সূরা কাহাফ; আয়াত ৭৪-৭৮
সূরা কাহাফ; আয়াত ৭৪-৭৮
সূরা কাহাফের ৭৪, ৭৫ ও ৭৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
فَانْطَلَقَا حَتَّى إِذَا لَقِيَا غُلَامًا فَقَتَلَهُ قَالَ أَقَتَلْتَ نَفْسًا زَكِيَّةً بِغَيْرِ نَفْسٍ لَقَدْ جِئْتَ شَيْئًا نُكْرًا (74) قَالَ أَلَمْ أَقُلْ لَكَ إِنَّكَ لَنْ تَسْتَطِيعَ مَعِيَ صَبْرًا (75) قَالَ إِنْ سَأَلْتُكَ عَنْ شَيْءٍ بَعْدَهَا فَلَا تُصَاحِبْنِي قَدْ بَلَغْتَ مِنْ لَدُنِّي عُذْرًا (76)
“অতঃপর ওরা চলতে লাগল, চলতে চলতে ওদের সঙ্গে এক কিশোরের দেখা হল, খিযির ওকে হত্যা করল; তখন মুসা বলল- তুমি একটি নিরপরাধ জীবনকে হত্যা করলে? নিশ্চয়ই তুমি গুরুতর অন্যায় কাজ করেছো।” (১৮:৭৪)
“খিযির বলল- আমি কি বলিনি যে, তুমি আমার সঙ্গে কিছুতেই ধৈর্য ধারণ করে থাকতে পারবে না?” (১৮:৭৫)
“মুসা বলল- এরপর যদি আমি তোমাকে কোনো বিষয়ে জিজ্ঞাসা করি তবে তুমি আমাকে সঙ্গে রাখবে না। সেক্ষেত্রে আমার পক্ষ থেকে আর কোনো ওজর-আপত্তিও থাকবে না।” (১৮:৭৬)
গত কয়েকটি আয়াতে আমরা বলেছি, পবিত্র কুরআন হযরত মুসা ও হযরত খিযিরের সত্য ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছে, তারা সমূদ্রের তীরে পরস্পরের সঙ্গে সাক্ষাতের পর একটি নৌকায় ওঠেন। হযরত খিযির নৌকায় উঠেই এটির তলায় একটি ছিদ্র করেন। কিন্তু হযরত মুসা (আ.) এর ঘটনা মেনে নিতে পারেননি। তিনি এর প্রতিবাদ করেন।
এই আয়াতে তার পরবর্তী ঘটনা বর্ণনা করে বলা হয়েছে, নৌকা থেকে নামার পর হযরত খিযির একটি এলাকায় পৌঁছে বিনা কারণে এক কিশোরকে হত্যা করেন। স্বাভাবিকভাবে খিযিরের এ কাজও হযরত মুসা মেনে নিতে পারেননি। আল্লাহর একজন পয়গম্বরের পক্ষে এ অন্যায় মেনে নেয়া সম্ভব নয়। এ সম্পর্কে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, হযরত মুসা যদি আরেকটু ধৈর্য ধরতে পারতেন তাহলে তিনি খিযিরের পক্ষ থেকে আরো কিছু অদ্ভুত কাজ দেখতে পেতেন।
হযরত মুসা যদিও নীরব থাকবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কিন্তু দৃশ্যত যেসব কাজ ধর্মীয় নির্দেশ ও নৈতিকতা পরিপন্থী ছিল তা মেনে নেয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না এবং অসত্ কাজে নিষেধ করার দায়িত্ব তাঁকে পালন করতে হতো।
এ তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হল :
১. ধর্মীয় বিধি-বিধান ও দিক-নির্দেশনা পালন সামাজিকভাবে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। কোনো ধরনের প্রতিশ্রুতিই আল্লাহর নির্দেশ পালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না।
২. যে কেউ অন্যায় করুক- তার প্রতিবাদ করতে হবে। এক্ষেত্রে অন্যায়কারীর যদি কোনো ব্যাখ্যা থাকে তা শোনা উচিত। কিন্তু সে যদি ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি বা উর্ধ্বতন কর্মকর্তাও হয় তার অন্যায় কাজের সামনে চুপ করে থাকা যাবে না।
৩- আল্লাহর পাঠানো নবী-রাসূলদের সবার যোগ্যতা ও ধারণক্ষমতা একরকম নয়। এ কারণে তাদের একজনের উত্তম কাজ অন্যজনের চোখে খারাপ ও অন্যায় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
সূরা কাহাফের ৭৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
فَانْطَلَقَا حَتَّى إِذَا أَتَيَا أَهْلَ قَرْيَةٍ اسْتَطْعَمَا أَهْلَهَا فَأَبَوْا أَنْ يُضَيِّفُوهُمَا فَوَجَدَا فِيهَا جِدَارًا يُرِيدُ أَنْ يَنْقَضَّ فَأَقَامَهُ قَالَ لَوْ شِئْتَ لَاتَّخَذْتَ عَلَيْهِ أَجْرًا (77)
“অতঃপর ওরা চলতে লাগল; চলতে চলতে ওরা এক জনপদের অধিবাসীদের কাছে পৌঁছে তাদের কাছে খাদ্য চাইল; কিন্তু তারা ওদের আতিথেয়তা করতে অস্বীকার করল। এরপর সেখানে ওরা পতনোন্মুখ একটি প্রাচীর দেখতে পেল এবং খিযির ওটিকে সুদৃঢ় করে দিল। মুসা বলল- আপনি তো ইচ্ছা করলে এর জন্য পারিশ্রমিক নিতে পারতেন।” (১৮:৭৭)
জাহাজে ছিদ্র করা এবং নিরপরাধ কিশোরকে হত্যা করা ছিল হযরত মুসা (আ.)এর দৃষ্টিতে অত্যন্ত খারাপ ও অন্যায় কাজ। এরপর হযরত খিযির ও হযরত মুসা একটি গ্রামে পৌঁছান। সেখানে তারা এমন একটি প্রাচীর দেখতে পান যেটি ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। সে সময় তাদের দু'জনই ছিলেন অত্যন্ত ক্লান্ত ও ক্ষুধার্থ। কিন্তু ওই গ্রামের মানুষ তাদেরকে কোনো খাবার দেয়নি। কিন্তু এরপরও হযরত খিযির ফাটল ধরা প্রাচীরটি একাই মেরামত করতে লাগলেন। হযরত মুসা তাকে সাহায্য তো করলেনই না বরং এ কাজের প্রতিবাদ জানালেন। তিনি বললেন, যে গ্রামের মানুষ আমাদেরকে খাবার দিল না সেই গ্রামের মানুষের প্রাচীর মেরামত করে দিচ্ছ? যদি কেউ তোমাকে খাদ্য বা টাকা-পয়সা দেয়ার কথা বলতো তাহলেও এ কাজের একটি অর্থ হতো।
এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হল:
১. অন্যরা আমাদের ক্ষতি করেছে বলে তাদের প্রতি দয়া দেখাতে বা তাদের উপকার করতে আমরা যেন পিছ পা না হই। খারাপ কাজের প্রতিদান খারাপ কাজের মাধ্যমে দেয়া উচিত নয়। খিযির যদি প্রাচীরটি মেরামত না করতেন তাহলে সেটি কোনো অন্যায় কাজ হতো না, কারণ তাকে কেউ সেটি মেরামত করতে বলেনি। কিন্তু তিনি অপরের উপকার করার জন্য একাই ক্ষুধার্থ ও ক্লান্ত অবস্থায় প্রাচীরটি মেরামত করে দিয়েছিলেন।
২. আমরা যদি মনে করি কোনো কাজ করা উচিত, তখনই যেন তা সম্পন্ন করি। কেউ কাজটি করতে বলবে বা সে কাজের উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি হবে- এই আশায় যেন বসে না থাকি। এক্ষেত্রে অপরের সমালোচনাও উপেক্ষা করতে হবে।
৩. আল্লাহর পাঠানো নবী-রাসূলরা অর্থ কিংবা মজুরির বিনিময়ে অপরের সেবা করতেন না। তারা কখনও কখনও ক্ষুধার্থ অবস্থায়ও অপরের স্বার্থে কঠোর পরিশ্রম করেছেন।
সূরা কাহাফের ৭৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قَالَ هَذَا فِرَاقُ بَيْنِي وَبَيْنِكَ سَأُنَبِّئُكَ بِتَأْوِيلِ مَا لَمْ تَسْتَطِعْ عَلَيْهِ صَبْرًا (78)
“মুসার সঙ্গী (খিযির) বলল- এখানেই তোমার ও আমার মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হল, যে বিষয়ে তুমি ধৈর্যধারণ করতে পারনি, আমি এখনই তার তাত্পর্য ব্যাখ্যা করছি।” (১৮:৭৮)
হযরত মুসা (আ.) হযরত খিযিরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি যা কিছু দেখবেন তার কোনো প্রতিবাদ করবেন না। কিন্তু পরবর্তীতে খিযিরের তিনটি কাজেরই তিনি প্রতিবাদ করেন। এক দৃষ্টিকোণ থেকে তার প্রতিবাদ যথার্থ ছিল এবং তার পক্ষে নীরব থাকা সম্ভব ছিল না। কোনো মুমিন ব্যক্তি অন্যায় কাজের প্রতিবাদ না করে পারেন না। অন্যদিকে এখানে আল্লাহর দুই নবীর যোগ্যতা ও সহ্য করার ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। হযরত মুসা জানতেন যে, হযরত খিযির তাকে অনেক গোপন বিষয় জানানোর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত হয়েছেন, তারপরও দৃশ্যত তার অন্যায় কাজগুলোর প্রতিবাদ না করে পারেননি। এ কারণে দুই নবীর এ সান্নিধ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি এবং খুব দ্রুত তারা পরস্পরের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যান।
এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:
১. যে কোনো বিষয়ের বাহ্যিক দিকটি দেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ঠিক নয়। হয়ত এর মধ্যে কোনো কল্যাণ লুকিয়ে আছে যা না জেনে প্রতিবাদ করা হবে ভুল।
২. আল্লাহর দু'জন নবী পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে নিজ নিজ দাওয়াতি কাজ সম্পন্ন করতে পারেন। এটি কোনো পরস্পর বিরোধী কাজ নয় এবং নবীদের জন্য এটি কোনো অন্যায় কাজও নয়।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন