড়া এবং সূর্যাস্তের মধ্য দিয়ে বিশ্বজনীন করে তোলা হয়েছে।
দুই. ইবাদাতকারীর দায়িত্ব পালনের সময়সূচি রয়েছে। এ থেকে যে বিষয়টি প্রমাণিত হয় তা হলো মানুষের উন্নয়ন ও বিকাশের জন্যে, তাদের মাঝে শৃঙ্খলা বিধানের জন্যে ইসলামের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ও কর্মসূচি রয়েছে।
সূরা বনী ইসরাইলের ৭৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَمِنَ اللَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَكَ عَسَى أَنْ يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَحْمُودًا (79)
“এবং ভোর রাত্রির কিছু অংশ কুরআন তিলাওয়াত আর নামায কায়েম করার মধ্য দিয়ে জাগ্রত থাকো। এটা তোমার জন্যে অতিরিক্ত দায়িত্ব। অচিরেই তোমার রব তোমাকে ‘প্রশংসিত স্থানে’ প্রতিষ্ঠিত করবেন৷(১৭:৭৯)
আগের আয়াতে পাঞ্জেগানা নামাযের সময়সূচির কথা বর্ণনা করার পর এ আয়াতে নবী কারিম (সা.) কে সম্বোধন করে বলা হয়েছেঃ অবশ্য আপনি পয়গাম্বর হিসেবে বাড়তি কিছু দায়িত্ব রয়েছে আপনার। আর সেই দায়িত্বটা হলো রাত জাগা। রাতের একটা অংশে ঘুম থেকে জেগে উঠে নামায এবং কুরআন পড়া উচিত যাতে আপনি মর্যাদার উচ্চ স্তরে পছন্দনীয় আসনে আসীন হতে পারেন। এ আয়াতে যদিও রাতের নামাযের নাম নেওয়া হয়নি এবং মূলত রাত জাগার কথা বলা হয়েছে, তবু বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী এর অর্থ কেবল রাত জাগাই নয় বরং রাতের নামায আদায় করাকেই নির্দেশ করা হয়েছে যার উদ্দেশ্য হলো তওবা এস্তেগফারের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা।
অবশ্য রাতের নামায পয়গাম্বরের ওপর ওয়াজিব ছিল আর অপরাপর মুমিনের ওপর ছিল মুস্তাহাব। তাছাড়া সূরায়ে মুদ্দাসসির এবং মুয্যাম্মিলের মতো কুরআনের অন্যান্য সূরাতেও রাতের নামাযের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। সূরা সিজদার ১৭ নম্বর আয়াতেও আল্লাহ পাক রাত জেগে ইবাদাতকারী বিশেষ করে নামায আদায়কারীদের উদ্দেশ্যে সুপ্ত এমন পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যা তাদের চোখের ঔজ্জ্বল্যের কারণ হবে এবং তাদের কেউই সেইসব পুরস্কার সম্পর্কে কোনো ধারণাই রাখে না।
আরো বহু বর্ণনায় রাতের নামাযের ইতিবাচক বহু দিকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। শারীরিক সুস্থতা, রুটি রুজি বৃদ্ধি, পাপমোচন, জনগণের মাঝে সম্মান ও আভিজাত্য লাভ করা ইত্যাদি। অবশ্য রাতের নামায পড়া আল্লাহর তৌফিক ছাড়া সম্ভব নয়, সেজন্যে সবার নসিবে তার সৌভাগ্য হয় না। এ সম্পর্কে হযরত আলী (আ.) বলেছেনঃ ‘দিনব্যাপী মানুষ যেসব গুনাহ বা পাপ করে, সেই পাপের কারণে রাতের নামায পড়ার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়।’
এ আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ
এক. মাঝরাতে সবাই যখন নিদ্রামগ্ন থাকে সেই নীরব সময়টিই হলো আল্লাহর সাথে প্রয়োজনীয় এবং ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার কথা বলার একান্ত সময়।
দুই. সেইসব মর্যাদাই মূল্যবান যা আল্লাহর কাছে পছন্দের। পার্থিব জগতের নাম যশ খ্যাতি নয় যা নশ্বর এবং ক্ষণস্থায়ী।
তিন. প্রশংসনীয় পর্যায়ে পৌঁছানোর উপায় হলো ইবাদাত ও বন্দেগি, যা মানবীয় পূর্ণতার সোপান।
সূরা বনী ইসরাইলের ৮০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَقُلْ رَبِّ أَدْخِلْنِي مُدْخَلَ صِدْقٍ وَأَخْرِجْنِي مُخْرَجَ صِدْقٍ وَاجْعَلْ لِي مِنْ لَدُنْكَ سُلْطَانًا نَصِيرًا (80)
“আর দোয়া কর : হে আমার পরওয়ারদিগার! আমাকে যেখানেই তুমি নিয়ে যাও সত্যবাদিতার সাথে নিয়ে যাও এবং যেখান থেকেই বের কর সত্যবাদিতার সাথে বের কর এবং তোমার পক্ষ থেকে একটি কর্তৃত্বশীল পরাক্রান্ত শক্তিকে আমার সাহায্যকারী বানিয়ে দাও।” (১৭:৮০)
এ আয়াতে ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ তথা সততা, সত্যবাদিতা এবং আমানতের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছেঃ সকল কাজের সূচনা এবং বাস্তবায়ন এবং সকল কর্মসূচির মানদণ্ড হতে হবে সত্য এবং সঠিক। আর তাহলেই আল্লাহ পাকও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন। আর মানুষও তাহলে সমস্যা ও সংকটকে উত্তীর্ণ করে পৌঁছে যাবে তার সঠিক লক্ষ্যে। তাই কাজের সূচনা এবং বাস্তবায়ন হওয়া উচিত সকল প্রকার গর্ব বা অহমিকা থেকে মুক্ত থেকে নিষ্ঠা ও পরিপূর্ণ সততার সাথে। কাজের পরিসমাপ্তি পর্যন্ত এই আন্তরিক সততা ও নিষ্ঠা অটুট থাকতে হবে।
এ আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ
এক. চিন্তা এবং কাজের একনিষ্ঠতার জন্যে এবং অহংকার থেকে দূরে থাকার জন্যে আল্লাহর দরবারে সবসময় দোয়া করতে হবে এবং তাঁর সাহায্য কামনা করতে হবে।
দুই. কাজের শুভ সূচনাতেই আনন্দিত হওয়া উচিত নয় বরং সকল কাজেরই শুভ সমাপ্তিতেই খুশি হওয়া উচিত যাতে পরিণতি দুর্ভাগ্যময় না হয়।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন