সূরা কাহাফ; আয়াত ৪৫-৪৯
সূরা কাহাফ; আয়াত ৪৫-৪৯
সূরা কাহাফের ৪৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন-
وَاضْرِبْ لَهُمْ مَثَلَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَاءٍ أَنْزَلْنَاهُ مِنَ السَّمَاءِ فَاخْتَلَطَ بِهِ نَبَاتُ الْأَرْضِ فَأَصْبَحَ هَشِيمًا تَذْرُوهُ الرِّيَاحُ وَكَانَ اللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ مُقْتَدِرًا (45)
“তাদের জন্য দুনিয়ার জীবনের দৃষ্টান্ত তুলে ধরুন। এ জীবন এমন পানির মত যা আমরা আকাশ থেকে বর্ষণ করি, ফলে ধরণী উদ্ভিদে ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু শিগগিরই তা শুকিয়ে যায় এবং বাতাস তাকে বিক্ষিপ্তভাবে (সব দিকে) উড়িয়ে নিয়ে যায়। আল্লাহ্র ক্ষমতা সব কিছুর উপরে শক্তিমান।” (১৮:৪৫)
এর আগের আয়াতে কাফের ও মুমিনদের অবস্থার দৃষ্টান্ত তুলে ধরার পর এ আয়াতে পৃথিবীর অবস্থার পরিবর্তন সম্পর্কে দৃষ্টান্ত দেয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলছেন, দুনিয়ার অবস্থা শেকড়বিহীন উদ্ভিদের মত যা সামান্য বৃষ্টির ফলেই ব্যাপকভাবে জন্ম নেয় ও সবুজ হয়ে ওঠে। আবার অল্প তপ্ত বাতাসেই শুকিয়ে নির্মূল হয়ে যায়। বসন্তকালে যেসব এলাকায় দেখা যায় সবুজের সমারোহ, সেসব এলাকা শরত ও শীতকালে হয়ে পড়ে নিষ্প্রাণ মরুভূমির মত। কারণ শরত ও শীতকালে গাছপালার পাতা ঝরে গিয়ে শুকিয়ে যায়। এই পরিবর্তন দেখার জন্য খুব দীর্ঘ জীবনের দরকার হয় না। প্রতি বছরই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে এই দৃশ্যের। গাছপালার এই সংক্ষিপ্ত জীবন আরো সংক্ষিপ্ত হয় যখন প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ দেখা দেয় বা কোনো দুর্ঘটনা ঘটে। যেমন, পোকা-মাকড়ের আক্রমণ ঘটলে এইসব গাছপালার জীবন আরো সংক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
এক. কুরআন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মহাগ্রন্থ। আর এ জন্যই মানুষের জন্য কার্যকর উপদেশ হিসেবে এতে স্থান পেয়েছে অনেক উপমা।
দুই. ক্ষণস্থায়ী এ জীবনের চাকচিক্য যেন আমাদের প্রতারিত না করে। তাই পরকাল ও বিচার দিবসের সম্বল অর্জনের জন্য আমাদের সচেষ্ট হওয়া উচিত।
সূরা কাহাফের ৪৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
الْمَالُ وَالْبَنُونَ زِينَةُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَالْبَاقِيَاتُ الصَّالِحَاتُ خَيْرٌ عِنْدَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَخَيْرٌ أَمَلًا (46)
“সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি এই পার্থিব জীবনের শোভা। কিন্তু যা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে তা হচ্ছে সৎকাজ। [ আর তা হচ্ছে ] আপনার পালনকর্তার দৃষ্টিতে পুরস্কার পাওয়ার জন্য এবং আশান্বিত হওয়ার জন্যেও সর্বোৎকৃষ্ট।”(১৮:৪৬)
উদ্ভিদের সংক্ষিপ্ত জীবনের দৃষ্টান্ত দেয়ার পর এ আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দুনিয়ার জীবনের শোভা মাত্র। পরকালে এইসব কোনো কাজে আসে না। সেখানে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হল সতকর্ম। অবশ্য কেউ যদি নিজেকে জাহির করার জন্য ও অন্যদের কৃপা করছে এমন ভাব দেখানোর জন্য কিংবা অন্যদের উপকার করার পর উপকারের খোটা দেয়ার জন্য সত কাজ করে তাহলে সেইসব সত কাজের কোনো পারলৌকিক প্রতিদান পাবে না, এমনকি দুনিয়াতেও সেইসব সতকাজ হবে মূল্যহীন। অন্য কথায় লোক-দেখানো সত কাজ পরকাল পর্যন্ত পৌঁছবে না।
এ জন্যই পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে কেউ যদি এমন সত কাজ করে যে তা পরকালেও টিকে থাকে, তাহলে তার পুরস্কার হবে বহু গুণ বেশি। এ আয়াতে আল্লাহ বলছেন: আল্লাহর প্রতিদান তোমাদের কাজের চেয়ে অনেক গুণ উত্তম। যদি আশাই করতে চাও তাহলে আল্লাহর দয়া ও করুণার প্রতি আশান্বিত হও। অন্যদের ওপর ভরসা কোরো না।
এ আয়াত থেকে মনে রাখা দরকার:
এক. ইহকালীন জীবনে সম্পদ ও বিত্তের মালিক হওয়া এবং না হওয়ার জন্য গর্বিত বা হতাশ হওয়া উচিত নয়। কারণ, বিচার-দিবসই হল গুরুত্বপূর্ণ। বিচার-দিবসে সতকাজই হল মানদণ্ড, পদবী বা বংশ-পরিচয়ের কোনো মূল্য সেখানে নেই।
দুই. পার্থিব সব বিষয়ই ধ্বংস বা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কেবল সত কাজই টিকে থাকবে এবং আল্লাহ সতকাজের প্রতিদান দেয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছেন।
সূরা কাহাফের ৪৭, ৪৮ ও ৪৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَيَوْمَ نُسَيِّرُ الْجِبَالَ وَتَرَى الْأَرْضَ بَارِزَةً وَحَشَرْنَاهُمْ فَلَمْ نُغَادِرْ مِنْهُمْ أَحَدًا (47) وَعُرِضُوا عَلَى رَبِّكَ صَفًّا لَقَدْ جِئْتُمُونَا كَمَا خَلَقْنَاكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ بَلْ زَعَمْتُمْ أَلَّنْ نَجْعَلَ لَكُمْ مَوْعِدًا (48) وَوُضِعَ الْكِتَابُ فَتَرَى الْمُجْرِمِينَ مُشْفِقِينَ مِمَّا فِيهِ وَيَقُولُونَ يَا وَيْلَتَنَا مَالِ هَذَا الْكِتَابِ لَا يُغَادِرُ صَغِيرَةً وَلَا كَبِيرَةً إِلَّا أَحْصَاهَا وَوَجَدُوا مَا عَمِلُوا حَاضِرًا وَلَا يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَدًا (49)
“যেদিন আমি পর্বতগুলোকে গতিশীল করব এবং আপনি পৃথিবীকে দেখবেন একটি প্রকাশিত ও সমতল প্রান্তর। আমি প্রত্যেক মানুষকে একত্রিত করব অতঃপর তাদের কাউকে ছাড়ব না।”(১৮:৪৭)
“তাদেরকে আপনার পালনকর্তার সামনে উপস্থিত করা হবে সারিবদ্ধ ভাবে এবং (তাদেরকে) বলা হবে: তোমরা সবাই আমার কাছে এসে গেছ; যেমনটি তোমাদেরকে প্রথম বার সৃষ্টি করেছিলাম। না,তোমরা তো বলতে যে, আমি তোমাদের জন্যে কোন প্রতিশ্রুত স্থান বা বিচার দিসব নির্দিষ্ট করব না।” (১৮:৪৮)
“আর মানুষের আমলনামা সামনে রাখা হবে। তাতে যা আছে; তার কারণে আপনি অপরাধীদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত দেখবেন। তারা বলবেঃ হায় আফসোস, এ কেমন আমলনামা। এ যে ছোট বড় কোন কিছুই বাদ দেয়নি-সবই এতে রয়েছে। তারা তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পাবে। আপনার পালনকর্তা কারও প্রতি জুলুম করবেন না।” (১৮:৪৯)
দুনিয়ার ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির অস্থায়িত্বের কথা উল্লেখের পর এই আয়াতে কিয়ামত বা পুনরুত্থানের কথা বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলছেন, বর্তমান যে দুনিয়া তোমরা দেখছ তা পুরোপুরি ধ্বংস করে দেব আমি। পাহাড়গুলো বিলুপ্ত করব আমি। ফলে ভূমি হবে সমতল ও বিস্তৃত। সূর্য ও নক্ষত্রগুলো নিভিয়ে দেব। ফলে নতুন বিশ্ব দেখতে পাবে নতুন ব্যবস্থার আওতায়। সব মানুষকে একই সময়ে একই স্থানে জীবিত অবস্থায় উপস্থিত করা হবে। এভাবে তারা সবাই হাজির হবে আল্লাহর দরবারে। প্রত্যেক ব্যক্তির কর্মকাণ্ডের রেকর্ড তুলে ধরে তার ভাগ্য নির্ধারণ করা হবে। ফলে পাপীরা থাকবে ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায়। কারণ, তারা জানে যে পৃথিবীতে কত অপরাধই না তারা করেছে এবং তারা দেখবে যে তাদের ছোট বড় সব গোনাহই রেকর্ড করা হয়েছে। তাই অস্বীকার করার ও পালানোর কোনো পথ নেই।
এ তিন আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
এক. পুনরুত্থান বা কিয়ামতের দিন মানুষের উপস্থিতি হবে বর্তমান দুনিয়ার উপস্থিতির মতই শারীরিক।
দুই. পরকাল ও কিয়ামতের ব্যাপারে উদাসীনতা এবং এর প্রতি গুরুত্ব না দেয়া কিয়ামতের দিন আতঙ্ক ও অশেষ অনুশোচনার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
তিন. কিয়ামত বা বিচার-দিবসে কেবল মানুষের ততপরতার রেকর্ডই প্রকাশ করা হবে। দুনিয়ার ধন-সম্পদ, পদবী বা অন্য কিছুই মানুষের সঙ্গে থাকবে না।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন