সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৩৪-৩৬
সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৩৪-৩৬
সূরা বনী ইসরাইলের ৩৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন:
وَلَا تَقْرَبُوا مَالَ الْيَتِيمِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ حَتَّى يَبْلُغَ أَشُدَّهُ وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا (34)
“এতিম পূর্ণ বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তাঁর সম্পত্তির উন্নতি করার লক্ষ্য ছাড়া এর নিকটবর্তী হয়ো না এবং প্রতিশ্রুতি পালন কর। কারণ,হিসাব গ্রহণের (বা কিয়ামতের) দিনে প্রতিটি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।” (১৭:৩৪)
আগের আয়াতে আল্লাহ খুন ও জেনার মতো কিছু অপছন্দনীয় কাজ থেকে মানব জাতিকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এ আয়াতে তারই ধারাবাহিকতায় এতিমের সম্পদে হাত দিতে নিষেধ করা হয়েছে। এতিমের সম্পদ বৃদ্ধি করা বা তার মঙ্গলের উদ্দেশ্য ছাড়া কেনা-বেচা বা ব্যবহার করা যাবে না।
অবশ্য অতিরিক্ত সতর্কতাও অনেক সময় এতিমের সম্পদ নষ্ট করে দিতে পারে। যেমন কেউ যদি এতিমের সম্পদ ব্যবহার না করে তার পূর্ণবয়স্ক হওয়ার জন্য তুলে রেখে দেয় তাহলে এ সম্পদের মধ্য থেকে বহু কিছু নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এর ফলে এতিম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটি না করে বরং এ সম্পদ ব্যবহার করে কীভাবে তার পরিমাণ বাড়ানো যায় সে চেষ্টা করতে হবে। আবার এতিমের মাল খাওয়া যাবে না বলে সে দাওয়াত করলেও যদি তা বর্জন করা হয় তাহলে এতিম মনে ভীষণ কষ্ট পাবে।
কাজেই এতিমের অধিকার রক্ষা ও তার সম্পদের অপব্যবহার না করার পাশাপাশি তার সঙ্গে পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। এতিমের সম্পদ ভোগ না করার অর্থ এই নয় যে, পিতৃ-মাতৃহীন শিশুর সম্পদ রক্ষা ও তাকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে যাওয়া যাবে না কিংবা কেউ তাদের কোন খোঁজ-খবর নেবে না।
এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:
এক. এতিম ও অসহায়ের পক্ষে ইসলামের অবস্থান। এ কারণে এতিমের ওপর জুলুম করাকে হত্যা ও জেনার পাশাপাশি একই ধরনের অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
দুই. শিশু যদি এতিমও হয়, সম্পদের ওপর তার মালিকানাকে ইসলাম স্বীকৃতি দিয়েছে। যদিও পূর্ণবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত নিজের সম্পদ সে ব্যবহার করতে পারবে না।
সূরা বনী ইসরাইলের ৩৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে :
وَأَوْفُوا الْكَيْلَ إِذَا كِلْتُمْ وَزِنُوا بِالْقِسْطَاسِ الْمُسْتَقِيمِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا (35)
“মেপে দেয়ার সময় পূর্ণ মাপে দেবে এবং সঠিক দাঁড়িপাল্লায় ওজন করবে। শেষ পরিণামে এটিই সর্বোৎকৃষ্ট এবং সবচেয়ে লাভজনক।” (১৭:৩৫)
আগের কয়েকটি আয়াতের ধারাবাহিকতায় এ আয়াতে সমাজের মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক রক্ষার পথ বাতলে দিয়েছেন মহান আল্লাহ। তিনি বলছেন: ধান ও গমের মতো যেসব পণ্য পাত্রে মাপা হয় এবং অন্যান্য যেসব পণ্য দাঁড়িপল্লায় ওজন করা হয়-তার সবকিছু সতর্কতার সঙ্গে মেপে দেবে। মাপে কম দেবে না এবং ক্রেতাকে ঠকাবে না।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল- আল্লাহ তায়ালা জনগণের অধিকার রক্ষা করা বিশেষ করে লেনদেন সম্পর্কে বহু আয়াত নাজিল করেছেন, এমনকি কুরআনের সবচেয়ে বড় আয়াত এ সম্পর্কে নাজিল হয়েছে।
এটা স্পষ্ট যে, সেই সমাজ সুখী ও সমৃদ্ধশালী হয় যেখানে অর্থনৈতিক লেনদেন সুস্থ ও স্বাভাবিক পন্থায় পরিচালিত হয় এবং লেনদেনের ক্ষেত্রে মাপে কম দেয়া, অন্যকে ঠকানো, সুদ, ঘুষ ইত্যাদি গ্রহণ থেকে মানুষ বিরত থাকে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে :
এক. সতর্কতার সঙ্গে ওজন করলে এবং অর্থনৈতিক বিষয়গুলোতে সাবধানতা অবলম্বন করলে আয়-রোজগারের ক্ষেত্রে বরকত বা আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করা যায়।
দুই. ওজনে কম দিয়ে তাতক্ষণিকভাবে লাভবান হওয়া যায়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এর ফলে দুনিয়ায় মানুষের বিশ্বাস হারানোর পাশাপাশি আখেরাতে কঠিন শাস্তি পেতে হয়।
সূরা বনী ইসরাঈলের ৩৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন :
وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا (36)
“তোমার যে বিষয়ে জ্ঞান নেই তার অনুসরণ কর না। কারণ কান, চোখ ও হৃদয়- এগুলোর প্রত্যেকের কাছে (কিয়ামতের দিন) কৈফিয়ত তলব করা হবে।” (১৭:৩৬)
আমরা অনেক সময় ধারণাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নিয়ে ভুল করে থাকি, যা সমাজ ও পরিবারের জন্য একটি বড় সমস্যা। অনেক সময় দেখা যায়, কোন দলিল-প্রমাণ ছাড়াই একজনের কাছে কোনো কথা শুনেই কোনো ব্যক্তিকে অপরাধী করা হচ্ছে, কিন্তু আসলে সে দোষী নয়।
ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে মানব সমাজের একটি বড় সমস্যা হলো- পূর্বাপর না ভেবেই সিদ্ধান্ত নেয়া, অমূলক সন্দেহ করা, আপনজনের কথা বাছবিচার ছাড়াই বিশ্বাস করা ইত্যাদি। অথচ সমাজে এমন বহু কথা ছড়িয়ে পড়ে যার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। এ ধরনের ভিত্তিহীন গুজব মানুষে মানুষে সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়। এ কারণেই হয়তো বলা হয়, ‘শোনা কথায় কান দিতে নেই’। স্বাভাবিকভাবেই শোনার চেয়ে দেখা জিনিসের সত্যতা সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তবে শর্ত হচ্ছেম আমরা যেন ভাসা ভাসা চোখে কোন বিষয়কে না দেখি। বাহ্যিকভাবে কোনো কিছু দেখেই যেন সিদ্ধান্ত না নেই।
দুঃখজনকভাবে বলতে হয়, সমাজে বহু দ্বিমুখী চরিত্রের লোক রয়েছে যাদেরকে ইসলামের ভাষায় মুনাফিক বলা হয়। যারা কোনো কিছুকে গভীরভাবে দেখতে অভ্যস্ত নন, তারা বাহ্যিকভাবে অত্যন্ত সদাচারী এসব মানুষের ধোঁকায় পড়ে যেতে পারেন। সেজন্য এ ধরনের মানুষের ব্যাপারে অত্যন্ত সাবধান থাকতে হবে।
এ আয়াতে বলা হচ্ছে, কোনো কিছু দেখা এবং শোনার পর যদি সে বিষয়ে দৃঢ়বিশ্বাস সৃষ্টি হয় তাহলেই কেবল সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধুমাত্র দেখা ও শোনার উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না, কারণ তাতে ভুল হলে আল্লাহর কাছে জবাবদিহী করতে হবে।
মানুষকে শুধু চোখ বা কানের ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কেই প্রশ্ন করা হবে না, বরং অন্তরে সে কী চিন্তা করেছে সে বিষয়েও জানতে চাওয়া হবে। আমি যদি মুখে কিছু নাও বলি অথচ মনে মনে কোন প্রমাণ ছাড়াই অন্যকে সন্দেহ করি, তাহলে সেটাও হবে অপরাধ, এর জন্য আমাকে কেয়ামতের দিনে প্রশ্ন করা হবে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে :
এক. জীবনে চলার পথে কোনো বিষয় সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস না আসলে সে কাজ করা যাবে না। শুধু বাহ্যিক দেখা বা শোনার ওপর নির্ভর করা ঠিক নয়।
দুই. কিয়ামতের দিন শুধুমাত্র চোখ ও কানকে প্রশ্ন করা হবে না বরং মানুষের সমস্ত শরীর বিশেষ করে হাত, পা ও মুখকে প্রশ্ন করা হবে। এ ছাড়াও কেয়ামতের দিন মানুষের সব আমল-আখলাক সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন