সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৫৩-৫৫
সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৫৩-৫৫
সূরা বনী ইসরাইলের ৫৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
- وَقُلْ لِعِبَادِي يَقُولُوا الَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنْزَغُ بَيْنَهُمْ إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلْإِنْسَانِ عَدُوًّا مُبِينًا (53)
“আর হে মুহাম্মাদ! আমার বান্দাদেরকে বলে দাও, তারা যেন মুখে এমন কথা বলে যা সর্বোত্তম। আসলে শয়তান মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করে৷ প্রকৃতপক্ষে শয়তান হচ্ছে মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।” (১৭:৫৩)
ইতোপূর্বেও বহুবার বলেছি দ্বীনে ইসলামের কোনো কোনো আদেশ ঈমানদারদের সামাজিক শৃঙ্খলা বিধানের জন্যে এসেছে যাতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর সাথে বা বিভিন্ন গোষ্ঠির সাথে তাদের সম্পর্ক গড়ে তোলা বা আচরণ পদ্ধতি এমন হয় যার ফলে দ্বন্দ্ব সংঘাত দূর হয়ে শান্তি ও সংহতি সৃষ্টি হয়। কথা বলার পদ্ধতি সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সেজন্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ আয়াতে নবীজীকে সম্বোধন করে বলেছেনঃ কেবল ধর্মীয় দায়িত্ব আর ইবাদাত বন্দেগীর জন্যে মানুষকে দাওয়াত দেওয়ার ব্যাপারেই আপনি আদিষ্ট নন বরং আমার মুমিন বান্দাদেরকে বলুন তারা যেন সুন্দর করে কথা বলে যাতে শয়তান তাদের কথার অসদ্ব্যবহার করে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে।
কুরআনে কারিমে কথা বলা সম্পর্কে বহু আয়াত এসেছে। কোনো কোনো আয়াত কথা বলার বিষয়বস্তু কেন্দ্রিক আবার কোনো কোনো আয়াত এসেছে কথা বলার স্টাইল সম্পর্কে। যেহেতু আল্লাহ পাক সবচেয়ে উত্তম সেজন্যে আমাদের কাছ থেকেও সবোর্ত্তম কথাবার্তা এবং সবোর্ত্তম আচরণ প্রত্যাশা করেন।
এ আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ
এক. ভালো ও সুন্দর ভঙ্গিতে কথা বলা বন্ধুত্বের ক্ষেত্র সৃষ্টি করে আর কথা বলার অগ্রহণীয় ভঙ্গি শয়তানী প্ররোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
দুই. যারা নিজস্ব অনুমানের ওপর ভিত্তি করে সমাজের লোকজনের মাঝে শত্রুতা এবং মারামারি বাধায় তারা শয়তানের অনুগামী।
৫৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
رَبُّكُمْ أَعْلَمُ بِكُمْ إِنْ يَشَأْ يَرْحَمْكُمْ أَوْ إِنْ يَشَأْ يُعَذِّبْكُمْ وَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ وَكِيلًا (54)
“তোমাদের রব তোমাদের অবস্থা সম্পর্কে বেশী জানেন৷ তিনি চাইলে তোমাদের প্রতি দয়া করেন এবং চাইলে তোমাদের শাস্তি দেন৷ আর হে নবী! আমি তোমাকে লোকদের উকিল বা তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে পাঠাইনি৷” (১৭:৫৪)
অন্যদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করা, বাজে ভঙ্গিতে কথা বলার একটা কারণ হলো নিজেকে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে অহংকার করা, অর্থাৎ অন্যদেরকে ছোট বলে ভাবা। এই অযথার্থ আচরণের উৎস হতে পারে জ্ঞানের বড়াই কিংবা ধর্মীয় অহংকার। অনেকটা এ রকমঃ যেহেতু মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত আছি তাই মনে করি অবশ্যই বেহেশতে যাব এবং বিপক্ষীয়রা যেহেতু কাফের সেজন্যে তারা অবশ্যই দোযখে যাবে-এ ধরনের চিন্তাভাবনা মানুষের ভেতর মিথ্যা অহংকারের জন্ম দেয়। স্বাভাবিকভাবেই এই ধরনের চিন্তার ফলে কাফেরদের সাথে প্রয়োজনে যেমন খুশি তেমন আচরণ করতে প্ররোচিত করে।
এ আয়াতে আরো বলা হয়েছে, কে যে আল্লাহর রহমতধন্য আর কে শাস্তি পাবে, তা একান্তই আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত বিষয়। কেউ বলতে পারবে না কে দোযখি হবে। এ কারণেই কারো এই অধিকার নেই অপরকে অপমান কিংবা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা এমনকি কারো ওপরে দোষ চাপানো। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা এমনকি নবীজীও মানুষের উকিল বা তত্ত্বাবধায়ক নন। সেজন্যে তিনিও জনগণকে ঈমান আনতে বাধ্য করা বা জোর করতে পারেন না এমনকি কুফরির অপরাধে তাদেরকে মেরে ফেলতেও পারেন না। ঈমান এবং কুফরির মাঝ থেকে একটিকে বেছে নেওয়ার অধিকার আল্লাহ পাক সকল মানুষকেই দিয়েছেন। তবে যে-কোনো একটিকে বেছে নেওয়ার পর তার পরিণতি কী হবে তাও সুনির্দিষ্ট করে তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :
এক. ঈমান আনার কারণে অহংকার করা ঠিক নয় কিংবা নিজের শ্রেষ্ঠত্ব খুঁজে বেড়ানোটাও সমীচীন নয়। কেননা কেউই নিজের ভবিষ্যৎ কিংবা অন্যদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছুই জানে না।
দুই. মুবাল্লিগ অর্থাৎ যিনি দ্বীনের দাওয়াত দেন তিনি যেন নিজেকে জনগণের অভিভাবক কিংবা তত্ত্বাবধায়ক না ভাবেন, বরং তাদের জেনে রাখা উচিত যে স্বয়ং নবী রাসূলগণও জনগণকে ঈমান আনার জন্যে বাধ্য করতে আদিষ্ট ছিলেন না।
সূরা বনী ইসরাইলের ৫৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَرَبُّكَ أَعْلَمُ بِمَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلَقَدْ فَضَّلْنَا بَعْضَ النَّبِيِّينَ عَلَى بَعْضٍ وَآَتَيْنَا دَاوُودَ زَبُورًا (55)
“তোমার রব পৃথিবী ও আকাশের সৃষ্টিসমূহকে বেশী জানেন৷ আমি কতক নবীকে কতিপয় নবীর ওপর মর্যাদা দিয়েছি এবং আমি দাউদকে যাবুর দিয়েছিলাম।” (১৭:৫৫)
আয়ের আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহপাক মানুষের ভেতর-বাহিরের সবকিছুই জানেন। এ আয়াতে আল্লাহর জ্ঞানের সামগ্রিকতার প্রতি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ আকাশ এবং পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবকিছুর ব্যাপারেই আল্লাহ সর্বজ্ঞ। তবে নবী-রাসূলদের মাঝে দায়িত্ব এবং দাওয়াতি কাজের পরিধি ইত্যাদির দিক থেকে কিছুটা পার্থক্য যে রয়েছে সে কথাও এ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা নবীদের মাঝে অনেকের ওপরেই কিতাব এবং শরিয়তের বিধান নাযিল করা হয়েছে। কারো ওপরে ছিল শুধু দাওয়াতি কাজের দায়িত্বসহ অন্যদের ওপর নাযিলকৃত কিতাব এবং শরিয়তের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার দায়িত্ব। কোনো কোনো নবীর দায়িত্ব ছিল কোনো কোনো গোত্র বা কবিলার মাঝেই সীমিত। আবার অনেকের ওপরেই বিস্তীর্ণ এলাকায় দাওয়াতি কাজের দায়িত্ব ছিল। কুরআনের অপরাপর আয়াতে কোনো কোনো পয়গাম্বরকে “উলুল আযম” বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত নূহ (আ.) এবং ইব্রাহীম (আ.) এই “উলুল আযম” শ্রেণীর পয়গাম্বর।
এ আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ
এক. বিশ্বের সর্বত্রই আল্লাহ বিরাজমান, এই পৃথিবীর গভীরে কিংবা উর্ধ্বাকাশে যা কিছুই রয়েছে সবকিছু সম্পর্কেই তিনি জানেন।
দুই. পয়গাম্বদের মাঝেও শ্রেণীবিন্যাস রয়েছে। সৃষ্টিব্যবস্থার মতোই এই পার্থক্য বা শ্রেণীবিন্যাসের তাৎপর্য রয়েছে। শরিয়তের ব্যবস্থায়ও একইরকম পার্থক্য রয়েছে আর এসবই আল্লাহর কৌশল।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন