সূরা কাহাফ; আয়াত ৮৯-৯৪
সূরা কাহাফ; আয়াত ৮৯-৯৪
সূরায়ে কাহাফের ৮৯ থেকে ৯১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
ثُمَّ أَتْبَعَ سَبَبًا (89) حَتَّى إِذَا بَلَغَ مَطْلِعَ الشَّمْسِ وَجَدَهَا تَطْلُعُ عَلَى قَوْمٍ لَمْ نَجْعَلْ لَهُمْ مِنْ دُونِهَا سِتْرًا (90) كَذَلِكَ وَقَدْ أَحَطْنَا بِمَا لَدَيْهِ خُبْرًا (91)
“তারপর (যুলকারনাইন আরেকটি সফরের জন্যে) একটি সরঞ্জাম প্রস্তুত করল।”(১৮:৮৯)
“যার সাহায্যে সূর্যোদয়ের স্থানে গিয়ে পৌঁছল।সেখানে সে দেখল,সূর্য এমন এক জাতির ওপর উদিত হচ্ছে যাদের জন্য রোদ থেকে বাঁচার কোনো ছাউনি কিংবা পরিধেয়র ব্যবস্থা আমি করিনি।”(১৮:৯০)
“এ ছিল তাদের অবস্থা এবং যুলকারনাইনের কাছে যা কিছু ছিল তা আমি জানতাম।”(১৮:৯১)
গত পর্বে বলা হয়েছে, আল্লাহর এক আওলিয়া আল্লাহরই পক্ষ থেকে বহু জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন এবং তাঁকে বিশেষ কিছু ক্ষমতা ও শক্তি দেওয়া হয়েছিল যেগুলোকে কাজে লাগিয়ে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণে যেতেন এবং মানুষের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দিতেন। যুলকারনাইন পশ্চিম ভূখণ্ড সফর করার পর পূর্ব ভূখণ্ডেও সফর করেছিলেন। এ আয়াতে সেই প্রসঙ্গটির প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। যুলকারনাইন যে এলাকায় গিয়েছিলেন ঐ এলাকার লোকজন একেবারেই সাধারণ এবং নিম্নমানের জীবন যাপন করত। তাদের নাগরিক তেমন সুযোগ সুবিধাও ছিল না। তাদের না ছিল ঘরবাড়ি আর না ছিল মাথা গুঁজবার আশ্রয়। বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী তাদের তাদের পরণে কোনো পোশাকও ছিল না। সূর্যের আলো সরাসরি তাদের শরীরে পড়তো। কুরআনে যদিও সেখানে যুলকারনাইনের কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দেয়নি, তবে এলাকার মানুষের জীবন যাপনের অবস্থা বর্ণনা করেছে যাতে বোঝা যায় সে সময়কার ভৌগোলিক এবং ঐতিহাসিক পরিস্থিতি কেমন ছিল।
এ কয়টি আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ
১. আল্লাহর প্রিয় বান্দারা বঞ্চিত জনগোষ্ঠির মুক্তির জন্যে এবং জনকল্যাণ এবং ন্যায়বিচার বিস্তারের জন্যে চেষ্টা প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকেন।
২. শাসকদের উচিত বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে জনগণের বঞ্চনা ও সমস্যাগুলোকে কাছে থেকে দেখা এবং সেইসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা।
সূরা কাহাফের ৯২ থেকে ৯৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
ثُمَّ أَتْبَعَ سَبَبًا (92) حَتَّى إِذَا بَلَغَ بَيْنَ السَّدَّيْنِ وَجَدَ مِنْ دُونِهِمَا قَوْمًا لَا يَكَادُونَ يَفْقَهُونَ قَوْلًا (93) قَالُوا يَا ذَا الْقَرْنَيْنِ إِنَّ يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ مُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ فَهَلْ نَجْعَلُ لَكَ خَرْجًا عَلَى أَنْ تَجْعَلَ بَيْنَنَا وَبَيْنَهُمْ سَدًّا (94)
“আবার সে (আর একটি সফরের) আয়োজন করল।” (১৮:৯২)
“এমনকি যখন দু’পাহাড়ের মধ্যবর্তী এলাকায় পৌঁছল, তখন সেখানে এমন এক জাতির সাক্ষাত পেল,যারা খুব কমই কোনো কথা বুঝতে পারত।” (১৮:৯৩)
“ঐ লোকেরা বলল : হে যুলকারনাইন! ইয়াজুজ ও মাজুজ গোত্র দু’টি এ দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। আমরা কি তোমার জন্যে কিছু খরচের ব্যবস্থা করব যাতে তুমি আমাদের ও তাদের মাঝখানে একটি প্রাচীর নির্মাণ করে দেবে?” (১৮:৯৪)
এ আয়াতটিতে তৃতীয় একটি এলাকার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যে এলাকায় যুলকারনাইন গিয়েছিলেন। কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী তারা সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক থেকে এতোই অনুন্নত এবং পশ্চাৎপদ ছিল যে, তারা এমনকি কথাও বলতে জানতো না, কথা বুঝতেও পারতো না। তৎকালীন সভ্যতা বিবর্জিত এই পর্বত মধ্যবর্তী এলাকায় এক গোত্রের সাথে আরেক গোত্রের কোনো যোগাযোগ কিংবা সম্পর্কও ছিল না। ফার্সি ভাষায় এ পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রবাদও আছে এরকমঃ যে বা যারাই আধুনিক সভ্যতা সম্পর্কে অজ্ঞান, তাদেরকে বলা হয় : “মনে হচ্ছে যেন পাহাড়ের পেছন থেকে এসেছে।”
এই লোকেরা যখন দেখল যে, যুলকারনাইন বেশ শক্তিশালী এবং বহু ক্ষমতার অধিকারী, তখন তারা তাঁকে অনুরোধ করল যেন দুই পাহাড়ের মাঝে একটি প্রাচীর তৈরি করে দেয়। যাতে হিংস্র এবং ভয়াবহ ইয়াজুজ মাজুজ ঐ প্রাচীর অতিক্রম করে এ অঞ্চলের জনগণের ক্ষতি করতে না পারে।
তারা যুলকারনাইনকে বলল : ‘এ কাজের জন্যে যা যা লাগে আমরা তা-ই তোমাকে সরবরাহ করতে রাজি আছি।’এই কওমের পরিচিতি সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেঃ তারা কোনো কথা বুঝতো না, স্বাভাবিকভাবেই আকারে ইঙ্গিতে তারা তাদের আবেদন নিবেদন বোঝানোর চেষ্টা করত। কিংবা যুলকারনাইন হয়ত আল্লাহরই সাহায্যে তাদের কথা বুঝতে পেরেছিল।
মজার ব্যাপার হলো, যুলকারনাইন পিছিয়ে থাকা এই কওমের আবেদনে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছিলেন। পরবর্তী আয়াতে আমরা লক্ষ্য করব তিনি শক্তিশালী এবং দৃঢ় একটি প্রাচীর তৈরি করে দিয়েছেন, যে প্রাচীরটির অস্তিত্ব এখনো টিকে আছে বলে কুরআনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। এটা প্রমাণ করছে যে একটি সমাজের মানুষের জন্যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শাসক গোষ্ঠির উচিত শান্তি ও নিরাপত্তাপূর্ণ জীবনযাপন করার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে দেওয়া। না, কেবল উচিত বলা ঠিক হবে না বরং এটা তাদের দায়িত্ব। রাষ্ট্রকে এ কাজ করতেই হবে যদিও কাজটিতে কোনো অর্থনৈতিক ফায়দা বা স্বার্থ না থাকে কিংবা যদিও কাজটি হয় যথেষ্ট কষ্টসাধ্য এবং বিপুল ব্যয় সাপেক্ষ।
অবশ্য যুলকারনাইন নিজেও জনগণকে সাথে না নিয়ে কিংবা জনগণের সহযোগিতা ছাড়াই কাজটি করেননি। এ ধরনের বিশাল পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জনগণের সহযোগিতা তিনি নিয়েছেন যাতে তারা কাজটির মূল্য ও গুরুত্ব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারে। ভৌগোলিক পর্যালোচনার ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট হয়েছে যে, এই প্রাচীরটি ককেশাসীয় অঞ্চলের দু’টি পর্বতমালার মাঝখানে নির্মাণ করা হয়েছে, ঐ প্রাচীরটি উত্তরকে দক্ষিণ থেকে আলাদা করে ফেলেছে। যুলকারনাইন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। একটি হলো তিনি ছিলেন বিখ্যাত ভূবন পর্যটক আলেক্সান্দার, যিনি পৃথিবীর পূর্বে এবং পশ্চিমে সফর করেছিলেন এবং ঐ সফরকালে তিনি বহু দেশ ও ভূখণ্ড জয় করেছিলেন। কিন্তু তিনি এ ধরনের কোনো প্রাচীর বা বাঁধ নির্মাণ করেছেন-সেরকম কথা ইতিহাসে পাওয়া যায় না। ঐতিহাসিক কোনো তথ্যপঞ্জিতেও এর স্বপক্ষে কোনো বক্তব্য বা দৃষ্টিভঙ্গি মেলে না।
আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গি হলো ; যুলকারনাইন ছিলেন ইরানের হাখামানেশীয় বাদশা খুরুশ যাঁর মাথার টুপি বা হ্যাটটির ওপর দু’টি শিং ছিল। তিনিও পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত ভ্রমণ করেছিলেন। আর ঐ লোহার প্রাচীরটি তিনি নির্মাণ করেছিলেন ককেশাসীয় অঞ্চলেই। তৌরাতসহ বিখ্যাত ইতিহাসবিদদের লেখায় এ সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে।
এ আয়াতগুলো থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হল :
১. মানুষ যখনই প্রয়োজন বোধ করবে এবং পুঁজি বিনিয়োগেও অংশ নিতে চাইবে, তখন শাসকদের উচিত জনগণের আবেদনে সাড়া দেওয়া।
২. নিরপত্তার দাবি পোশাক-আশাক আর বাসাবাড়ির চাহিদার তুলনায় অগ্রগণ্য। যেসব মানুষের পোশাক ছিল না, মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না তখনো তারা নিরাপত্তা আশা করেছিল।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন