সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৭-১০
সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৭-১০
সূরা বনী ইসরাইলের ৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
إِنْ أَحْسَنْتُمْ أَحْسَنْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ وَإِنْ أَسَأْتُمْ فَلَهَا فَإِذَا جَاءَ وَعْدُ الْآَخِرَةِ لِيَسُوءُوا وُجُوهَكُمْ وَلِيَدْخُلُوا الْمَسْجِدَ كَمَا دَخَلُوهُ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَلِيُتَبِّرُوا مَا عَلَوْا تَتْبِيرًا (7)
“যদি তোমরা ভালো কাজ কর তবে তা কর নিজেদের মঙ্গলের জন্য,যদি মন্দ কাজ কর,তাহলে তা কর তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে। সুতরাং যখন দ্বিতীয় সাবধান বাণীর সময় এসেছিল,আমি তোমাদের শত্রুদের অনুমতি দিয়েছিলাম তোমাদের মুখমণ্ডল বিকৃত করতে ও তোমাদের এবাদত গৃহে (বা বাইতুল মোকাদ্দাসে) প্রবেশ করতে। যেমনটি এর আগে তারা করেছিল এবং যা কিছু তাদের অধিকারে এসেছিল সবকিছু সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার করে দিয়েছিল।” (১৭:৭)
আগের আয়াতে আল্লাহ বনী ইসরাইলকে বলেছেন, তোমরা আবারও পৃথিবীতে ঝগড়া-ফ্যাসাদ সৃষ্টি করবে এবং এর পরিণতিতে তোমাদের চেয়ে শক্তিশালী কেউ এসে তোমাদেরকে পরাজিত করবে ও তোমাদের ঘর-বাড়ি ধ্বংস করে দেবে।
এ আয়াতে আল্লাহ দ্বিতীয় বিপর্যয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন: দুনিয়াতে প্রত্যেক কাজের প্রতিফল পাওয়া যায়। যদি কেউ ভাল কাজ করে, তবে সে উত্তম প্রতিদান পাবে। আর যদি কেউ খারাপ কাজ করে, তবে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। এরপর আল্লাহ ইহুদি জাতিকে বলেন, একবার খারাপ কাজের চরম পরিণতি ভোগ করেও তোমাদের শিক্ষা হয়নি। তোমরা আবার চরম ধৃষ্ঠ আচরণ শুরু করেছো।
তাই অপেক্ষায় থাক, এবার এমন একজন আসবে যে তোমাদেরকে আগের চেয়েও বেশি অপমানিত করবে। তোমাদের ইবাদতের স্থান মসজিদুল আকসা তোমাদের কাছ থেকে দখল করে নেবে এবং তোমাদেরকে শাসন করবে।
পবিত্র কুরআনে এ ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা বা ঘটনা সংঘটিত হওয়ার স্থান উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু এসব ঘটনা থেকে যে শিক্ষা পাওয়া যায় সেটিই এ ধরনের ঐতিহাসিক ঘটনা বর্ণনার মূল উদ্দেশ্য। গোত্রের নিকট শিক্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ সেসব বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে। সব যুগের সব জাতিকে এ শিক্ষাটি মনে রাখতে হবে যে, সব ধরনের অন্যায় কাজের কিছু পরিণতি এ পৃথিবীতেই ভোগ করতে হবে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
এক. আমাদের ভাল কাজ বা মন্দ কাজ আল্লাহর কোনো ক্ষতি বা উপকার করে না। প্রত্যেক কাজের ফলাফল মানুষকেই ভোগ করতে হয়।
দুই. আল্লাহর সব যুগের সব জাতির জন্য প্রযোজ্য। কাজেই যে কেউ পাপাচারে লিপ্ত হবে সে ধ্বংস হবে।
সূরা বনী ইসরাইলের ৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
عَسَى رَبُّكُمْ أَنْ يَرْحَمَكُمْ وَإِنْ عُدْتُمْ عُدْنَا وَجَعَلْنَا جَهَنَّمَ لِلْكَافِرِينَ حَصِيرًا (8)
“আশা করা যায়, তোমাদের প্রভু তোমাদের দয়া করবেন। কিন্তু তোমরা যদি তোমাদের পাপের পুনরাবৃত্তি কর,তবে আমিও আমার শাস্তির পুনরাবৃত্তি করব এবং কাফেরদের জন্য আমরা তৈরি করেছি জাহান্নামের কারাগার।” (১৭:৮)
আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে আল্লাহ বলেন : কখনই আল্লাহর রহমতের ব্যাপারে নিরাশ হয়ো না, সব সময় তার রহমতের অপেক্ষায় থাক। অবশ্য মানুষ তার কৃতকর্মের মাধ্যমে আল্লাহর রহমান ডেকে আনতে পারে। যদি তোমরা পাপাচার থেকে দূরে সরে যাও তাহলে তোমাদের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হতে পারে। তারপর আবারও যদি পাপকাজে লিপ্ত হও তাহলে জেনে রাখ, তোমাদের উপর থেকে আল্লাহর রহমত উঠে যাবে এবং কেয়ামতের দিন কঠিন আযাবের সম্মুখীন হতে হবে।
এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
এক. আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে রহমত ও ভালোবাসা। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বান্দাই নিজের অন্যায় কাজের মাধ্যমে এ সম্পর্ক নিজেই নষ্ট করে ফেলে।
দুই. সুসংবাদ দান ও রহমত প্রদানের পাশাপাশি মানুষকে পাপকাজের পরিণামের ব্যাপারেও সতর্ক করতে হবে।
পবিত্র কুরআনের সূরা বনী ইসরাইলের ৯ ও ১০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
إِنَّ هَذَا الْقُرْآَنَ يَهْدِي لِلَّتِي هِيَ أَقْوَمُ وَيُبَشِّرُ الْمُؤْمِنِينَ الَّذِينَ يَعْمَلُونَ الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ أَجْرًا كَبِيرًا (9) وَأَنَّ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآَخِرَةِ أَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا (10)
“অবশ্যই এই কুরআন সতপথ নির্দেশ করে এবং সত কর্মপরায়ণ বিশ্বাসীদের সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য রয়েছে মহা পুরষ্কার।” (১৭:৯)
“এবং যারা পরকালের জীবনে বিশ্বাস করে না,তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি ভয়াবহ শাস্তি।” (১৭:১০)
বনী ইসরাইল জাতি সম্পর্কিত আয়াত শেষ হওয়ার পর এই আয়াতে মানব জাতিকে হেদায়েত করার ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনের ভূমিকা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। আল্লাহ বলছেন: কুরআনে হেদায়েতের যে পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে তা স্থায়ী এবং স্থান-কাল-পাত্রভেদে এতে কোনো পরিবর্তন হয় না। এটা স্পষ্ট যে, আল্লাহর বক্তব্য এত বেশি পাকাপোক্ত ও শক্তিশালী যে, কোনো কিছুই তাতে পরিবর্তন আনতে পারে না। আল্লাহ-তায়ালা তাঁর সৃষ্টিরহস্য ও সত্যবাণী পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে মানুষের কাছে পাঠিয়েছেন। মানুষকে সৌভাগ্য ও চূড়ান্ত সাফল্য বা জান্নাতে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে এ কুরআন নাজিলের উদ্দেশ্য। আল্লাহ চান মানুষ পরহেজগারির দিক দিয়ে পূর্ণতায় পৌঁছে যাক। এজন্য তিনি বান্দার হেদায়েতের জন্য কোনকিছুর কমতি রাখেননি, বরং বান্দার জন্য যা কিছু প্রয়োজন ছিল তার সবকিছুর ব্যবস্থা করেছেন। অবশ্য এ বাস্তবতা ও সত্য গ্রহণের জন্য আল্লাহ তাঁর বান্দাকে বাধ্য করেননি। কিছু লোক আছে যারা এ সত্যকে গ্রহণ করে পালন করে। যার ফলে দুনিয়া ও আখেরাতের ফল তারা উপভোগ করে। অন্যদিকে কিছু লোক আছে যারা কুফরি ও শত্রুতার জন্য সত্যকে গ্রহণ করে না, তারা নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী চলে। সাধারণভাবে এরা হেদায়েত বা সঠিক পথের দিশা পায় না। এরা পথভ্রষ্ট হয় এবং অবশেষে কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে।
এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হল:
এক. কুরআনের হেদায়েত স্থায়ী যুক্তিভিত্তিক। এখানে কোনো ধরনের সন্দেহ ও কুসংস্কারের স্থান নেই।
দুই. কুরআন একটি চিরস্থায়ী ও বিশ্বজনীন গ্রন্থ। এ গ্রন্থের শিক্ষা বিশেষ কোন গোত্র, বংশ ও ভাষার জন্য নির্ধারিত নয়। সবাই এ গ্রন্থ থেকে শিক্ষা নিতে পারেন।
তিন. বান্দার হেদায়েতের জন্যই দয়ালু আল্লাহ কুরআন নাজিল করেছেন। কিন্তু এ কুরআন থেকে শিক্ষা নেয়া বা না নেয়ার বিষয়টি বান্দার ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। যে শিক্ষা নিয়ে তা নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করবে সে জান্নাতে যাবে, আর যে বাস্তবায়ন করবে না তার চিরস্থায়ী আবাস হবে জাহান্নাম।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন