সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ১৮-২১

সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ১৮-২১


সূরা বনী ইসরাইলের ১৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْعَاجِلَةَ عَجَّلْنَا لَهُ فِيهَا مَا نَشَاءُ لِمَنْ نُرِيدُ ثُمَّ جَعَلْنَا لَهُ جَهَنَّمَ يَصْلَاهَا مَذْمُومًا مَدْحُورًا (18)
“যে কেউ ইহকালের ক্ষণস্থায়ী জিনিস কামনা করে, আমি সেসব লোককে যা ইচ্ছা সত্ত্বর দেই। এরপর তাদের জন্যে নির্ধারণ করি। ওরা তাতে নিন্দিত ও (আল্লাহর রহমত থেকে) বিতাড়িত অবস্থায় প্রবেশ করবে।” (১৭:১৮)

এ আয়াতে সেইসব লোকদের কথা বলা হয়েছে, যারা বিচার দিবস বা পুনরুত্থানকে অস্বীকার করে এবং তাদের সব চিন্তা-ভাবনা বস্তুগত বিষয়কে ঘিরে কেন্দ্রীভূত। এরা পরকালের জন্য কিছু করেনি বলে সেই জগতে কিছুই পাওয়ার দাবি করতে পারবে না, বেহেশত তো দূরের কথা। দুনিয়ার ব্যাপারেও এমন নয় যে তারা যাই দাবি করবে তাই পাবে। কারণ, পৃথিবীর এমন ক্ষমতা নেই যে তা সব মানুষের সব আকাঙ্ক্ষার কেবল অংশ বিশেষই পূরণের সুযোগ পাবে। আর সেটাও হবে ক্ষণস্থায়ী ও ধ্বংসশীল।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
এক. যারা দুনিয়ার পেছনে ছোটে তারা পরকালকে ভুলে যায়। ফলে তারা পরকালে মহাক্ষতির শিকার হয়।
দুই. বস্তুগত বিষয়ে সীমাবদ্ধতা থাকে। তাই সবাই তাদের আশা পূরণে সক্ষম হয় না। কিন্তু আধ্যাত্মিক বিষয়ে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। তাই সবাই প্রেচেষ্টা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে পারে।

সূরা বনী-ইসরাইলের ১৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَمَنْ أَرَادَ الْآَخِرَةَ وَسَعَى لَهَا سَعْيَهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَئِكَ كَانَ سَعْيُهُمْ مَشْكُورًا (19)
“আর যারা পরকাল কামনা করে এবং মুমিন অবস্থায় তার জন্য যথাযথ চেষ্টা সাধনা করে, এমন লোকদের চেষ্টা স্বীকৃত হয়ে থাকে।” (১৭:১৯)

আগের আয়াতে দুনিয়া-পূজারীদের অবস্থা বর্ণনার পর এই আয়াতে বলা হচ্ছে, দুনিয়ায় যাদের চেষ্টা- প্রচেষ্টার লক্ষ্য হল পরকাল এবং যারা আল্লাহর প্রতি ঈমানের আলোকে দুনিয়ার বিষয় পরিচালনা করে, তারা আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার লাভ করবে। আর পরকালের বেহেশতই হল তাদের পুরস্কার।
এই আয়াত ও আগের আয়াতের অর্থ থেকে বোঝা যায়, পরকালের জন্য যে কোন প্রচেষ্টার ফল যদি দুনিয়াতে না পাওয়া যায় তাহলে তা আখিরাতে বা পরকালে পাওয়া যাবে। পরকালে অবশ্যই ওই প্রচেষ্টার পুরস্কার থাকবে। অন্যদিকে দুনিয়ার কোনো লক্ষ্য হাসিলের প্রচেস্টা সফল হবে কিনা তা স্পষ্ট নয় এবং দুনিয়া –পূজার জন্য পরকালের ক্ষতির শিকার হতে হবে।

এই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার :
এক. প্রকৃত সৌভাগ্য নির্ভর করে প্রচেষ্টা ও অধ্যবসায়ের ওপর। মুমিন ব্যক্তিরা দুনিয়ার রুটি-রুজির কাজও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করেন এবং আল্লাহর বিধান অনুযায়ী তা সম্পন্ন করেন। তাই পরকালে সে পুরস্কার পাবে।
দুই. আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক দায়িত্ব পালন করাটাই মানুষের জন্য জরুরি বা করণীয় কর্তব্য, ফলাফল নয়। তাই আমাদেরকে যোগ্যতা ও সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করতে হবে। অবশ্য এর ফলাফল আমাদের আওতাধীন নয়।

সূরা বনী- ইসরাইলের ২০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
كُلًّا نُمِدُّ هَؤُلَاءِ وَهَؤُلَاءِ مِنْ عَطَاءِ رَبِّكَ وَمَا كَانَ عَطَاءُ رَبِّكَ مَحْظُورًا (20)
"এদেরকে এবং ওদেরকে প্রত্যেককে আমি আপনার পালনকর্তার দান পৌঁছে দেই এবং আপনার পালনকর্তার দান কারো জন্যই রুদ্ধ নয়।" (১৭:২০)

আগের দুই আয়াতে পরকালমুখী বা পরকালীন কল্যাণকে বেশি গুরুত্ব দানকারী ও দুনিয়া-পূজারী মানুষের ভিন্ন ধরনের পরিণতির কথা বলা হয়েছে। এ আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, আল্লাহর বিধান অনুযায়ী এই উভয় গ্রুপ তাদের লক্ষ্য পূরণের জন্য আল্লাহর দয়া ও করুণা পেয়ে থাকে। কারণ, আল্লাহ মানুষকে পথ বেছে নেয়ার স্বাধীনতা দিয়েছেন। আল্লাহ দুনিয়ার নানা লক্ষ্য পূরণের ক্ষেত্রে মানুষকে কোনো বাধা দেন না, বরং সাহায্য করেন। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে আল্লাহ দুনিয়া-পূজা পছন্দ করেন। তদ্রুপ আল্লাহ কাফির-মুশরিকদের রিজিক দিয়ে থাকেন। কিন্ত্ত এর অর্থ এই নয় যে, আল্লাহ তাদের কাজ-কর্মে সন্তুষ্ট।

এই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
এক. আল্লাহর ওর ঈমান বা বিশ্বাস ও পরকালমুখী হওয়া বা পরকালীন কল্যাণকে বেশি গুরুত্ব দেয়া এবং পার্থিব সম্পদ ও সুযোগ সুবিধার অধিকারী হওয়ার মধ্যে কোনো বৈপরীত্য বা সংঘাত নেই।
দুই. মহান আল্লাহর যে কোনো দান তাঁর দয়া ও করুণা মাত্র। কারণ, আল্লাহর কাছে কোনো কিছু দাবি করার অধিকার আমাদের নেই।

সূরা বনী-ইসরাইলের ২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
انْظُرْ كَيْفَ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَلَلْآَخِرَةُ أَكْبَرُ دَرَجَاتٍ وَأَكْبَرُ تَفْضِيلًا (21)
“দেখুন, আমি তাদের একদলকে অপরের ওপর কিভাবে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। নিশ্চয়ই পরকালীন মর্যাদা উচ্চতর এবং ফজিলতে শ্রেষ্ঠতম।" (১৭:২১)

আগের আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, আমি সব মানুষকেই দয়া ও দান করি। এ আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, অবশ্য আমি সব মানুষকে সমান মাত্রায় রিজিক ও সুযোগ-সুবিধা দান করি না। মানুষের বুদ্ধি ও যোগ্যতার আলোকে এসব ক্ষেত্রে তারতম্য হয়। আর এটা খোদায়ী কৌশলেরই অংশ। আল্লাহ যাকে যত বেশি দান করেন তাকে তত বেশি কঠিন দায়িত্বের পরীক্ষায় ফেলেন। আয়াতের শেষাংশে মহান আল্লাহ বলেছেন, পার্থিব জীবনে মানুষের মধ্যে তারতম্য –এটা গরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় বরং পরকালীন কল্যাণই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যারা যত বেশি সত কাজ করবে তারা পরকালে তত বেশি উপকৃত হবে এবং তত বেশি সম্মানের অধিকারী হবে।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
এক. মানুষের মধ্যে বৈষম্য ও পার্থক্য এক কথা নয়। এইসব পার্থক্য আসলে খোদার হেকমাত বা কৌশলের অংশ এবং মানুষের জন্যই অপরিহার্য।
দুই. আমরা যেন পার্থিব ক্ষমতা ও পদের জন্য লালায়িত না হই। কারণ, এসবই ক্ষণস্থায়ী। বরং পরকালীন কল্যাণের জন্য একে-অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা উচিত। কারণ, পরকালের মর্যাদাই হল প্রকৃত মর্যাদা।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন