সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ১-২
সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ১-২
বনী ইসরাইল পবিত্র কুরআনের ১৭তম সূরা। এটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়। এ সূরার আয়াত সংখ্যা একএকএকটি। এ সূরার প্রথম আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آَيَاتِنَا إِنَّه هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ (1)
“মহিমান্বিত আল্লাহ্,যিনি তাঁর বান্দা (মুহাম্মাদকে) রাত্রিতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন পবিত্র মসজিদুল হারাম থেকে দূরবর্তী মসজিদ মসজিদুল আক্সা পর্যন্ত। যার সীমানাকে আমি করেছিলাম আমার আশীর্বাদ ধন্য,যাতে আমি তাঁকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি। তিনিই একমাত্র যিনি সব শোনেন এবং দেখেন।” (১৭:১)
এ সূরার নাম ‘ইসরাইল’ রাখার রাখা হয় এজন্য যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এ রাতে মে’রাজ পালন করার জন্য আসমানে ভ্রমণ করেছিলেন। রাসূল (সা.) এ ভ্রমণ শুরু করেছিলেন মক্কা থেকে মসজিদুল আক্সা পর্যন্ত সফরের মাধ্যমে। এ সূরার প্রথম আয়াতে এ কথাই বর্ণনা করা হয়েছে। অবশ্য এ আয়াতের পরবর্তী অংশে আল্লাহর একত্ববাদ, কেয়ামত, শিরক ও অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মত কিছু বিষয় কথা বর্ণিত হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে এই বিশ্ব চরাচরের ইতিহাসে পবিত্রতম সফর ছিল রাসূল (সা.) এর মে’রাজ গমন। বিশ্বনবী মে’রাজ হতে ফিরে এসে আসমানের বিশালত্ব এবং সেখানকার ফেরেশতাসহ যা কিছু দেখে এসেছিলেন তা মানুষের সামনে তুলে ধরেছিলেন।
হযরত আদম (আ.) সামান্য ভুলের কারণে আসমান হতে পৃথিবীতে অবতরণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সা.) পৃথিবী থেকে আসমানে আরোহণ করে মানুষের জন্য সত্য বাণী ও সুসংবাদ বয়ে আনেন।
হাদিসের বর্ণনায় এসেছে, বিশ্বনবী (সা.) মে’রাজে গিয়ে নিজের চোখে জান্নাত ও জাহান্নাম দেখেন এবং সেখানে তিনি জান্নাত ও জাহান্নামের অধিবাসীদের অবস্থা খুব কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি সেখানে অতীতের কিছু নবীর সাথে সাক্ষাত করেন এবং বিশ্বের বিস্ময়কর সৃষ্টিগুলো দেখতে পান।
মে’রাজের এ সফর সম্পর্কে সব মুসলমান একমত। যারা মে’রাজের এ সফরকে বিশ্বাস করে না তারা ইসলাম ধর্মের একটি মৌলিক বিষয়কে অস্বীকারকারী হিসেবে পরিগণিত হয়। ইসলামের বেশিরভাগ মাজহাব বিশ্বাস করে, বিশ্বনবী (সা.) স্বশরীরে মে’রাজে গিয়েছিলেন। অন্যদিকে অল্প কিছু মাজহাবের অনুসারীরা মনে করেন, রাসূল (সা.) স্বশরীরে নয় বরং আত্মিকভাবে উর্ধ্বাকাশে গিয়েছিলেন। হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, এ মে’রাজ সংঘটিত হয়েছিল হিজরতের আগের বছর। বিশ্বনবী মক্কার মসজিদুল হারামে মাগরিবের নামাজ আদায় করার পর এ ভ্রমণ শুরু করে বাইতুল মোকাদ্দাসে অবস্থিত পবিত্র মসজিদুল আক্সায় যান। এরপর বোরাক নামক বাহনে চড়ে আসমানে গমন করেন। তিনি এ ভ্রমণ থেকে ফিরে আসার সময় পবিত্র মসজিদুল হারামে ফজরের নামাজ আদায় করেন।
রাসূলুল্লাহর এ মে’রাজ ছিল মহান আল্লাহর অন্যতম মুজিযা। কারণ, মক্কা থেকে বাইতুল মোকাদ্দাসের দূরত্ব এত বেশি যে, ততকালীন সময়ে দুনিয়ার দ্রুততম বাহনটিতে উঠেও এক রাতে এই দূরত্ব অতিক্রম করা সম্ভব ছিল না।
বিস্ময়ের ব্যাপার হল, এই আয়াতে আল্লাহতায়ালা রাসূল (সা.)কে আব্দ্ বা বান্দা হিসেবে উল্লেখ করেছেন, রাসূল বা নবী হিসেবে নয়। এ আয়াতে আল্লাহ বলেন: আমি আমার বান্দা মুহাম্মাদকে রাত্রিতে ভ্রমণ করিয়ে পবিত্র মসজিদ ‘মসজিদুল আক্সায়’ নিয়ে গিয়েছি শুধুমাত্র ইবাদত-বন্দেগীতে তার উচ্চ মর্যাদা থাকার কারণে। অর্থাৎ রাসূল (সা.) যেহেতু আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হয়েছিলেন, তাই তাকে মে’রাজে নিয়ে গিয়েছিলেন মহান আল্লাহ। এ আধ্যাত্মিক সফর আল্লাহর ঘর থেকে শুরু হয়ে আল্লাহর ঘরে এসে শেষ হয়। অর্থাৎ আল্লাহ, রাসূল (সা.)কে ইবাদতের স্থান মসজিদ থেকে উর্ধ্বাকাশে নিয়ে গিয়েছিলেন।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হল:
এক. পার্থিব জগত থেকে আধ্যাত্মিকতার দিকে সফর করার প্রবেশদ্বার হচ্ছে ইবাদত-বন্দেগী।
দুই. আল্লাহর প্রিয়পাত্রে পরিণত হওয়ার জন্য রাত একটি উত্তম সময়। তাইতো রাতে ইবাদত-বন্দেগী ও তওবা করার জন্য বিশেষ দিক-নির্দেশনা রয়েছে।
তিন. ঈমানদারদের জন্য আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশের জন্য মসজিদ হচ্ছে শ্রেষ্ঠ স্থান।
চার. মসজিদুল আকসা হচ্ছে মুসলমানদের জন্য একটি পবিত্র স্থান। তাই এটি রক্ষা করা তাদের ঈমানি দায়িত্ব।
সূরা বনী ইসরাইলের দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে-
وَآَتَيْنَا مُوسَى الْكِتَابَ وَجَعَلْنَاهُ هُدًى لِبَنِي إِسْرَائِيلَ أَلَّا تَتَّخِذُوا مِنْ دُونِي وَكِيلًا (2)
“আমি মুসাকে কিতাব দিয়েছিলাম ও তাকে বনী ইসরাইলীদের জন্য পথ নির্দেশক করেছিলাম;আদেশ দিয়েছিলাম-তোমরা আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে তোমাদের কর্ম-বিধায়ক হিসেবে গ্রহণ কর না।" (১৭:২)
রাসূল (সা.) এর মসজিদুল আকসা সফরের ঘটনা বর্ণনার পর এ আয়াতে বলা হচ্ছে, ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় আল্লাহ তার বান্দাকে একত্ববাদ ও তার উপাসনায় উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছেন। এ লক্ষ্যেই রাসূল (সা.) এর আগেও পৃথিবীতে বহু নবী পাঠিয়েছেন এবং হযরত মুসা (আ.) বনী ইসরাইল জাতির মধ্যে আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত দেয়ার জন্য তাওরাতসহ প্রেরিত হয়েছিলেন। সব নবী-রাসূলরা আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো কিতাব অনুযায়ী মানুষের মধ্যে আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত দেন।
তবে শুধুমাত্র মুখে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকৃতি দেয়া নবী-রাসূলদের উদ্দেশ্য ছিল না, বরং বাস্তবে কাজের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের বিষয়টি প্রমাণ করা ছিল তাদের লক্ষ্য। আল্লাহর একত্ববাদের ওপর বিশ্বাস করার নিদর্শন হল পার্থিব দুনিয়ার প্রতি ভালবাসা ত্যাগ করে স্থায়ী শক্তি আল্লাহর প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি করা।
তাই এ আয়াতে আল্লাহ আরও বলেন: তোমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপর ভরসা কর না। দুনিয়ার ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা যত বড় শক্তিশালীই হোক না কেনো তাদের ওপর নির্ভর না করে শুধুমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করতে হবে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে:
এক. সব নবীর আসমানি কিতাবের দাওয়াতের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে আল্লাহর একত্ববাদ।
দুই. মানুষ তার পার্থিব জীবনে একটি নির্ভরশীল পৃষ্ঠপোষক চায়। সব নবী-রাসূল আল্লাহকে সবচেয়ে নির্ভরশীল পৃষ্ঠপোষক বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন