সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ২৯-৩১

সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ২৯-৩১


বনী ইসরাইলের ২৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلَى عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُومًا مَحْسُورًا (29)
“নিজের হাত গলায় বেঁধে রেখ না এবং তাকে একেবারে খোলাও ছেড়ে দিও না, তাহলে তুমি নিন্দিত ও অক্ষম হয়ে যাবে।” (১৭:২৯)

আগের আসরে বর্ণিত আয়াতগুলোতে এসেছে আল্লাহপাক মা-বাবার প্রতি, আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি এবং অভাবীদের প্রতি সদয় শ্রদ্ধা ও সেবা করার আদেশ দিয়েছেন। এ আয়াতে বলা হচ্ছেঃ দান এবং দয়ার ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। না একেবারে হাড়কিপ্টে অর্থাৎ কৃপণ, আর না এতো হাত খোলা যে নিজের কাছে যা কিছু আছে সবই দান করে দিয়ে নিজেই হাত পাতার পর্যায়ে চলে যাবে-দুয়ের ঠিক মধ্যবর্তী অবস্থানে থাকতে হবে। ইসলাম একটা ভারসাম্যপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। কোনো রকমের উগ্রতা এমনকি ইবাদাতের ক্ষেত্রেও চরমপন্থা অর্থাৎ বাড়াবাড়ি ইসলাম অনুমোদন করে না। কারণ সব ধরনের বাড়াবাড়িরই পরিণতি হচ্ছে অনুশোচনা।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় কিছু দিক হলোঃ
এক. কৃপণতা করা যেমন অপছন্দনীয় কাজ তেমনি দান করার ক্ষেত্রেও অপচয় বা বাড়াবাড়ি করাটাও ইসলামী নীতিমালা অনুযায়ী ইতিবাচক নয়।
দুই. সকল প্রকার অপচয়েরই পরিণতি হচ্ছে অনুতাপ আর অনুশোচনা, এমনকি তা যদি ভালো কাজও হয়।

সূরা বনী ইসরাইলের ৩০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
إِنَّ رَبَّكَ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَقْدِرُ إِنَّهُ كَانَ بِعِبَادِهِ خَبِيرًا بَصِيرًا (30)
“তোমার রব যার জন্য চান রিজিক প্রশস্ত করে দেন আবার যার জন্য চান সংকীর্ণ করে দেন। তিনি নিজের বান্দাদের অবস্থা জানেন এবং তাদেরকে দেখছেন।” (১৭:৩০)

পৃথিবীর বুকে আল্লাহর সৃষ্ট বান্দা বা মানুষের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় যে, একেকজনের রিজিক একেক রকম-কারো বেশি, কারো কম। রুটি-রুজির এই তারতম্যের প্রতি ইঙ্গিত করে এ আয়াতে বলা হয়েছেঃ নীতিগতভাবেই আল্লাহ সবার আয়-রোজগার সমান করে দেননি। আর আল্লাহর বিধানই হচ্ছে যে, মানুষের মধ্যে বৈচিত্র থাকবে-এই বৈচিত্র ঐশী জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার ভিত্তিতে হবে। এখানে একটি কথা সুস্পষ্ট করা দরকার, তা হলোঃ এই তারতম্যের বিষয়টি কিন্তু অন্যায় বৈষম্যের অর্থে নয়। কেননা প্রথমত আল্লাহর কাছে কারো কিছু পাওনা নেই যার ভিত্তিতে সে রুজি দাবি করতে পারে। দ্বিতীয়ত, আল্লাহ যাকে যেটুকু দেন তাকে সে পরিমাণ দায়িত্ব নিতে হয়। যার রিজিক বা আয়-রোজগার বিস্তৃত, তার ওপর এই দায়িত্বও বর্তায় যে, সে যেন অন্যদের কাছে কিছু দাবি না করে। তাছাড়া পৃথিবীটা হচ্ছে পরীক্ষার স্থান। প্রত্যেককেই কোনো না কোনোভাবে পরীক্ষা করা হয়। ধনীদের পরীক্ষা নেওয়া হয় দান করার নির্দেশের মাধ্যমে আর গরিবদের পরীক্ষা নেওয়া হয় ধৈর্য ও অল্পে তুষ্টির মাধ্যমে। অবশ্য রিজিকের জন্যে চেষ্টা প্রচেষ্টা চালাতে হবে। সবারই উচিত নিজের সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। সে অনুযায়ী রুটি রুজির পরিমাণটা নির্ভর করে ব্যক্তির বাহ্যিক তৎপরতা, মেধা এবং শ্রম প্রদানের সামর্থের ওপর। এই মেধা এবং শ্রমের কারণেই এমনও হতে পারে দুই ব্যক্তি একই সমান শ্রম দেওয়ার পরও তাদের উপার্জনে তারতম্য রয়ে গেছে। তবে হ্যাঁ! যে যেটুকুই রুজি করবে সে ততটুকুর জন্যেই দায়িত্বশীল থাকবে।

এ আয়াত থেকে আমরা শিখব :
এক. আমাদের এটা ভাবা ঠিক হবে না যে, সকল বান্দারই আয়-রোজগারের পরিমাণ সমান। তাই যারা অভাবী বা দরিদ্র, তাদেরকে সাধ্য অনুযায়ী সাহায্য করতে হবে। এর বেশি দায়িত্ব ব্যক্তিগতভাবে আমাদের ওপর নেই।
দুই. আল্লাহর কাজগুলো সবই জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং কৌশলের ভিত্তিতে হয়ে থাকে। আমরা যদি কখনো কোনো কাজের কারণটা বা যুক্তিটা ঠিকমতো বুঝে উঠতে না পারি, তাহলে বান্দাদের আয়ের তারতম্যের রহস্যের মতোই নিজের জ্ঞান এবং মেধার ব্যাপারে সন্দেহ করতে হবে, কোনোভাবেই আল্লাহর ওপর সন্দেহ করা চলবে না।

সূরার ৩১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلَاقٍ نَحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَإِيَّاكُمْ إِنَّ قَتْلَهُمْ كَانَ خِطْئًا كَبِيرًا (31)
“দারিদ্রের আশংকায় নিজেদের সন্তান হত্যা কর না৷ আমি তাদেরকেও রিজিক দেব এবং তোমাদেরকেও৷ আসলে তাদেরকে হত্যা করা একটি মহাপাপ।” (৩১)

জিন নষ্ট করা, গর্ভপাত ঘটানো কিংবা ভ্রূণ হত্যা করার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। সে সবের একটি হলো দারিদ্র এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থা। এই কারণটির প্রতি ইঙ্গিত করেই এ আয়াতে বলা হয়েছেঃ তুমি কি মনে কর তুমিই খাদ্যের সংকুলানকারী! যার কারণে তুমি দারিদ্রের ভয়ে নিষ্পাপ নবজাতককে হত্যা করছো? আমরাই তাদের খাদ্যের সংকুলানকারী যেমন তোমার খাদ্যের ব্যবস্থা করে থাকি। তাই যেহেতু দারিদ্র্যের ভয়েই জিন হত্যা করা যাবে না ফলে অন্য কোনো কারণে ভ্রূণ হত্যা করার বৈধতার তো প্রশ্নই ওঠে না। আসলে বাবা কিংবা মা নবজাতকের মালিক নন যে তারা ইচ্ছে করলেই তাদের হত্যা করতে পারবেন। বরং মা-বাবা যেমন মুক্ত এবং স্বাধীন মানুষ তেমনি তাদের শিশুসন্তানও মুক্ত এবং স্বাধীন একটি সত্ত্বা। আল্লাহ নিজেই তার এই বান্দার মালিক এবং তার খাবারের ব্যবস্থা করার দায়িত্বশীল। আর আল্লাহ তাদেরকে এই অনুমতি দেন নি যে তারা তাদের সন্তানকে এমনকি গর্ভে থাকাকালেও হত্যা করবে।

বিস্ময়ের ব্যাপার হলো আজকের এই আধুনিক বিশ্বের মানুষ জাহেলি যুগের অশিক্ষিত, সংস্কৃতি থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থানকারী যাযাবর আরবদেরকে ঘৃণা করছে এজন্যে যে তারা তাদের কন্যা সন্তানদেরকে জীবন্ত কবর দিতো। অথচ আজকের এই উন্নত ও সুসভ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংসদ ভ্রূণ হত্যা করাকে বৈধতা দিয়েছে। সেসব দেশের মায়েরা যদি চান নির্বিঘ্নে গর্ভপাত ঘটাতে পারেন। সেই জাহেলি যুগে যেসব বাবা এই অমানবিক কাজটি করত তাদের আমরা জঘন্য, বর্বর, নির্দয় ইত্যাদি বিশেষণে অভিহিত করেও পরিতৃপ্ত হতে পারি না, কিন্তু আধুনিক এই বিশ্বে পাথুরে মনের বাবারা নন, কোমল হৃদয়ের অধিকারী, স্নেহবৎসল, দয়া ও ভালোবাসার প্রতীক মায়েরাই সেই নৃশংস কাজটি করে যাচ্ছেন। সেই প্রাচীনকালে শুধু মেয়ে সন্তানকেই হত্যা করা হতো, কিন্তু আধুনিক বিশ্বে মা-বাবা চাইলেই হলো, ছেলে কিংবা মেয়ে-সেটা কোনো ব্যাপারই নয়, মানুষের বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় অধিকারটি তারা কেড়ে নিতে দ্বিধাবোধ করছে না।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলোঃ
এক. যতো রকমের ভয়ভীতিই থাকুক না কেন, অপরের অধিকারকে বিশেষ করে বেঁচে থাকার অধিকারকে উপেক্ষা করার অনুমতি কারো জন্যেই নেই।
দুই. আয়-রোজগারের বিষয়টি আল্লাহর হাতে, তাই অভাব কিংবা দারিদ্রের সমস্যা দেখিয়ে ভ্রূণ হত্যা করার কোনো সুযোগ নেই।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন