সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৬০-৬৩
সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৬০-৬৩
সূরা বনী ইসরাইলের ৬০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَإِذْ قُلْنَا لَكَ إِنَّ رَبَّكَ أَحَاطَ بِالنَّاسِ وَمَا جَعَلْنَا الرُّؤْيَا الَّتِي أَرَيْنَاكَ إِلَّا فِتْنَةً لِلنَّاسِ وَالشَّجَرَةَ الْمَلْعُونَةَ فِي الْقُرْآَنِ وَنُخَوِّفُهُمْ فَمَا يَزِيدُهُمْ إِلَّا طُغْيَانًا كَبِيرًا (60)
“এবং (স্মরণ করুন),আমি যখন আপনাকে বলে দিয়েছিলাম যে, আপনার পালনকর্তা মানুষকে পরিবেষ্টন করে রেখেছেন এবং যে স্বপ্ন আমি আপনাকে দেখিয়েছি তা ও কুরআনে উল্লেখিত অভিশপ্ত বৃক্ষ-এ দুইই কেবল মানুষের পরীক্ষার মাধ্যম ছিল। আমি তাদেরকে ভয় প্রদর্শন করতে থাকি। কিন্তু তা তাদের চরম ঔদ্ধত্যকেই বাড়িয়ে দিচ্ছে।” (১৭:৬০)
এ আয়াতের প্রথমেই মহান আল্লাহ ইসলামের নবী (সা.) ও মুমিনদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন এই বলে যে, তোমাদের সত্য বক্তব্যের মোকাবেলায় শত্রুদের কঠোরতা এবং গোঁড়ামি নতুন কোনো ব্যাপার নয়। মহান আল্লাহও এ ব্যাপারে সচেতন এবং তিনি যথাসময়ে এর জবাব দেবেন।
এরপর এখানে বিশ্বনবী (সা.)’র একটি স্বপ্নের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ বলছেন, এ স্বপ্ন পরীক্ষার মাধ্যম। পবিত্র কুরআনে রাসূল (সা.)’র দু’টি স্বপ্নের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একটি স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন বদর যুদ্ধের প্রাক্কালে। আর দ্বিতীয় স্বপ্নটি দেখেছিলেন মক্কা বিজয়ের সময় ও মসজিদুল হারামে প্রবেশের সময়। বদর যুদ্ধের প্রাক্কালে দেখা স্বপ্নটি ছিল মদীনায় বসবাসের সময়কার। আর এ স্বপ্নটি মক্কী যুগের। কারণ, সূরা বনী ইসরাইল বা আসরা মক্কী সূরা।
একই আয়াতে অভিশপ্ত গাছের কথা বলা হয়েছে। অন্য এক আয়াতে একে নোংরা গাছ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই গাছ বলতে একটি গোত্র বা বংশের কথা বলা হয়েছে যার রয়েছে শেকড় ও শাখা কিন্তু নোংরামি ছাড়া অন্য কিছু তারা দেয় না সমাজকে। তারা সব সময়ই অভিশাপ ও ঘৃণার পাত্র।
সুন্নি ও শিয়া সূত্রের ইসলামী বর্ণনায় এসেছে,কোনো এক সময় মহানবী (সা.) স্বপ্নে দেখেন যে, বনী উমাইয়ার লোকজন তাঁর মিম্বরে বানরের মত নাচানাচি করছে। এ স্বপ্ন দেখে তিনি এমনই শোকাহত হলেন যে, এরপর যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তিনি আর হাসেননি। রাসূল (সা.) জিবরাইলের মাধ্যমে জানতে পারেন যে এর অর্থ উমাইয়ারা নবী (সা.)’র খেলাফতের মসনদ দখল করবে।
তাফসিরে তাবারিসহ কয়েকটি সুন্নি সূত্রমতে, কুরআনে উল্লিখিত ওই ‘অভিশপ্ত বৃক্ষ’ বলতে আবু সুফিয়ানের বংশধর তথা উমাইয়াদের বোঝানো হয়েছে এবং রাসূল (সা.) স্বপ্নে তাঁর মিম্বরে বানরদের নাচানাচির যে ঘটনাটি দেখেছিলেন, তার অর্থ উমাইয়াদের মাধ্যমে খেলাফত দখল করা হবে।
ইতিহাস থেকে জানা যায় উমাইয়ারা এক হাজার মাস ইসলামী খেলাফত দখল করে রেখেছিল। আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)’র যুগে তাদের সৃষ্ট ফেতনা ও হযরত হাসান (আ.)কে বিষ-প্রয়োগের মাধ্যমে শহীদ করার ঘটনা ছিল উমাইয়াদেরই অন্যতম জঘন্য অপরাধ বা খোদাদ্রোহী আচরণ। তবে মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদের নির্দেশে তার বর্বর বাহিনীর হাতে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর পরিবারের প্রায় সব পুরুষ সদস্যের শাহাদত ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত খোদাদ্রোহী অপরাধ। কারবালায় নবী (সা.) পরিবারের পুরুষ সদস্যদের মধ্যে কেবল হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন।
এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
এক. মহান আল্লাহ কখনও কখনও নবী-রাসূল বা তাঁর প্রিয় বান্দাদেরকে স্বপ্নের মাধ্যমে নানা বিষয়ে অবগত করেন।
দুই. মহান আল্লাহ নিজেই কিংবা তাঁর নবী-রাসূলগণের মত পবিত্র ব্যক্তিরাও যেসব সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন তা অপবিত্র অন্তরে প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়, বরং তারা এইসব উপদেশ ও সতর্কবাণীর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং আরো বেশি খোদাদ্রোহী আচরণে লিপ্ত হয়।
সূরা বনী ইসরাইলের ৬১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآَدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ قَالَ أَأَسْجُدُ لِمَنْ خَلَقْتَ طِينًا (61)
“স্মরণ কর,যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বললামঃ আদমকে সিজদা কর, তখন ইবলিস ছাড়া সবাই সিজদা করল। ইবলিস বললঃ আমি কি এমন ব্যক্তিকে সিজদা করব, যাকে আপনি কাদামাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন?” (১৭:৬১)
অভিশপ্ত বৃক্ষের কথা বলার পর এ আয়াতে আল্লাহ বলছেন: খোদায়ী নির্দেশ অমান্য করার ও এ নির্দেশের মোকাবেলায় অহংকার দেখানোর পরিপূর্ণ দৃষ্টান্ত হল ইবলিস বা শয়তান। অভিশপ্ত শয়তান ছাড়াও যে কোনো খোদাদ্রোহীর স্বভাব হল, অন্যদের অপমান করা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা। শয়তান নিজেকে বড় হিসেবে তুলে ধরার জন্য বলেছিল: আমি (আগুনের তৈরি হওয়া সত্ত্বেও) সিজদা করব মাটির তৈরি আদমকে!
এই আধুনিক যুগেও জালিম ও তাগুতি শাসকরা নিজেদেরকে সাধারণ মানুষের চেয়ে বড় মনে করে। তাই তারা জনগণের কাছে বিনয় প্রকাশের পরিবর্তে নিজেদেরকে উচ্চ শ্রেণীর বলে জাহির করে। অন্যদিকে নবী-রাসূলরা জনগণের সামনেও সর্বোচ্চ মাত্রায় বিনয়ী ছিলেন।
এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
এক. আল্লাহর নির্দেশ বিনম্র চিত্তে মেনে নেয়া হল ফেরেশতাসুলভ গুণের নিদর্শন। আর আল্লাহর নির্দেশের মোকাবেলায় নানা অজুহাত দেখানো ও নির্দেশ অমান্য করার ধৃষ্টতা দেখানো ইবলিসি স্বভাবের লক্ষণ।
দুই. ইবলিস বা শয়তান নিজেকে বড় মনে করত এবং আদম (আ.)-কে হিংসা করত। ইবলিস এই হিংসা ও অহংকারের কারণেই হযরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টির ক্ষেত্রে মাটির উপাদান থাকার বিষয়টি লক্ষ্য করেছে, কিন্তু সে আদম (আ.)’র আত্মার দিকটি লক্ষ্য করেনি।
সূরা বনী ইসরাইলের ৬২ ও ৬৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قَالَ أَرَأَيْتَكَ هَذَا الَّذِي كَرَّمْتَ عَلَيَّ لَئِنْ أَخَّرْتَنِ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ لَأَحْتَنِكَنَّ ذُرِّيَّتَهُ إِلَّا قَلِيلًا (62) قَالَ اذْهَبْ فَمَنْ تَبِعَكَ مِنْهُمْ فَإِنَّ جَهَنَّمَ جَزَاؤُكُمْ جَزَاءً مَوْفُورًا (63)
“ইবলিস বলল: (হে আল্লাহ!) আপনি কি এ বিষয়ে লক্ষ্য করেছেন যে যাকে আপনি আমার ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিলেন? যদি আপনি আমাকে কিয়ামত পর্যন্ত সুযোগ দেন তাহলে তবে আমি অবশ্যই অতি অল্প সংখ্যক ব্যতীত আদমের বংশধরদের বিপথগামী ও মূলোৎপাটন করব।” (১৭:৬২)
“আল্লাহ (ইবলিসকে) বললেন: যাও, তাদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে, নিশ্চয়ই জাহান্নাম হল তাদের জন্য এক পূর্ণ শাস্তি।” (১৭:৬৩)
শয়তান যখন দেখল আদমকে সিজদা করার খোদায়ী নির্দেশ অমান্য করার কারণে তাকে আল্লাহর দরবার থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে তখন সে বলল : যদি আমাকে সময় দেয়া হয় তাহলে আমি কেবল অতি অল্প সংখ্যক উন্নত স্বভাবের মানুষ ছাড়া কিয়ামত পর্যন্ত প্রায় সব আদম-সন্তানকে পথভ্রষ্ট ও নির্মূল করব। ওই অল্প সংখ্যক উন্নত স্বভাবের মানুষকে আমি কাবু করতে পারব না।
মহান আল্লাহ মানুষের উন্নয়ন বা বিকাশ ও তাদের পরিপূর্ণতার জন্য স্বাধীনতা দেয়ার মাধ্যমে পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। তাই আল্লাহ ইবলিসের প্রস্তাব মেনে নিয়ে বলেছেন: যারাই শয়তানের পথ অনুসরণ করবে তারাও ইবলিসের মতই জাহান্নামী হবে।
এ দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষা হল:
এক. শয়তান ছিল মানব সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষের শত্রু। তাই কসম-খাওয়া এ শত্রুর ব্যাপারে সব সময়ই সাবধান হতে হবে।
দুই. বেশির ভাগ মানুষই শয়তানের কুমন্ত্রণায় প্রভাবিত হয়।
তিন. মানুষ আল্লাহর নির্দেশ পালন করবে না শয়তানের কুমন্ত্রণা গ্রহণ করবে সে ব্যাপারে স্বাধীন।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন