সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৩-৬

সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৩-৬


সূরা বনী ইসরাইলের তিন নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
ذُرِّيَّةَ مَنْ حَمَلْنَا مَعَ نُوحٍ إِنَّهُ كَانَ عَبْدًا شَكُورًا (3)
“তোমরাই তো তাদের বংশধর যাদের আমি নূহের সঙ্গে (নৌকায়) আরোহণ করিয়েছিলাম, নিশ্চয়ই সে ছিল পরম কৃতজ্ঞ বান্দা।” (১৭:৩)

আগের আয়াতে আল্লাহ বলেন: আমরা বনী ইসরাইল জাতিকে হেদায়েত করার জন্য তওরাত পাঠিয়েছি। আর এ আয়াতে আল্লাহ তাদেরকে বলেন: তোমরা এ নেয়ামতের জন্য আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর এবং তার নির্দেশ মেনে চলো। এরপর আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ বান্দাদের উদাহরণ তুলে ধরতে গিয়ে হযরত নূহ (আ.) এর কথা উল্লেখ করে বলেন, আমরা তোমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্য থেকে যারা নূহের সঙ্গে ছিল তাদেরকে মহাপ্লাবন থেকে মুক্তি দিয়েছি। তারা ছিল কৃতজ্ঞ। কাজেই তোমরাও মুক্তি পেতে চাইলে কৃতজ্ঞ হও।

হযরত নূহ (আ.) সব নবীর তুলনায় দীর্ঘ জীবন লাভ করেছিলেন এবং সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ধর্ম প্রচারের কাজ করেছেন। তিনি এ কাজ করতে গিয়ে ব্যাপক অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হওয়া সত্ত্বেও কখনো কোনো ধরনের অভিযোগ করেননি বরং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছেন।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল :
এক. সন্তান-সন্ততি ও নতুন প্রজন্মকে সতপথে আহ্বান করার উত্তম পন্থা হচ্ছে তাদের সামনে ঈমানদার ও সতকর্মশীল বান্দাদের উদাহরণ তুলে ধরা।
দুই. মুক্তি ও সাফল্যের চাবিকাঠি হল আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। তাই সুখ ও দুঃখ উভয় অবস্থাতেই তাঁর শুকরিয়া আদায় করতে হবে।

সূরা বনী ইসরাইলের ৪র্থ আয়াতে বলা হয়েছে-
وَقَضَيْنَا إِلَى بَنِي إسْرائِيلَ فِي الْكِتَابِ لَتُفْسِدُنَّ فِي الْأَرْضِ مَرَّتَيْنِ وَلَتَعْلُنَّ عُلُوًّا كَبِيرًا (4)
“আমি (তাওরাত) কিতাবে বনী ইসরাইলিদের সুস্পষ্ট সাবধান বাণী দিয়েছিলাম যে,তোমরা পৃথিবীতে দুইবার বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং অতিশয় অহংকারি হবে।” (১৭:৪)

আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে আল্লাহ বনী ইসরাইলকে উদ্দেশ করে বলছেন, তোমরা আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় না করে ঝগড়া-ফ্যাসাদে লিপ্ত রয়েছ এবং দুনিয়াতে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছো।
কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে বনী ইসরাইলের কুকীর্তিগুলোর উদাহরণ দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, তারা আল্লাহর নবীদেরকে হত্যা করত, সুদ ও ঘুষ খেতো এবং সত্যকে প্রত্যাখ্যান করত। কিন্তু এ আয়াতে আল্লাহ বলেন: তোমরা এমন দু’টি বিপর্যয় সৃষ্টি করবে যা গোটা দুনিয়াকে আচ্ছন্ন করবে।

এ আয়াতে ফ্যাসাদ ও অহংকার শব্দ দু’টি পাশাপাশি এসেছে। আল্লাহ এর মাধ্যমে একথাই বলতে চেয়েছেন যে, সব ধরনের ফ্যাসাদ ও বিপর্যয়ের মূলে রয়েছে অহংকার। এজন্য কুরআনে ফেরাউন সম্পর্কে আল্লাহ বলেন: ফেরাউন দুনিয়াতে অহংকার করে বেড়াত এবং আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করত। আল্লাহ কুরআনের অন্যান্য আয়াতে বলেন: জান্নাত তাদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে যারা অহংকার করে না, আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় লিপ্ত হয় না এবং ফ্যাসাদ করে না।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে:
এক. ফ্যাসাদ ও বিপর্যয় সৃষ্টি ইহুদি ও বনী ইসরাইল জাতির একটি পুরনো রীতি এবং এ কথা আল্লাহ তাওরাতেও বর্ণনা করেছেন।
দুই. যুগে যুগে বহু অসহায় জাতি ক্ষমতা হাতে পেয়ে অহংকারি হয়ে গেছে। বনী ইসরাইল জাতি হযরত মুসা (আ.) এর সহযোগিতায় ফেরাউনের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তারাই দুনিয়াতে অহংকার ও বিবাদ সৃষ্টি শুরু করল।

সূরা বনী ইসরাইলের ৫ ও ৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
فَإِذَا جَاءَ وَعْدُ أُولَاهُمَا بَعَثْنَا عَلَيْكُمْ عِبَادًا لَنَا أُولِي بَأْسٍ شَدِيدٍ فَجَاسُوا خِلَالَ الدِّيَارِ وَكَانَ وَعْدًا مَفْعُولًا (5) ثُمَّ رَدَدْنَا لَكُمُ الْكَرَّةَ عَلَيْهِمْ وَأَمْدَدْنَاكُمْ بِأَمْوَالٍ وَبَنِينَ وَجَعَلْنَاكُمْ أَكْثَرَ نَفِيرًا (6)
“যখন দুটোর মধ্যে প্রথম সাবধান বাণীর সময়কাল উপস্থিত হলো,তখন আমি তোমাদের বিরুদ্ধে আমার যুদ্ধবাজ বান্দাদের প্রেরণ করলাম। তারা তোমাদের প্রতিটি ঘরে প্রবেশ করে সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছিল এবং এভাবেই সাবধান বাণী নিশ্চিতভাবে কার্যকর হয়েছিল।” (১৭:৫)
“এরপর আমি তোমাদেরকে আবার তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী করলাম এবং তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দিলাম এবং জনশক্তিতে তোমাদেরকে সংখ্যাগরিষ্ঠ করলাম।” (১৭:৬)

আগের আয়াতে বনী ইসরাইলের হাতে সৃষ্ট দু’টি বিপর্যয়ের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। আর এ আয়াতে আল্লাহ বলছেন: তিনিও দু’টি ক্ষেত্রেই বনী ইসরাইলকে শাস্তি দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলেন। আর আল্লাহ যা বলেন তা পালন করেন।
ইতিহাসে এসেছে, খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে ব্যাবিলনে ‘বোখতুন নাস্‌র’ নামে একজন পরাক্রান্ত ও শক্তিশালী বাদশাহ ছিলেন। তিনি যখন দেখলেন ইহুদি জাতি অবাধ্যতা করছে তখন তাদের উপর হামলা করলেন। তার বাহিনীর হামলায় বহু সংখ্যক ইহুদি নিহত এবং জীবিত বহু লোক বন্দি হয়। এরপর বোখতুন নাসর বাইতুল মোকাদ্দাসে প্রবেশ করে এ শহরটিকে ধ্বংস করে দেন। যতদিন বোখতুন নাসর জীবিত ছিলেন ততদিন বনী ইসরাইল জাতি ব্যাবিলনে তার বন্দিত্বে অপমানিত জীবন-যাপন করেছে। এরপর ইরানের পরাক্রমশালী রাজা সাইরাস ব্যাবিলন জয় করে ইহুদি জাতিকে মুক্ত করে দেন। সাইরাসের অনুমতি নিয়ে বনী ইসরাইল জাতি নিজেদের ভূমিতে ফিরে গিয়ে আবার নতুন করে ঘর-বাড়ি তৈরি করে বসবাস করতে থাকে।

এরপর বনী ইসরাইল জাতি আস্তে আস্তে শক্তিশালী হয় এবং তাদের জনসংখ্যা বেড়ে যায়। তারা আবার অহংকারি হয়ে ওঠে। এ পর্যায়ে রোমের সম্রাট দ্বিতীয় কাইজার বাইতুল মোকাদ্দাসে হামলা চালান। তিনি বাইতুল মোকাদ্দাসকে ধ্বংস এবং জনগণের ধন-সম্পদ লুটপাট করেন।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হল:
এক. অত্যাচারীদের জেনে রাখা উচিত, তার চেয়েও বড় অত্যাচারী পৃথিবীতে আছে। বনী ইসরাইল জাতি অত্যাচার করেছিল বলে তাদের চেয়েও বেশি শক্তিশালী জাতিকে পাঠিয়েছিলেন তাদেরকে শাস্তি দেয়ার জন্য।
দুই. তওবা করতে হবে ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে। তাই কোনো জাতি যদি অতীতের ভুল-ত্রুটির কথা স্বীকার করে সৎ পথে ফিরে আসে, তাহলে তারা ক্ষমা পাবে।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন