সূরা কাহাফ; আয়াত ৬৭-৭৩
সূরা কাহাফ; আয়াত ৬৭-৭৩
সূরা কাহাফের ৬৭ ও ৬৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قَالَ إِنَّكَ لَنْ تَسْتَطِيعَ مَعِيَ صَبْرًا (67) وَكَيْفَ تَصْبِرُ عَلَى مَا لَمْ تُحِطْ بِهِ خُبْرًا (68)
“সে অর্থাৎ খিযির (আ.) মূসা (আ.)কে বলল,আপনি আমার সাথে সবর করতে পারবেন না।” (১৮:৬৭)
“আর তাছাড়া যে ব্যাপারে আপনি কিছুই জানেন না সে ব্যাপারে আপনি সবর করবেনই বা কেমন করে?” (১৮:৬৮)
আগের কয়েকটি পর্বে বলা হয়েছে, হযরত মূসা (আ.) অদৃশ্যের বিষয় আশয় এবং ঐশী জ্ঞান অর্জনের জন্যে খিযির (আ.) এর সাথে দেখা করে তাঁর জ্ঞান ভাণ্ডার থেকে কিছু আহরণ করার চেষ্টা করেছেন। এ লক্ষ্যে তিনি খিযির (আ.) এর সন্ধানে বের হলেন। এই আয়াত দু’টিতে বলা হয়েছেঃ সেই শুরু থেকেই হযরত খিযির (আ.) হযরত মূসা (আ.) কে বলেছিলেন, আমার কাজ কারবার এমন যে তুমি সেসস সহ্য করার মতো ধৈর্যশীল নও অথচ তোমাকে ধৈর্য ধারণ করতেই হবে। যদিও কোনো কিছুর রহস্য না জেনে-বুঝে ধৈর্য ধারণ করাটা খুবই কঠিন একটি কাজ।
এ আয়াত দুটো থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলো :
১. একজন শিক্ষককে অবশ্যই তাঁর ছাত্রের ধারণ ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। প্রয়োজনে ঐ জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে সমস্যাগুলোকে যে-কোনো কৌশলেই হোক বুঝতে দিতে হবে যাতে ছাত্র তার শিক্ষকের সহযাত্রী হবার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে রাখার সুযোগ পায়।
২. অধিকাংশ রাগ, ক্রোধ, বিরোধ, বিতর্কের মূল উৎস হচ্ছে পারস্পরিক চিন্তা চেতনা, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা না থাকা।
এই সূরার ৬৯ এবং ৭০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قَالَ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللَّهُ صَابِرًا وَلَا أَعْصِي لَكَ أَمْرًا (69) قَالَ فَإِنِ اتَّبَعْتَنِي فَلَا تَسْأَلْنِي عَنْ شَيْءٍ حَتَّى أُحْدِثَ لَكَ مِنْهُ ذِكْرًا (70)
“মূসা বলল : “ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে সবরকারী হিসেবেই পাবেন এবং কোনো কাজের ব্যাপারেই আমি আপনার হুকুম অমান্য করব না।” (১৮:৬৯)
“খিযির (আ.) বলল : আচ্ছা,যদি আপনি আমার সাথে চলেন তাহলে আমাকে কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করবেন না যতক্ষণ না আমি নিজে সে সম্পর্কে আপনাকে বলি।” (১৮:৭০)
যাই হোক, মূসা (আ.) শেষ পর্যন্ত হযরত খিযির (আ.) এর সাথে যাবার জন্যে প্রস্তুত বলে জানাল। তিনি খিযির (আ.) এর দেওয়া শর্ত মেনে নিলেন-তিনি কেবল যে প্রতিবাদই করবেন না তাই নয় বরং কোনো কথাই বলবেন না এবং কোনো প্রশ্নও করবেন না। শুধুমাত্র দেখবেন, শুনবেন আর খিযির (আ.) যা আদেশ করেন তা-ই করবেন।
এ আয়াত দুটো থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলো :
১. কাউকে কোনো কাজ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে ‘ইনশাআল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহ যদি চান-এ কথাটা বলতে ভুল করা যাবে না।
২. আল্লাহর প্রিয় এবং নিষ্পাপ ও পবিত্র আওলিয়াদের আনুগত্য করতে হবে। তাঁদের কোনো কাজের রহস্য বুঝে না এলে বিরোধিতা করা যাবে না।
সূরা কাহাফের ৭১ থেকে ৭৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
فَانْطَلَقَا حَتَّى إِذَا رَكِبَا فِي السَّفِينَةِ خَرَقَهَا قَالَ أَخَرَقْتَهَا لِتُغْرِقَ أَهْلَهَا لَقَدْ جِئْتَ شَيْئًا إِمْرًا (71) قَالَ أَلَمْ أَقُلْ إِنَّكَ لَنْ تَسْتَطِيعَ مَعِيَ صَبْرًا (72) قَالَ لَا تُؤَاخِذْنِي بِمَا نَسِيتُ وَلَا تُرْهِقْنِي مِنْ أَمْرِي عُسْرًا (73)
“অতঃপর তারা দু’জন রওয়ানা হলো এবং একটি নৌকায় আরোহণ করল। খিযির (আ.) নৌকা ছিদ্র করে দিল। মূসা তখন বলল : আপনি কি নৌকার সকল আরোহীকে ডুবিয়ে দেবার জন্য তাতে ছিদ্র করলেন? আপনি তো মহা অন্যায় কাজ করলেন।”(১৮:৭১)
“খিযির (আ.) বলল : “আমি না তোমাকে বলেছিলাম,তুমি আমার সাথে সবর করতে পারবে না?” (১৮:৭২)
মূসা বলল : “ভুল চুকের জন্য আমাকে পাকড়াও করবেন না এবং এ কাজের কারণে আপনি আমার ব্যাপারে কঠোর নীতি অবলম্বন করবেন না।”(১৮:৭৩)
এ আয়াতগুলোসহ পরবর্তী আরো কিছু আয়াতে বোঝা যাবে হযরত খিযির (আ.) এর শিক্ষা প্রদান কৌশলটা তাত্ত্বিক কিংবা শাব্দিক ছিল না বরং তাঁর শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল পরিবেশ পরিস্থিতির বৈচিত্র অনুযায়ী ব্যবহারিক। হযরত মূসা (আ.) যেহেতু হযরত খিযির (আ.) এর কাজের রহস্য সম্পর্কে জানতেন না সেজন্যে তিনি তাঁর অদ্ভুত সব কাজকর্ম দেখে চুপ করে থাকতে পারলেন না। যদিও তিনি কথা দিয়েছিলেন কোনো রকম প্রতিবাদ করবেন না কিংবা প্রশ্নও করবেন না।
প্রথম যে ঘটনাটি ঘটল অর্থাৎ নৌকায় উঠেই খিযির (আ.) কোনো কারণ ছাড়াই নৌকা ছিদ্র করে দিলেন। এ কাজের ফলে নৌকার মালিক যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন তেমনি নৌকার আরোহীরা ডুবে যাবেন-এটাই ছিল স্বাভাবিক। বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাই এ কাজটা ছিল শরিয়তেরও বিরোধী। তাছাড়া সুস্থ বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন লোকমাত্রই উপলব্ধি করবেন যে এ কাজের ফলে নৌকার আরোহীদের জীবনও বিপন্ন হবে।
তাই হযরত মূসা (আ.) কল্পনাই করতে পারেন নি যেখানে একজন সাধারণ মানুষও এ ধরনের বিপজ্জনক কাজ করবেন না সেখানে আল্লাহর পক্ষ থেকে যাঁকে জনগণের শিক্ষক হিসেবে পাঠানো হয়েছে তিনি কী করে এ রকম ভয়াবহ কাজ করতে পারেন! সেজন্যে তিনি যে কথা দিয়েছিলেন ভুলে গেছেন এবং এ কাজটা করার ক্ষেত্রে বাধা দিয়েছিলেন। কিন্তু খিযির (আ.) এর জবাব ছিল এই যে, কথা ছিল চুপচাপ থাকবে এবং কোনো কিছু বলবে না। হযরত মূসা (আ.) তাই কথা বলে ফেলার কারণে লজ্জা পেয়েছেন। সেজন্যে তিনি আবেদন জানালেন খিযির (আ.) যেন তাঁর ভুলটা যেন ক্ষমা করে এবং তাঁকে যেন প্রত্যাখ্যান না করে।
এ দুই আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলো :
১. আল্লাহর অলীদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে যদি একবার মেনেই নেওয়া হয় তাহলে তাঁদের কাজের ব্যাপারে প্রতিবাদ করা ঠিক, যদিও তা বাহ্যিক দৃষ্টিতে বিস্ময়করও হয়। ঐ কাজের রহস্যটা উদঘাটিত হওয়া পর্যন্ত কিংবা তিনি নিজে তার ব্যাখ্যা দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত।
২. অন্যায় কাজের মোকাবেলায় চুপ করে থাকা জায়েয নয়। তাই নৌকা ছিদ্র করতে দেখে মূসা (আ.) যে প্রতিবাদ করেছিলেন সেটা ঠিকই ছিল। তবে তাঁর ভুলটা ছিল এই যে তিনি হযরত খিযির (আ.) কে কথা দিয়েছিলেন সেটা ভুলে গিয়েছিলেন।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন