সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ২৫-২৮
সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ২৫-২৮
সূরা বনী-ইসরাইলের ২৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
رَبُّكُمْ أَعْلَمُ بِمَا فِي نُفُوسِكُمْ إِنْ تَكُونُوا صَالِحِينَ فَإِنَّهُ كَانَ لِلْأَوَّابِينَ غَفُورًا (25)
“তোমাদের রব খুব ভালো করেই জানেন তোমাদের মনে কী আছে৷ যদি তোমরা সৎকর্মশীল হয়ে জীবন যাপন কর, তাহলে তিনি এমন লোকদের প্রতি ক্ষমাশীল যারা নিজেদের ভুলের ব্যাপারে সতর্ক হয়ে বন্দেগির নীতি অবলম্বন করার দিক ফিরে আসে।” (১৭:২৫)
গত আসরে বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ব, ভালোবাসা, তাদের সেবা-যত্ন করা এবং তাদের সাথে যথার্থ সম্মানজনক আচরণ করার ব্যাপারে কুরআনের নির্দেশ সংক্রান্ত আয়াতগুলো নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। এ আয়াতে তারি ধারাবাহিকতায় বলা হচ্ছে, কিছু কিছু সন্তান আছে যথাযথ মর্যাদা ও সম্মানের সাথে বাবা-মায়ের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করছে না এবং কথাবার্তায়, আচার আচরণে অসম্মান দেখায়-তাদের এসব আচরণ সম্পর্কে আল্লাহ জানেন। এতোসব সত্ত্বেও যদি কেউ তাওবা করে এবং ভালো আচরণ করার মাধ্যমে পূর্বেকার আচরণের জন্যে প্রায়শ্চিত্ত করে, আল্লাহ তাদেরকেও ক্ষমা করবেন।
এ আয়াত প্রমাণ করছে যে, মা-বাবার প্রতি সম্মান দেখানো একটা ধর্মীয় দায়িত্ব, এটা কেবল একটা নৈতিক পরামর্শের ব্যাপার নয়। সুতরাং যেসব আচরণের ফলে মা-বাবার মনে কষ্ট যায় সেসব আচরণ গুনাহের শামিল এবং ঐ ব্যক্তির উচিত তার প্রায়শ্চিত্ত করা। তা না হলে আল্লাহর পক্ষ থেকে তিরস্কার এবং শাস্তি ভোগ করতে হবে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ
এক. অনেক সময় নেককার ব্যক্তিরাও ভুল-ত্রুটি করে ফেলে, তাই তাদের উচিত অবিলম্বে তাওবা করে নিজেকে শুধরে নেওয়া।
দুই. আল্লাহ পাক কেবল আমাদের আমলের ব্যাপারেই নয় বরং আমাদের কাজের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কেও সচেতন, তাঁর জানার মধ্যে কোনোরকম ভুল-ভ্রান্তি যেমন নেই তেমনি হ্রাস-বৃদ্ধিও নেই।
সূরা বনী ইসরাইলের ২৬ এবং ২৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَآَتِ ذَا الْقُرْبَى حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا (26) إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُورًا (27)
“আত্মীয়কে তার অধিকার দাও এবং মিসকীন ও মুসাফিরকেও তাদের অধিকার দাও।” (১৭:২৬)
“বাজে খরচ কর না৷ যারা বাজে খরচ করে তারা শয়তানের ভাই আর শয়তান তার রবের প্রতি অকৃতজ্ঞ ৷” (১৭:২৭)
মানুষের ওপর মাতা-পিতার অধিকার সম্পর্কে বলার পর এ আয়াতগুলোতে আত্মীয়-স্বজন এবং দরিদ্রদের অধিকার সম্পর্কে বলা হচ্ছেঃ তোমাদের ওপর তাদেরও অধিকার রয়েছে,সেই অধিকার তোমাদের আদায় করা কর্তব্য। দুঃখজনকভাবে সমাজের কিছু কিছু লোক অন্যদের সাহায্য সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে খুবই কট্টর এবং হীনমন্যতায় ভোগে। অনেকেই কেবল নিজের পরিবার পরিজন নিয়েই ব্যস্ত থাকে এমনকি নিজেদের আত্মীয় স্বজনের ব্যাপারেও থাকে উদাসীন। পক্ষান্তরে আবার এমনও কেউ কেউ আছে যারা নিজের পরিবার পরিজনের কথা ভুলে থেকে নিজের আয় উপার্জনের টাকা বন্ধু-বান্ধবদের পেছনেই খরচ করে,তাদেরই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে। এই দুই বৈশিষ্ট্যের লোকদের সম্পর্কে এই আয়াতগুলোতে বলা হয়েছেঃ অন্যদের কথাও ভাবতে হবে আবার এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা থেকেও দূরে থাকতে হবে, কেননা এটা অপচয়ের পর্যায়ে পড়ে।
পরের আয়াতটিতে অপচয় করাকে শয়তান এবং তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের কাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা ধন-সম্পদ যত্রতত্র এবং অযৌক্তিভাবে ব্যয় করা আল্লাহর দেওয়া নিয়ামতের ব্যাপারে এক ধরনের অকৃতজ্ঞতার শামিল, আর সর্বপ্রথম ইবলিসই আল্লাহর নিয়ামতের ব্যাপারে অকৃতজ্ঞতা দেখিয়েছে। কারণটা হলো আল্লাহ তাকে যেসব দিয়েছেন শয়তান সেগুলোকে কাজে লাগিয়েছে আল্লাহর বান্দাদেরকে বিপথগামী করতে এবং গুনাহ ও পাপের দিকে আহ্বান জানাতে। অবশ্য অপচয় যদিও অর্থনৈতিক বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত তারপরও বলতেই হবে সবচেয়ে বড় অপচয় হলো যৌবন ও জীবনকে হেলায় ব্যয় করা অর্থাৎ নিষ্ফল করে দেওয়া। মানুষ যদি নিজের অস্তিত্ব এবং জীবনের নিয়ামতকে কাজে না লাগায় কিংবা ভুল পথে ব্যয় করে তা হলে দুটোই তার ক্ষতি এবং ধ্বংসের কারণ।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলোঃ
এক. দান এবং দয়ার মধ্যে অবশ্যই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অগ্রসর হতে হবে। প্রথমে বাবা-মা তারপর আত্মীয়-স্বজন এবং তারপর সমাজের দরিদ্র ও বিপদগ্রস্তরা।
দুই. ধনী বা সম্পদশালীরা গরিব ফকিরদেরকে যা কিছু দেয় সেগুলো ফকির মিসকিনদের প্রাপ্য অধিকার। তাই দান করে খোঁটা দেওয়ার অধিকার তাদের নেই।
তিন. দান করার ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে এবং সর্বপ্রকার অপচয় থেকে দূরে থাকতে হবে।
এই সূরার ২৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَإِمَّا تُعْرِضَنَّ عَنْهُمُ ابْتِغَاءَ رَحْمَةٍ مِنْ رَبِّكَ تَرْجُوهَا فَقُلْ لَهُمْ قَوْلًا مَيْسُورًا (28
“যদি তাদের থেকে (অর্থাৎ অভাবী, আত্মীয়-স্বজন, মিসকীন ও মুসাফির) তোমাকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হয় এজন্য যে, এখনো তুমি প্রত্যাশিত রহমতের সন্ধান করে ফিরছো, তাহলে তাদেরকে নরম জবাব দাও৷” (১৭:২৮)
আগের আয়াতে বলা হয়েছে অসহায় দরিদ্র এবং আত্মীয় স্বজনদের দান করতে হবে। তারি ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে বলা হয়েছেঃ তোমার কাছে যদি অন্যদেরকে দান করার মতো কিছু না থাকে, তাহলে অন্তত নিজের নম্র ভাষা দিয়ে অন্যের মনটাকে প্রশান্ত কর। তাকে আশা দাও যে যখনই আল্লাহ পাক তোমার রুটি রুজি বাড়িয়ে দেবেন তখন নিশ্চয়ই তাকে সামর্থ পরিমাণ সাহায্য সহযোগিতা করবে। বর্ণনায় এসেছে নবীজী যখনই কারো চাওয়া বা প্রসারিত হাতে কিছু দিতে না পারতেন তার জণ্যে দোয়া করে দিতেনঃ আল্লাহ আমাদেরকে এবং তোমাদেরকে তাঁর অনুগ্রহে আয়ের ব্যবস্থা করে দিন। এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ
এক. সর্বাবস্থায় আল্লাহর রহমতের ব্যাপারে আশাবাদী হতে হবে এবং অন্যদেরকেও নম্র ভাষণ বা কথার মাধ্যমে আশা দিতে হবে।
দুই. যদি কারো আর্থিক চাহিদা মেটাতে পারা না যায়,অন্ততপক্ষে তাকে আশা দিয়ে প্রশান্ত করে দেওয়া উচিত।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন