সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৪১-৪৪
সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৪১-৪৪
সূরা বনী ইসরাইলের ৪১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَلَقَدْ صَرَّفْنَا فِي هَذَا الْقُرْآَنِ لِيَذَّكَّرُوا وَمَا يَزِيدُهُمْ إِلَّا نُفُورًا (41)
“আমি এ কুরআনে লোকদেরকে নানাভাবে বারবার বুঝিয়েছি যেন তারা সচেতন হয়, সজাগ হয় এবং পরামর্শ মেনে চলে কিন্তু এই চেষ্টা সত্য থেকে আরো বেশী দূরে সরে যাওয়া ছাড়া তাদের জন্যে আর কিছুই বাড়ায় নি।” (১৭:৪১)
কুরআনের একটি বৈশিষ্ট্য হলো- বিভিন্নভাবে এবং বারবার করে কোনো একটি বক্তব্য উপস্থাপন করা। কেননা আল কুরআন হচ্ছে হিদায়াত এবং ওয়াজ বা বক্তব্যের কিতাব। আর হিদায়াত শুধুমাত্র জানা কিংবা সচেতনতার মাধ্যমেই অর্জিত হয় না বরং একটি সত্যকে বিভিন্ন আঙ্গিকে এবং বিভিন্ন প্রসঙ্গে বর্ণনা করতে হয় যাতে জীবন ও আত্মার ওপর তার প্রভাব পড়ে। সেজন্যেই আয়াতের ধারাবাহিকতায় বলা হচ্ছেঃ এই পুনরাবৃত্তির কারণ হলো মানুষ যাতে পরামর্শ ও নির্দেশনা গ্রহণ করে এবং তাদের জানান দেওয়া যায়। তবে এটাও স্পষ্ট যে সত্যকে ধারন করতে হলে সুস্থ মন ও হৃদয়ের প্রয়োজন। কুসংস্কারাচ্ছন্ন, একগুঁয়ে, অহংকারী লোকেরা কখনোই সত্যের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে পারে না। এ কারণেই যতোই তাদের কানে সত্যের ডাক পৌঁছাক না কেন, তারা সত্যের মোকাবেলায় দাঁড়িয়ে যায় অর্থাৎ সত্যকে রুখে দাঁড়ায় এবং তাদের একগুঁয়ে ভাব আরো বেড়ে যায়।
এ আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ
এক. মানুষকে সবসময়ই সচেতন এবং সাবধান করার প্রয়োজন রয়েছে। সত্যের কথা বারবার বলা এবং শোনানোর মাধ্যমে তা গৃহীত হয়।
দুই. সত্যের বিরোধিতা করা সত্যের যুক্তির দুর্বলতা নয় বরং বিরোধীদের একগুঁয়েমি এবং মানসিক দূষণের পরিচায়ক।
তিন. প্রশিক্ষণের উচ্চ পর্যায়ের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছার জন্যে কেবল একটা পদ্ধতিরই ব্যবহার করা ঠিক নয় বরং মানুষের মাঝে যেহেতু বিবেক বুদ্ধি কিংবা মেধাগত বৈচিত্র ও পার্থক্য রয়েছে তাই বিভিন্ন পন্থা এবং উপায়কে কাজে লাগানো উচিত।
সূরার ৪২ ও ৪৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قُلْ لَوْ كَانَ مَعَهُ آَلِهَةٌ كَمَا يَقُولُونَ إِذًا لَابْتَغَوْا إِلَى ذِي الْعَرْشِ سَبِيلًا (42) سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يَقُولُونَ عُلُوًّا كَبِيرًا (43)
(হে নবী! তাদেরকে) বলুন! -- ''তারা যেমন বলে তাঁর সঙ্গে যদি তেমন আরো উপাস্য থাকত তবে তারা আরশের অধিপতির প্রতি পথ খুঁজতো।’’(১৭:৪২)
“তাঁরই সমস্ত মহিমা! আর তারা যা বলে তা হতে তিনি মহিমান্বিত, বহু ঊর্ধ্বে!” (১৭:৪৩)
মক্কার মুশরিকরা পর্যন্ত আল্লাহকে বিশ্বস্রষ্টা হিসেবে বিশ্বাস করত, কিন্তু বিশ্ব ব্যবস্থাপনায় তারা আল্লাহর সাথে অন্যদেরকে শরীক করত এবং তাদেরকে আল্লাহর সাথে নিজেদের মধ্যস্থতাকারী বলে মনে করত। এ কারণেই তারা তাদের পূজা অর্চনা করত। এ আয়াতে জবাবে তাদেরকে বলা হচ্ছে যে, যদি এমনই হতো তাহলে ঐসব মাধ্যম আল্লাহর দরবারে তথা আরশের অধিপতি হবার প্রবেশদ্বার খুঁজতো এবং -নাউজুবিল্লাহ- তাঁর কাছ থেকে শক্তি অর্জন করতে করতে আল্লাহর একক আধিপত্য আর থাকত না, ফলে আল্লাহ তাদের ওপর খোদায়ি করতে পারতো না। আর তারাও চাইতো সৃষ্টিকূল জুড়ে তাদের হুকুমাত কায়েম করতে। এর ফলে তাদের মাঝেই দেখা দিতো দ্বন্দ্ব-সংঘাত।
এ আয়াতগুলো থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ
এক. আমাদের উচিত সবসময় আল্লাহর তাসবিহ করা এবং আমাদের মন বা মুখকে সকল প্রকার শেরেকি থেকে মুক্ত রেখে আল্লাহর শানকে পবিত্র রাখা। কেননা তাঁর পবিত্রতার ব্যাপারে আমাদের মন বা চিন্তা যদ্দুর যায় তাঁর পবিত্রতা তার চেয়েও অনেক উর্ধ্বে।
দুই. আল্লাহর ইবাদাত যাঁরা করেন তাঁদের চিন্তা-চেতনায় কিংবা আচার আচরণে যেন কোনো ধরনের কুসংস্কার দানা বাঁধতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। একইভাবে সমাজে দ্বীনের নামে যেন অন্য কোনো চিন্তাদর্শ ও বিশ্বাসের প্রচলন ঘটতে না পারে সে ব্যাপারেও সচেতন থাকতে হবে।
এই সূরার ৪৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
تُسَبِّحُ لَهُ السَّمَاوَاتُ السَّبْعُ وَالْأَرْضُ وَمَنْ فِيهِنَّ وَإِنْ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمْدِهِ وَلَكِنْ لَا تَفْقَهُونَ تَسْبِيحَهُمْ إِنَّهُ كَانَ حَلِيمًا غَفُورًا (44)
“তাঁর পবিত্রতা তো বর্ণনা করছে সাত আকাশ ও পৃথিবী এবং তাদের মধ্যে যা কিছু আছে সব জিনিসই৷ এমন কোনো জিনিস নেই যা তাঁর প্রশংসা সহকারে তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছে না, কিন্তু তোমরা তাদের পবিত্রতা ও মহিমা কীর্তন বুঝতে পার না৷ আসলে তিনি বড়ই সহিষ্ণু ও ক্ষমাশীল।” (১৭:৪৪)
কুরআনের উন্নত একটি শিক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো সৃষ্টিকূলের বোধশক্তি এবং বিশ্বস্রষ্টার সামনে তাদের বিনয় ও শ্রদ্ধায় অবনত হওয়া, সেইসাথে আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবিহতে ব্যস্ত থাকার কথা অসংখ্য আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে। এ আয়াতেও সেই বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছেঃ তোমরা যদি এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে নাও পার, তাকে অস্বীকার কর না, কেননা এ বিষয়টি তোমাদের চিন্তাশক্তির বৃত্তের বাইরে। তাই শুধু এ টুকুই জেনে রাখো যে, এ বিষয়টির অস্তিত্ব রয়েছে । তাঁর সৃষ্টিজগতের দিকে তোমরা যখন দৃষ্টি দাও তোমাদের সেই দৃষ্টি যেন বোধশূন্য না হয়।
অবশ্য কোনো কোনো চিন্তাবিদ আল্লাহর সামনে সৃষ্টিকূলের সেজদা করা কিংবা তাঁর তাসবিহ পড়াকে প্রকৃতির নিয়মের প্রতি সৃষ্টিকূলের আত্মসমর্পন বলে অর্থ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আত্মসমর্পন বলতে তাসবিহ করা বোঝায় না। দ্বিতীয়ত আমরাও সৃষ্টিকূলের প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলার বিষয়টি বুঝতে পারি,কিন্তু এ আয়াতে বলা হয়েছে সৃষ্টিকূলের তাসবিহর বিষয়টি উপলব্ধি করার শক্তি তোমাদের নেই। অবশ্য আল্লাহর অলিগণ সৃষ্টিকূলের ভাষা বুঝতে পারেন। কেননা কুরআনের আয়াতের ভাষ্য অনুযায়ী আমরা জেনেছি হযরত সোলায়মান (আ.) পিঁপড়ার ভাষা বুঝতেন এবং পাখিদের সাথে তিনি কথা বলতেন। এটাও অনেকেই জানেন যে নবী কারিম (সা.) এর পবিত্র হাতের পাথরকণারা তাঁর রেসালাতের সাক্ষ্য দিয়েছিলেন।
এ আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় বিষয় হলোঃ
এক. সৃষ্টিকূল আল্লাহর তাসবিহ জপে, তাহলে মানুষ কেন সৃষ্টিজগতের একটি জাতি হয়ে অভিন্ন কাজ না করে পিছিয়ে যাবে!
দুই. মানুষের পক্ষে সৃষ্টিকূল এবং তাদের অবস্থা সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখা অসম্ভব। এ ব্যাপারে তাদের জানাশোনার পরিধি সীমিত। তাই সেগুলো সম্পর্কে জানতে হলে আল্লাহর ওহি তথা কুরআনের শরণাপন্ন হতে হবে।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন