সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৩৭-৪০
সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৩৭-৪০
সূরা বনী ইসরাইলের ৩৭ ও ৩৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا إِنَّكَ لَنْ تَخْرِقَ الْأَرْضَ وَلَنْ تَبْلُغَ الْجِبَالَ طُولًا (37) كُلُّ ذَلِكَ كَانَ سَيِّئُهُ عِنْدَ رَبِّكَ مَكْرُوهًا (38)
“পৃথিবীর বুকে উদ্ধতভাবে বিচরণ কর না। কারণ তুমি তো কখনও পদভারে ভূপৃষ্ঠ বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় কখনও পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না।” (১৭:৩৭)
“এগুলোর মধ্য যেগুলো মন্দ,তোমার প্রভুর দৃষ্টিতে সেগুলো ঘৃণ্য।” (১৭:৩৮)
আগের আয়াতগুলোতে আল্লাহ অপছন্দনীয় কিছু কাজ করতে নিষেধ করেছেন। যেমন তিনি হত্যা করা, জেনা করা, এতিমের ওপর জুলুম করা, ওজনে কম দেয়া ইত্যাদি কাজ করতে নিষেধ করেছেন। এসব আদেশ নিষেধের শেষাংশে এসে এই দুই আয়াতে একটি নৈতিক ও গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলছেন, রাস্তা দিয়ে চলার সময় অহংকারী হয়ে চলো না। পায়ে হেটে চলার সময় এমনভাবে মাটিতে পা ফেল না, যেন মাটি কাঁপতে থাকে। আবার এমন উদ্ধতভাবেও চলাফেরা কর না যে, তোমাকে দেখলে মনে হয় তুমি পাহাড়ের সমান উঁচু হয়ে যেতে চাও। শান্তভাবে আস্তে আস্তে পথ চলো। এটা আল্লাহর বিনয়ী বান্দার পরিচয়। আল্লাহ-তায়ালা সূরা ফুরকানের ৬৩ নম্বর আয়াতেও এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।
ইসলামে ওয়াজিব বা অবশ্য পালনীয় কর্তব্য ও হারাম বা বর্জনীয় কাজ ছাড়াও বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দিক-নির্দেশনা দিয়েছে যেগুলো মানুষকে নৈতিক পূর্ণতায় পৌঁছাতে সাহায্য করে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি দিক হচ্ছে :
এক. শুধুমাত্র অন্যের সঙ্গে কথা বলা ও তাকানোর সময়ই নয়, বরং পথ চলার সময়ও গর্ব করা বা দম্ভভরে পা ফেলা অপছন্দনীয় ও ঘৃণ্য কাজ।
দুই. নোংরা কাজ সব ধর্মে অপছন্দনীয়। কারণ, প্রকৃতপক্ষে এ কাজ আল্লাহ অপছন্দ করেন।
সূরা বনী ইসরাইলের ৩৯তম আয়াতে আল্লাহ বলেছেন :
ذَلِكَ مِمَّا أَوْحَى إِلَيْكَ رَبُّكَ مِنَ الْحِكْمَةِ وَلَا تَجْعَلْ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آَخَرَ فَتُلْقَى فِي جَهَنَّمَ مَلُومًا مَدْحُورًا (39)
“তোমার প্রভু তোমাকে প্রত্যাদেশের মাধ্যমে নৈতিক শিক্ষার যে জ্ঞান দান করেছেন এগুলো তার অন্তর্গত। এবাদতের জন্য আল্লাহ্র সঙ্গে অন্য কিছুকে গ্রহণ কর না। করলে তুমি নিন্দিত ও বিতাড়িত অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।” (১৭:৩৯)
সূরা বনী ইসরাইলের দুইদুই থেকে ৩৮ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে মহান আল্লাহ অনেকগুলো নির্দেশ দিয়েছেন। এই আয়াতে এ সব নির্দেশকে আল্লাহর প্রজ্ঞা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যা ওহি হিসেবে আল্লাহর রাসূল (সা.)এর ওপর নাজিল হয়েছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব আয়াতের প্রথম বিষয় ছিল শিরক থেকে দূরে থাকতে হবে। আয়াতগুলোর শেষাংশে এসে আবারো শিরক থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। এখানে আল্লাহ বলছেন, শিরক করলে তার ক্রোধের শিকার হওয়ার পাশাপাশি আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হতে হবে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:
এক. আল্লাহর নির্দেশনা কল্যাণ ও কৌশল ভিত্তিক। তিনি অনর্থকভাবে কোনো নির্দেশ দেননি। অবশ্য কোনো কোনো সময় আল্লাহর কৌশল সম্পর্কে আমরা জানতে পারিনা। কিন্তু আল্লাহর অসীম জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস আছে বলে তাঁর নির্দেশ আমরা অন্ধভাবে পালন করি।
দুই. আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে মানব রচিত আইন অনুসরণ করা এক ধরনের শিরক। এর পরিণতিতে শুধু অনুশোচনাই করতে হয়।
সূরা বনী ইসরাইলের ৪০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ-রব্বুল আলামিন বলেছেন :
أَفَأَصْفَاكُمْ رَبُّكُمْ بِالْبَنِينَ وَاتَّخَذَ مِنَ الْمَلَائِكَةِ إِنَاثًا إِنَّكُمْ لَتَقُولُونَ قَوْلًا عَظِيمًا (40)
“তবে কি তোমাদের প্রভু তোমাদের জন্য পুত্র সন্তান নির্বাচিত করেছেন এবং নিজের জন্য ফেরেশতাদের কন্যারূপে গ্রহণ করেছেন? তোমরা তো ভয়ানক কথা উচ্চারণ করে থাক।” (১৭:৪০)
তখনকার যুগে মুশরিকদের মধ্যে এক ধরনের কুসংস্কার বিদ্যমান ছিল,যা এখনো কিছু কিছু মুশরিকদের মধ্যে আছে। তারা মনে করে ফেরেশতারা নারী এবং এ ধারণার ভিত্তিতে তারা ফেরেশতার কথা উঠলেই নারীর প্রতিমূর্তি আঁকে। অথচ ফেরেশতাদের মধ্য মানুষের মত নারী-পুরুষ নেই এবং স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কও তাদের মধ্যে স্থাপিত হয় না।
এখানে মজার বিষয় হল, কাফেররা যখন কন্যা সন্তানকে নিজেদের জন্য অপমানকর মনে করত ঠিক তখনই দাবি করত, ফেরেশতারা আল্লাহর কন্যা।
এখানে উল্লেখ করা দরকার, ছেলে ও মেয়ে উভয়কে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন এবং ইসলাম ধর্মে মানুষ হিসেবে তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য রাখা হয়নি। কাজেই জাহিলিয়াতের যুগে কন্যা সন্তানকে হেয় প্রতিপন্ন করার যে রীতি চালু ছিল তা ছিল মারাত্মক জঘন্য একটি কাজ। আল্লাহ কুরআনে যুক্তির মাধ্যমে অভিযোগ করে বলেন: তোমরা কেমন লোক যে, যে বিষয় থেকে নিজেদের মুক্ত ভাবছো সেই বিষয়টিকেই তোমাদের প্রভুর ওপর আরোপ করছো?
এ কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাসের বিপরীতে এই আয়াতে আল্লাহ বলেন : তোমরা কি মনে কর আমি তোমাদের দৃষ্টিতে শক্তিমত্তার প্রতীক ও সম্পদ আহরণকারী পুরুষদেরকে তোমাদের জন্য রেখে দিয়েছি, আর যে ফেরেশতাদেরকে তোমরা নারী বল, তাদেরকে আমি নিজের জন্য রেখে দিয়েছি? এ ধারণা অত্যন্ত অন্যায্য ও অন্যায়।
দুঃখজনকভাবে ইসলামপূর্ব যুগের কোনো কোনো ঐশী ধর্মের অনুসারীরা মনে করত আল্লাহর সন্তান আছে। এই ধারণা এসব ঐশী ধর্মের পবিত্রতা ও স্বাতন্ত্রকে বিকৃত করে। পবিত্র কুরআনে যেমনটি বলা হয়েছে, ইতিহাসের একটি নির্দিষ্ট সময়ে আল্লাহর নবী উযাইরকে ইহুদিরা আল্লাহর সন্তান মনে করত। হযরত ঈসা (আ.)কে আল্লাহ আসমানে উঠিয়ে নেয়ার পর খ্রিস্টানরা তাকে আল্লাহর সন্তান বলে দাবি করতে শুরু করে এবং আল্লাহর সন্তান হিসেবেই তাঁকে সম্মান করে। এগুলো ঐশী ধর্মগুলোতে শিরকমিশ্রিত বিশ্বাস ঢুকে যাওয়ার উদাহরণ।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:
এক. আল্লাহর কোনো সন্তান নেই, এ ধরনের দাবি যারা করে তারা মারাত্মক বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছে।
দুই. নিজের জন্য আমরা যা পছন্দ করি না তা আল্লাহর ওপর চাপিয়ে দেয়া ঠিক নয়। ফেরেশতাদের মতো অবস্তুগত সত্ত্বার লিঙ্গ নির্ধারণ করে তার ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করাও অন্যায়।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন