সূরা কাহাফ; আয়াত ১০৭-১১০

সূরা কাহাফ; আয়াত ১০৭-১১০  

সূরা কাহাফের ১০৭ ও ১০৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
إِنَّ الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ كَانَتْ لَهُمْ جَنَّاتُ الْفِرْدَوْسِ نُزُلًا (107) خَالِدِينَ فِيهَا لَا يَبْغُونَ عَنْهَا حِوَلًا (108)
“নিঃসন্দেহে যারা বিশ্বাস করে এবং সৎকর্ম করে তাদের আতিথেয়তার জন্য রয়েছে ফিরদৌসের নানা উদ্যান।” (১৮:১০৭)
“সেখানে তারা চিরস্থায়ী থাকবে এবং এর পরিবর্তনের আশাও করবে না।” (১৮:১০৮)

আগের পর্বে কুফরি ও সত্যকে অস্বীকারের পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তাদের ভাল কাজগুলোও যে ব্যর্থ হবে এবং তারা যে দোযখে যাবে তা আমরা জেনেছি। এ আয়াতে মুমিন বা বিশ্বাসী সতকর্মশীলদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে যে, আন্তরিক ঈমান ও পছন্দনীয় বা উপযুক্ত সত কাজ তাদেরকে বেহেশতের অধিকারী করবে। আর বেহেশত হচ্ছে ঈমানদার সতকর্মশীল ও পবিত্র ব্যক্তিদের চিরস্থায়ী আবাস। সেখানে কোনো ধরনের ত্রুটি, অভাব, দুর্বলতা, রোগ-শোক ও বিপদ থাকবে না। তাই বেহেশতবাসীরা বেহেশতের চেয়ে উন্নত কোনো স্থানের আশা করবে না।
বিশ্বনবী (সা.)'র পবিত্র হাদীস অনুযায়ী বিভিন্ন পর্যায়ের বেহেশত রয়েছে। সর্বোচ্চ মানের বেহেশত হল জান্নাতুল ফিরদৌস যার কথা এ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ আয়াতের দু’টি শিক্ষা হল:
১. বেহেশতকে গুরুত্ব দেয়া উচিত, একে কোনো অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়। বেহেশতে প্রবেশের জন্য সত কাজ ও ঈমান দুই-ই জরুরি।
২. বেহেশত এত বেশি প্রশস্ত এবং এতে রকমারি নেয়ামতের এত প্রাচুর্য থাকবে যে বেহেশতবাসীরা কখনও এতে ক্লান্তি বোধ করবে না এবং এর চেয়ে উন্নত কোনো স্থানের আশা করবে না।

সূরা আসহাবে কাহাফের ১০৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قُلْ لَوْ كَانَ الْبَحْرُ مِدَادًا لِكَلِمَاتِ رَبِّي لَنَفِدَ الْبَحْرُ قَبْلَ أَنْ تَنْفَدَ كَلِمَاتُ رَبِّي وَلَوْ جِئْنَا بِمِثْلِهِ مَدَدًا (109)
“(হে নবী!) আপনি বলুন, আমার প্রতিপালকের কথা লেখার জন্য যদি সমুদ্রও কালি হয়ে যায়, তবুও আমার প্রতিপালকের কথা শেষ হওয়ার আগেই সমুদ্র নিঃশেষ হয়ে যাবে; যদিও এ কাজে সাহায্যের জন্য আমরা আরও অনুরূপ সমুদ্র নিয়ে আসি।” (১৮:১০৯)

এ সূরায় আসহাবে কাহাফ, হযরত মুসা ও খিজির (আ.) এবং যুলকারনাইনের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। সূরাটির শেষের দিকে বিশ্বনবী (সা.)-কে দু’টি বিষয় কাফের ও মুসলমান নির্বিশেষে সব মানুষের কাছে জানিয়ে দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাই এ আয়াতের শুরুতেই এবং পরের আয়াতের শেষাংশে 'বলুন' বা ক্বুল শব্দটির পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে।
আর এ ক্বুল শব্দটি যদি নাও থাকতো তবুও বোঝা যায় যে, রাসূল (সা.) নিজ থেকে কুরআনের কোনো কথা বলেননি। কুরআনের সব বক্তব্যই আল্লাহর যা রাসূল(সা.)'র ওপর নাজিল হয়েছে।
এ আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহর কথা বা শব্দগুলোর সংখ্যা গুণে শেষ করা যাবে না ও সেগুলোর ব্যাপকতা বোঝাও মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। ব্যাপারটা এমন যে, সব মহাসাগরগুলোর পানিকে যদি কালি বানানো হয় তবু আল্লাহর সব কথা লিখে শেষ করা সম্ভব হবে না। তবে এখানে আল্লাহর কথা বা বাণী বলতে আল্লাহর নিদর্শনগুলো তথা সৃষ্টির সংখ্যাকে বোঝানো হয়েছে।

ক্ষুদ্র এটম বা পরমাণু থেকে বড় বড় গ্রহ, সৌর-জগত বা ছায়াপথ এ সবই আল্লাহর রচিত মহাগ্রন্থের এক একটি শব্দ মাত্র। সবগুলো ঐশী ধর্মগ্রন্থ বা নবীদের কাছে নাজিল হওয়া খোদায়ী প্রত্যাদেশ তথা ওহী আল্লাহর শব্দ তথা নিদর্শন। অন্য কথায় আল্লাহর সব নিদর্শনই তাঁর শব্দ। তাই কুরআনের ভাষায় হযরত ঈসা (আ.)-কে 'আল্লাহর কালেমা' বা আল্লাহর শব্দ বা বাণী বলা হয়েছে। কারণ, তাঁর অস্তিত্বই ছিল মানুষের মধ্যে খোদায়ী অলৌকিক নিদর্শন।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. পুরো সৃষ্টিকুল ও অস্তিত্ব মহান আল্লাহর নিদর্শন। যাদের চোখ ও কান এইসব নিদর্শন দেখতে ও শুনতে পায় তারা পূর্ণতা অর্জনের পথে এসব বিষয় থেকে উপকৃত হয়।
২. মানুষের জ্ঞান যত বেশি হবে ততই তার সামনে অজানা দিগন্তের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে এবং মানুষ কখনও জ্ঞানের শেষ সীমায় পৌঁছতে পারবে না।

সূরা কাহাফের ১১০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَمَنْ كَانَ يَرْجُوا لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا (110
“(হে নবী!) আপনি বলুন, (দৈহিক দৃষ্টিতে) আমি তো তোমাদের মতই মানুষ, (তবে আত্মিক উৎকর্ষ ও ঐশী ধারণক্ষমতার অধিকারী হওয়ার কারণে) আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় তথা ওহী নাজিল হয় যে, আমার ও তোমাদের উপাস্য কেবল এক অদ্বিতীয় উপাস্য। সুতরাং যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাতের আশা করে সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের উপাসনায় কাউকে তাঁর অংশী না করে।” (১৮:১১০)

এ আয়াত সূরা কাহাফের শেষ আয়াত। এ আয়াতে রাসূল (সা.)-কে এটা জানানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তিনি যেন এটা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, আমি তোমাদের মতই রক্ত-মাংসের মানুষ, তবে একমাত্র পার্থক্য হল, আমার কাছে ওহী বা খোদায়ী প্রত্যাদেশ নাজিল হয়। অর্থাত আমি আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে প্রচার করার বা জানিয়ে দেয়ার দায়িত্ব পালন করি। এ বাণীতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে উপাস্য মনে না করার ও সত কাজ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর এ নির্দেশ মেনে চললে পরকালে পুরস্কার হিসেবে বেহেশত দেয়া হবে এবং আল্লাহ তাদের অনুগ্রহ করবেন। এ আয়াতে মুমিনদেরকে কাজেকর্মে আন্তরিক তথা খাঁটি তৌহিদপন্থী বা একত্ববাদ মেনে চলার ক্ষেত্রে আন্তরিক হতে বলা হচ্ছে এবং শির্ক ও লোক-দেখানো কাজকর্ম যা শির্কের সমতুল্য তা থেকে দূরে থাকতে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার :
১. প্রকৃত অবস্থার চেয়ে নিজেকে কখনও বড় করে দেখানো উচিত নয়। নবীরাও নিজেদের মানুষ বলতেন, মানুষের চেয়েও নিজেদের বড় কিছু বলে তাঁরা দাবী করতেন না। এটাই তাঁদের জন্য পূর্ণতা হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ, মানুষই মানুষের জন্য আদর্শ, ফেরেশতা বা অন্য কোনো অস্তিত্ব মানুষের আদর্শ হতে পারে না।
২. সতকর্ম ও ঈমান ছাড়া বেহেশতের আশা করা অলীক স্বপ্ন মাত্র। মানুষের প্রকৃত আশা তার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই ফুটে উঠে।

(সূরা আল কাহাফ সমাপ্ত)
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

 

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন