সূরা কাহাফ; আয়াত ৫৭-৬১

সূরা কাহাফ; আয়াত ৫৭-৬১


সূরা কাহাফের ৫৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ ذُكِّرَ بِآَيَاتِ رَبِّهِ فَأَعْرَضَ عَنْهَا وَنَسِيَ مَا قَدَّمَتْ يَدَاهُ إِنَّا جَعَلْنَا عَلَى قُلُوبِهِمْ أَكِنَّةً أَنْ يَفْقَهُوهُ وَفِي آَذَانِهِمْ وَقْرًا وَإِنْ تَدْعُهُمْ إِلَى الْهُدَى فَلَنْ يَهْتَدُوا إِذًا أَبَدًا (57)
“তার চেয়ে বেশি জালিম বা অবিচারক কে হবে, যাকে তার প্রতিপালকের আয়াতসমূহ স্মরণ করানো হয়, অথচ সে তা হতে বিমুখ হয়ে যায়; এবং সে তার সব কাজ বা দু’হাতের পূর্ব-অর্জিত সবকিছুকে ভুলে যায়। নিশ্চয় আমরা তাদের হৃদয়গুলোর ওপর আবরণ দিয়েছি যেন সে (সত্য) হৃদয়ঙ্গম না করতে পারে এবং তাদের শ্রবণেন্দ্রিয়ে বধিরতা সৃষ্টি করেছি। তুমি যদি তাদের সৎপথে আহ্বান কর তবুও তারা কখনও পথনির্দেশ গ্রহণ করবে না।” (১৮:৫৭)

কুরআনের আলোর আলোচনায় বার বার খোদায়ী এই নীতি তুলে ধরা হয়েছে যে, মানুষকে সুসংবাদ ও সতর্ক করার মাধ্যমে সুপথ দেখানোই নবী-রাসূলদের মিশন। এ ব্যাপারে বল প্রয়োগের কোনো অধিকার নবী-রাসূলদের নেই। এটা স্পষ্ট, অনেক মানুষই সত্যকে মানে না ও স্বীকার করে না। কিন্তু একদল মানুষ কেবল সত্যকে অস্বীকারই করে না, একইসঙ্গে নবী-রাসূল ও তাঁদের অনুসারীদের উপহাসও করে। এই শ্রেণীর কাফের ধার্মিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে চরম শত্রুতায় লিপ্ত হয়। তাই এ আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: যারা সত্যকে জানার পরও সত্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় ও আল্লাহর বক্তব্যকে অমান্য করে, তারা আসলে চোখ ও কান বন্ধ করে রেখেছে। আর এ জন্যই তারা কখনও সত্যকে মেনে নিতে প্রস্তুত হয় না। ফলে তারা যে কখনও সুপথ পাবে না তা স্পষ্ট। কারণ, তারা সুপথে চলতে বা সুপথ পেতেই আগ্রহী নয়। ঘুমিয়ে থাকা ব্যক্তি ও ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকা ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ঘুমন্ত ব্যক্তিকে কয়েক বার ডাকার পর এক সময়ে জেগে উঠবে। কিন্তু যে ঘুমের ভান করে শুয়ে আছে তাকে লক্ষ-কোটিবার জাগানোর চেষ্টা করলেও সে জাগবে না।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
এক. অতীতে সম্পাদিত গোনাহ ও অপকর্ম সম্পর্কে উদাসীনতা মানুষের আত্মাকে এত কলুষিত করে যে এর ফলে তারা ধর্মীয় বাস্তবতাগুলোকে অস্বীকার করতে কুণ্ঠিত হয় না।
দুই. সত্যকে বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা খোদায়ী শাস্তির অন্যতম দিক। যারা খোদায়ী নিদর্শনের ব্যাপারে উদাসীন তারা এই শাস্তির শিকার হয়।

সূরা কাহাফের ৫৮ ও ৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَرَبُّكَ الْغَفُورُ ذُو الرَّحْمَةِ لَوْ يُؤَاخِذُهُمْ بِمَا كَسَبُوا لَعَجَّلَ لَهُمُ الْعَذَابَ بَلْ لَهُمْ مَوْعِدٌ لَنْ يَجِدُوا مِنْ دُونِهِ مَوْئِلًا (58) وَتِلْكَ الْقُرَى أَهْلَكْنَاهُمْ لَمَّا ظَلَمُوا وَجَعَلْنَا لِمَهْلِكِهِمْ مَوْعِدًا (59)
“তোমার প্রতিপালক অতিশয় ক্ষমাশীল, দয়ালু। তারা যা কিছু অর্জন করেছে সেজন্য তিনি (আল্লাহ) যদি তাদের শাস্তি দিতে চাইতেন তবে খুব দ্রুত আজাব পাঠাতেন। কিন্তু তাদের জন্য তো এক নির্ধারিত কাল রয়েছে যা হতে তারা কোন আশ্রয়স্থল পাবে না।” (১৮:৫৮)
“এবং সেসব জনপদ, যাদের (অধিবাসীদের) আমরা অবিচারের কারণে ধ্বংস করে দিয়েছি এবং তাদের ধ্বংসের জন্য আমরা স্থির করেছিলাম এক নির্দিষ্ট ক্ষণ।” (১৮:৫৯)

আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় এ আয়াতে বলা হচ্ছে, জালিমদের জুলুম ও পাপাচারের জন্য আল্লাহ যে শাস্তি দিয়ে থাকেন তা একটি ব্যতিক্রমী বিধান মাত্র। কিন্তু আল্লাহর সাধারণ বিধান হল, তিনি পাপের জন্য মানুষকে তড়িঘড়ি বা দ্রুত শাস্তি দেন না। বরং দয়াময় আল্লাহ পাপীকেও তওবা করার ও পাপের ক্ষতিপূরণের সময় দেন। কিন্তু কেউ যদি এই সময়সীমার বা ক্ষমা লাভের সুযোগকে কাজে না লাগায় তাহলে আল্লাহ ন্যায়বিচার অনুযায়ী তার সঙ্গে আচরণ করবেন ও তাকে যথাযথ শাস্তি দেবেন।

এ দুই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. মানুষের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর সাধারণ নীতি হল দয়া ও ক্ষমা করা যতক্ষণ না কেউ নিজেই খোদায়ী রহমত পাওয়ার পথ রুদ্ধ করে দেয়।
২.আল্লাহর দয়া দেখে পাপীদের বেপরোয়া হওয়া উচিত নয় এবং শাস্তি আসতে বিলম্ব হবে মনে করে সংশোধনের সুযোগ নষ্ট করা হবে আত্মঘাতী পদক্ষেপ।
৩. অসত কাজ ও জুলুমের ফলে যুগে যুগে ধ্বংস হয়েছে অনেক জাতি ও সভ্যতা।
৪. যারা জুলুম-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন আল্লাহর রহমতের ব্যাপারে তাদের নিরাশ হওয়া উচিত নয়, ঠিক যেমনটি শাস্তি আসতে বিলম্ব দেখে বা আল্লাহর দয়া দেখে জালিমদেরও বেপরোয়া হওয়া উচিত নয়।

সূরা কাহাফের ৬০ ও ৬১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِفَتَاهُ لَا أَبْرَحُ حَتَّى أَبْلُغَ مَجْمَعَ الْبَحْرَيْنِ أَوْ أَمْضِيَ حُقُبًا (60) فَلَمَّا بَلَغَا مَجْمَعَ بَيْنِهِمَا نَسِيَا حُوتَهُمَا فَاتَّخَذَ سَبِيلَهُ فِي الْبَحْرِ سَرَبًا (61)
“(সে সময়ের ঘটনা স্মরণ কর)যখন মুসা নিজের সঙ্গীকে বলেছিল,‘আমি যাত্রা থেকে নিবৃত্ত হব না,যতক্ষণ না দুই সাগরের মিলন-স্থলে পৌঁছে যাব অথবা যুগ যুগ ধরে চলতে থাকব।”(১৮:৬০)
“অতঃপর যখন তারা উভয়ের ( বা সমুদ্রদ্বয়ের) সঙ্গমস্থলে পৌঁছল,তারা তাদের মাছটির কথা ভুলে গেল,আর তা সমুদ্রের দিকে নিজের পথ ধরল।”(১৮:৬১)

এ দুই আয়াতে হযরত মুসা (আ.) ও খিজির (আ.)'র ঘটনার বর্ণনা শুরু হয়েছে। ঘটনাটির পটভূমি হল, মহান আল্লাহ হযরত মুসা (আ.)-কে যখন তার চেয়েও বেশি জ্ঞানী এক ব্যক্তির অস্তিত্বের কথা জানান তখন মুসা (আ.) খিজির (আ.) নামের ওই ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে চান ও তাঁর কাজ থেকে জ্ঞান অর্জন করতে আগ্রহী হন। আল্লাহ মুসা (আ.)-কে জানান যে, দুই সাগরের মিলন-স্থলে তাঁর সাক্ষাত পাবে। আর এক্ষেত্রে সঠিক পথ খুঁজে পাওয়ার জন্য একটি মাছ সঙ্গে নাও, যেখানে মাছটিকে আর দেখবে না, সেখানেই ওই জ্ঞানীর সাথে দেখা হবে। হযরত মুসা (আ.) ও তাঁর সঙ্গী ইউশা' যাত্রা শুরু করেন। সাগরের তীরে পৌঁছার পর মুসা (আ.) একটি পাথরের বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েন বিশ্রাম নেয়ার জন্য। কিন্তু তার সঙ্গী জেগে ছিলেন। ইউশা দেখেন যে মাছটি চলতে শুরু করেছে ও সাগরে ঝাঁপ দিয়েছে। কিন্তু মুসা (আ.) ঘুমে থাকায় তিনি তাকে এ বিষয়টি জানাননি। মুসা (আ.) ঘুম থেকে জাগার পর ইউশা মাছটির ঘটনা তাঁর সঙ্গীকে বলতে ভুলে যান। ফলে তারা পথ চলতে থাকেন। এক সময় মুসা (আ.) ক্ষুধা অনুভব করলে ইউশা মাছের ঘটনাটি তাঁকে বলেন। ফলে তাঁরা ঠিক যেখানে মাছটি সাগরে লাফিয়ে পড়েছিল সেই স্থানটিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তী আয়াতে এ ঘটনার বাকি অংশ শুনতে পাবেন।

এ দুই আয়াতের দু’টি শিক্ষণীয় দিক হল:
এক. নবী-রাসূলগণও জ্ঞান অর্জনে সচেষ্ট ছিলেন। তাঁরা জ্ঞানীর খোঁজে ও তাদের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জনের জন্য দীর্ঘ সফরের কষ্টও সহ্য করতেন।
দুই. জ্ঞান-পিপাসীর উচিত জ্ঞানীর কাছে যাওয়া, জ্ঞানী ব্যক্তি শিক্ষার্থীদের কাছে যাবেন এমন প্রত্যাশা করা উচিত নয়। জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে অব্যাহত প্রচেষ্টা ও অধ্যবসায় জরুরি।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

 

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন