সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৩২-৩৩
সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৩২-৩৩
সূরা বনী ইসরাইলের ৩২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا (32)
“যিনার কাছেও যেও না, ওটা অত্যন্ত খারাপ কাজ এবং খুবই জঘন্য পথ।” (১৭:৩২)
আগের পর্বে আমরা যেসব আয়াত নিয়ে আলোচনা করেছিলাম,সেসব আয়াতে আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন জাহিলিয়াতের যুগের কিছু কিছু নোংরা এবং অপছন্দনীয় কাজের কথা উল্লেখ করে সেগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। আগের আসরের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এ আয়াতে বলা হয়েছেঃ যিনার মতো নোংরা কাজে কেবল জড়াবেই না, বরং এ কাজের ধারে কাছেও যাবে না, তার মানে হলো যেসব কারণে মানুষ এই নোংরা কাজটিতে জড়িয়ে পড়ে, সেসবের নিকটবর্তীও হবে না।
স্বাভাবিকভাবেই একজন নারী এবং একজন বেগানা পুরুষের মাঝে অবৈধ সম্পর্কটির সূচনা হয় দেখাদেখি থেকে। এজন্যে ইসলামে বেগানা পুরুষ বা মহিলার দিকে দৃষ্টি দেওয়াকে হারাম বলে ঘোষণা করা হয়েছে যাতে পরবর্তী পর্যায়ে গুনাহের ক্ষেত্র সৃষ্টি হতে না পারে। ইসলামের এইসব নির্দেশ একটি সমাজের জনগণের চিন্তা চেতনা এবং মানসিক সুস্থতার জন্যেই দেওয়া হয়েছে যাতে নারীদের অধিকার ধ্বংস করা কিংবা তাদের ওপর নির্যাতনের পথগুলোকে বাধাগ্রস্ত করা যায়। অপরদিকে নারীরা যেন নিশ্চিন্তে, নিরাপদ ও প্রফুল্ল মনে সমাজে তাদের উপস্থিতি বজায় রাখতে পারে। একটি পরিবার এবং সমাজের ওপর ফেতনা ফ্যাসাদসহ যিনার ক্ষতিকর দিকের প্রতি দৃষ্টি দিলে বুঝতে পারা যাবে, কেন ঐশী ধর্মগুলোতে এই কাজটিকে নোংরা এবং ভীষণরকম অপছন্দনীয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং এ কাজের নিকটবর্তী হওয়াটাকে পর্যন্ত দুনিয়া এবং আখেরাতে ঐশী শাস্তি ও রোষানলের কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
মজার ব্যাপার হলো- আজকের এই আধুনিক বিশ্ব নারী অধিকার ও স্বাধীনতার দাবিদার হয়েও নারী এবং কন্যাদের অধিকারের প্রতি সবচেয়ে বেশি অন্যায় অবিচার করেছে। তাদেরকে বিচিত্রভাবে নির্যাতন করেছে, কষ্ট দিয়ে যাচ্ছে এমনকি যৌনতার দিক থেকেও তারা নারীদের কাছ থেকে ফায়দা লুটছে। আর এই নারী অধিকারের দাবিদাররাই ভ্রূণহত্যার ছাড়পত্র দিচ্ছে। যেসব দেশ এক্ষেত্রে অগ্রসর ভূমিকায় রয়েছে সেসব দেশের স্কুলের মেয়েদের মাঝে পর্যন্ত গর্ভপাতের যে পরিসংখ্যান দেখতে পাওয়া যায় তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। আর এই উদ্বেগজনক এবং দুঃখজনক পরিণতির পেছনে যে কারণটি বিদ্যমান তা হলো অবৈধ সম্পর্ক। বেশিরভাগ যৌনব্যাধি এবং আত্মিক ও মানসিক সমস্যার কারণে বিবাদ-বিসম্বাদ এবং এমনকি আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটে অহরহ, আর এই পরিস্থিতির মূলে রয়েছে সেই নোংরা কাজের চর্চা।
যিনা করার রেওয়াজ বা প্রচলন যদি কোনো সমাজে ঘটে তাহলে ঐ সমাজে বিবাহিতরাও এই নোংরা কাজে জড়িয়ে পড়বে, যার পরিণতিতে স্বামী এবং স্ত্রী পরস্পরের অধিকার নষ্ট করবে অর্থাৎ খেয়ানত করবে নির্দ্বিধায়। বলা বাহুল্য, এই অবৈধ ও নোংরা সম্পর্কের কারণেই মূলত আজকের সমাজে তালাকের এতো ছড়াছড়ি। অবশ্য তালাক নিজেই সমাজে ফেতনা-ফাসাদ আর নোংরামি বিস্তারে সহায়তা করে। এ ছাড়াও যিনার বিস্তারের ফলে সমাজে পরিচয়হীন অবৈধ সন্তানাদির সংখ্যা বেড়ে যায়। এ ধরনের অবৈধ সন্তান যে সমাজে অপরাধী কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটাবে তাতে আর সন্দেহ কী!
যিনার এই তাবত ফাসাদের মোকাবেলায় ইসলাম সবসময় যুবকদেরকে সময়মতো বিয়ে করার পরামর্শ দিয়েছে। বিয়ের মাধ্যমে যেন জীবনসঙ্গীর ব্যাপারে দায়িত্বশীলতা বোধ করে এবং অন্যায় আচরণ থেকে বিরত থাকে। এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ
এক. অধিকাংশ গুনাহের বিপদ এতো বিশাল পরিমাণ যে তার ধারে কাছে ঘেঁষাটাও বিপজ্জনক, তাই গুনাহের সম্ভাবনার দ্বারেও যাওয়া যাবে না।
দুই. যিনা করা সহজ কোনো গুনাহ নয়, বরং যিনা অন্যান্য গুনাহের পথ সুগম করে এবং সমাজে ফেতনা ফাসাদ, জুলুম অপরাধের বিস্তার ঘটায়।
সূরা বনী ইসরাইলের ৩৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে
وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَمَنْ قُتِلَ مَظْلُومًا فَقَدْ جَعَلْنَا لِوَلِيِّهِ سُلْطَانًا فَلَا يُسْرِفْ فِي الْقَتْلِ إِنَّهُ كَانَ مَنْصُورًا (33)
“আল্লাহ যাকে হত্যা করা হারাম করে দিয়েছেন, সত্য ব্যতিরেকে তাকে হত্যা কর না। আর যে ব্যক্তি মজলুম অবস্থায় নিহত হয়েছে তার অভিভাবককে আমি কিসাস দাবি করার অধিকার দান করেছি। কাজেই হত্যার ব্যাপারে তার সীমা অতিক্রম করা উচিত নয়, তাকে সাহায্য করা হবে।” (১৭:৩৩)
যিনার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞার পর এই আয়াতে মানুষ হত্যা করতে নিষেধ করা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ আল্লাহ পাক সকল প্রাণকেই সম্মানজনক মনে করে। কারো অধিকার নেই কোনোভাবেই অন্য কাউকে হত্যা করে। তবে আল্লাহ যদি কাউকে সেই অধিকার দিয়ে থাকেন। আর সেই অধিকার বলতে শুধুমাত্র কেসাস (হত্যার বদলে হত্যা) কেই বোঝানো হচ্ছে। এখানে বলা হচ্ছে যে হত্যাকারীকে হত্যার পরিবর্তে হত্যা করা যেতে পারে তবে তাও আল্লাহর আদেশের ভিত্তিতে অর্থাৎ শারীরিকভাবে কষ্ট দিয়ে, নির্মম অত্যাচার চালিয়ে, পুড়িয়ে কিংবা এ ধরনের অন্য কোনো পন্থায় হত্যা করাটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পড়ে। একইভাবে হত্যাকারী এবং নিহতের পরিবারের মাঝে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বাধানো কিংবা তাদের কওম বা কবিলার মাঝে ঝগড়া বাধিয়ে দেওয়া-সবই হত্যার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি হিসেবে পরিগণিত। অতীতে এ ধরনের বাড়াবাড়ি ছিল এমনকি এমনও দেখা গেছে কোনো এক কবিলার এক ব্যক্তিকে মারার ঘটনায় দুই কবিলার মাঝে বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধ এবং রক্তপাতের ঘটনা লেগেই ছিল।
অবশ্য কেসাস হচ্ছে পৃথিবীর বুকে হত্যাকারীর জন্যে সবচেয়ে কম শাস্তি। পরকালে তার জন্যে অপেক্ষা করছে দোযখে পোড়ার শাস্তি। মজার ব্যাপার হলো- এ আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ পাক বলছেনঃ নিহত ব্যক্তির পরিবার আল্লাহ সহায়তা পায় কেননা তিনি তাদেরকে এই অধিকার দিচ্ছেন যে, হত্যাকারীকে চাইলে কেসাসও করতে পারে কিংবা চাইলে রক্তমূল্যও আদায় করতে পারে। সুতরাং দুই পরিবারের মাঝে যুদ্ধ কিংবা সংঘাত বাড়ানোর যেমন প্রয়োজন পড়ে না তেমনি প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধ গ্রহণেরও প্রয়োজন পড়ে না।
এ আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ
এক. মুসলমান হোক কিংবা কাফের প্রতিটি মানুষই বেঁচে থাকার অধিকার রাখেন। কাউকে হত্যা করার অধিকার কারুরই নেই যদি না আল্লাহ অনুমোদন না করেন।
দুই. অপরকে হত্যা করা যেমন হারাম তেমনি নিজেকে হত্যা করা অর্থাৎ আত্মহত্যা করাটাও হারাম। কেননা আল্লাহ কাউকেই আত্মহত্যা করার অধিকার দেননি।
তিন. মজলুমের প্রতি সমাজের উচিত সহায়তা করা কেননা আল্লাহ তেমনটিই চেয়েছেন।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন