সূরা কাহাফ; আয়াত ২২-২৬
সূরা কাহাফ; আয়াত ২২-২৬
সূরা কাহাফের ২২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন-
سَيَقُولُونَ ثَلَاثَةٌ رَابِعُهُمْ كَلْبُهُمْ وَيَقُولُونَ خَمْسَةٌ سَادِسُهُمْ كَلْبُهُمْ رَجْمًا بِالْغَيْبِ وَيَقُولُونَ سَبْعَةٌ وَثَامِنُهُمْ كَلْبُهُمْ قُلْ رَبِّي أَعْلَمُ بِعِدَّتِهِمْ مَا يَعْلَمُهُمْ إِلَّا قَلِيلٌ فَلَا تُمَارِ فِيهِمْ إِلَّا مِرَاءً ظَاهِرًا وَلَا تَسْتَفْتِ فِيهِمْ مِنْهُمْ أَحَدًا (22)
“অজ্ঞাত বিষয়ে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে এখন তারা বলবে:আসহাবে কাহাফ ছিল তিন জন; তাদের চতুর্থটি ছিল তাদের কুকুর। আরেক দল বলবে: তারা ছিল পাঁচ জন।তাদের ষষ্ঠটি ছিল তাদের কুকুর। কেউ কেউ বলবে: তারা ছিল সাত জন। তাদের অষ্টমটিছিল তাদের কুকুর। (হে রাসূল! আপনি) বলুন: আমার পালনকর্তা তাদের সংখ্যা ভাল জানেন। তাদের খবরঅল্প লোকই জানে। সাধারণ আলোচনা ছাড়া আপনি তাদের সম্পর্কে বিতর্ক করবেন নাএবং তাদের অবস্থা সম্পর্কে তাদের কাউকে জিজ্ঞাসাবাদও করবেন না।” (১৮:২২)
আসহাবে কাহাফের ঘটনা বর্ণনা করার পর এ আয়াতে বলা হচ্ছে, তাদের ঘটনা বর্ণনার মূল উদ্দেশ্য উপলব্ধি না করে মানুষ গুহাবাসীর সংখ্যা নিয়ে অনর্থক বিতর্কে জড়িয়ে পড়বে। অথচ এ ঘটনা বর্ণনা করার উদ্দেশ্য মোটেই গুহাবাসী ঈমানদার লোকদের সংখ্যা জানানো নয়, বরং তারা ঈমানি বলে বলীয়ান হয়ে কীভাবে আল্লাহর বিশেষ সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন তা থেকে মানুষকে শিক্ষা দেয়া।
গুহাবাসীর সংখ্যা পাঁচ জন ছিল নাকি সাত জন এটি বড় কথা নয়। তারা যে মহান কাজ করেছিলেন অর্থাত্ নিজেদের ঈমান টিকিয়ে রাখার জন্য বিলাসবহুল জীবন ত্যাগ করে গুহায় আশ্রয় নিয়ে আল্লাহর খাঁটি বান্দায় পরিণত পতে পেরেছিলেন, তাতে তাদের সংখ্যা কোনো অনুঘটক ভূমিকা পালন করেনি। তিন, পাঁচ বা সাত যাই হোক না কেনো তার ফলে আসহাবে কাহাফের ঘটনার গুরুত্ব মোটেও কম-বেশি হয় না। কিন্তু দুঃখজনকভাবে মানুষ কুরআনের আসল লক্ষ্য উপলব্ধি না করে অনর্থক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে এবং যে বিষয়ে তাদের কোনো জ্ঞান নেই তা নিয়ে মত প্রকাশে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়।
আল্লাহ-তায়ালা এ সম্পর্কে রাসূল (স.)কে বলেন: এ সম্পর্কে জনগণের সঙ্গে বিতর্কে জড়াবেন না। তাদের কাছ থেকে কিছু জিজ্ঞাসাও করবেন না। তাদেরকে বিতর্ক করতে দিন। আল্লাহ গুহাবাসীর সংখ্যা সম্পর্কে ভালোভাবেই অবহিত।
এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে :
১. যে বিষয়ে আমাদের কোনো জ্ঞান নেই সে বিষয় ধারনা করে কিছু বলব না, অহেতুক তর্ক-বিতর্ক করা থেকে দূরে থাকব।
২. ঐতিহাসিক ঘটনা শোনার সময় সে ঘটনার শিক্ষণীয় দিকগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। অনর্থক ওই ঘটনায় জড়িত মানুষের সংখ্যা কিংবা দিন-তারিখ নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই।
সূরা কাহাফের ২৩ ও ২৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَلَا تَقُولَنَّ لِشَيْءٍ إِنِّي فَاعِلٌ ذَلِكَ غَدًا (23) إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ وَاذْكُرْ رَبَّكَ إِذَا نَسِيتَ وَقُلْ عَسَى أَنْ يَهْدِيَنِ رَبِّي لِأَقْرَبَ مِنْ هَذَا رَشَدًا (24)
“কখনও তুমি কোনো বিষয়ে এ কথা বল না যে- আমি এটি আগামীকাল করব।” (১৮:২৩)
“ইনশাআল্লাহ কথাটি না বলে। যদি (কথাটি বলতে) ভুলে যাও, তাহলে (যখনই তোমার মনে আসবে) তোমার প্রতিপালককে স্মরণ কর ও বল- সম্ভবত আমার প্রতিপালক আমাকে এ (গুহাবাসীর বিবরণ) অপেক্ষা সত্যের নিকটতর পথ নির্দেশ করবেন।” (১৮:২৪)
এ আয়াতে একটি সামগ্রিক নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যদিও এ নির্দেশ প্রাথমিকভাবে রাসূল (সা.)কে দেয়া হয়েছে কিন্তু আসলে এটি পালনে প্রতিটি মুসলমান বাধ্য।
এ আয়াতের নির্দেশ অনুযায়ী প্রতিটি মু’মিন যখনই মুখ থেকে ভবিষ্যত প্রসঙ্গে কোনো প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করবে তখনই তাকে বলতে হবে ইনশাআল্লাহ। এ কথা বলার কারণ হল মু’মিন ব্যক্তি নিজে যেমন উপলব্ধি করবেন তেমনি শ্রোতাও বুঝে যাবেন কাজটি একমাত্র আল্লাহ চাইলেই সম্পন্ন হবে। আল্লাহ না চাইলে এ পৃথিবীর কোনো কাজই সংঘটিত হয় না। অন্যভাবে বলা যায়, ঈমানদার ব্যক্তিরা যে সব শব্দ অনেক বেশি ব্যবহার করেন তার একটি হল ‘ইনশাআল্লাহ’। তাই কুরআনেও দেখা যায়, আল্লাহর কয়েকজন নবী যেমন হযরত ইয়াকুব, হযরত শোয়াইব, হযরত খিজির ও হযরত ইসমাইল কথা বলার সময় ‘ইনশাআল্লাহ’ পরিভাষাটি ব্যবহার করেছেন।
এটা স্পষ্ট যে, এ পরিভাষাটি মু’মিন ব্যক্তিদের মূদ্রাদোষ নয়, বরং তাদের এ কথায় আল্লাহর প্রতি তাদের গভীর বিশ্বাস ও পরম নির্ভরতার বিষয়টি ফুটে ওঠে। যে কোনো কাজ করার ব্যাপারে প্রত্যেক ব্যক্তির কিছু ক্ষমতা ও স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু তারপরও সেই ক্ষমতা ও স্বাধীনতা ব্যবহার করে ব্যক্তি কাজটি করতেই পারবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই। কারণ, কাজটি সম্পন্ন হওয়ার পেছনে আরো অনেক উপাদান জড়িত রয়েছে। তাই মানতে হবে, আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কোন কাজই সম্পন্ন হয় না।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:
১. আমরা কখনও আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতা ছাড়া শুধুমাত্র নিজস্ব শক্তির উপর নির্ভর করে কথা বলবো না। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া যে এক মুহূর্তের জন্যও আমাদের বেঁচে থাকা সম্ভব নয়, সে বিষয়টি সারাক্ষণ মনে রাখতে হবে।
২. নবী রাসূলদের দৈনন্দিন জীবনে চলার জন্য যখন আল্লাহর দিক-নির্দেশনা প্রয়োজন তখন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মতো সাধারণ মানুষ আল্লাহর পথনির্দেশনা ছাড়া সঠিক পথে চলতে পারবো না। এজন্য আমাদের উচিত সবসময় আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম পথে চলার তৌফিক কামনা করা।
সূরা কাহাফের ২৫ ও ২৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَلَبِثُوا فِي كَهْفِهِمْ ثَلَاثَ مِئَةٍ سِنِينَ وَازْدَادُوا تِسْعًا (25) قُلِ اللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا لَبِثُوا لَهُ غَيْبُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ أَبْصِرْ بِهِ وَأَسْمِعْ مَا لَهُمْ مِنْ دُونِهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا يُشْرِكُ فِي حُكْمِهِ أَحَدًا (26)
“সুতরাং তারা গুহাতে অবস্থান করেছিল তিনশ’ বছর এবং আরো নয় বছর।” (১৮:২৫)
“তুমি বল- তারা কতকাল ছিল তা আল্লাহই ভলো জানেন, আসমান ও জমিনের অজ্ঞাত বিষয়ের জ্ঞান তাঁরই। কত (সুন্দর) তাঁর দর্শন ও শ্রবণ শক্তি। তিনি ছাড়া মানুষের অন্য কোনো অভিভাবক নেই। তিনি কাউকেই নিজ কর্তৃত্বের শরীক করেন না।” (১৮:২৬)
এই দুই আয়াতে আবার আসহাবে কাহাফের ঘটনায় ফিরে গিয়ে বলা হয়েছে: আল্লাহর ইচ্ছায় তারা তিনশ’ নয় বছর গুহার মধ্য জীবিত ছিলেন। যদিও এই দীর্ঘ সময় সম্পর্কে গুহাবাসী কিংবা সে যুগের অন্য কোনো মানুষ কিছু জানতে পারেননি। একমাত্র আল্লাহ তাদের সম্পর্কে জানতেন এবং তিনি গুহায় এমন অবস্থা তৈরি করে দেন যাতে তারা সুস্থ অবস্থায় ৩০০ বছর ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে পারেন।
খাদ্য গ্রহণ ছাড়া ৩০০ বছর গুহার মধ্য সুস্থভাবে বেঁচে থাকা আল্লাহর মু’জিযা বা অলৌকিক ক্ষমতা ছাড়া সম্ভব ছিল না। আল্লাহ তায়ালা এ কাজ করেছেন যাতে ভবিষ্যতে মানুষ এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয় এবং এটি ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:
১. সংখ্যা ও পরিমাণ যেখানে বিষয়ের গুরুত্ব নির্ণয় করে সেখানে অবশ্যই তা সঠিকভাবে উল্লেখ করতে হবে। আসহাবে কাহাফের ঘটনায় তাদের ঘুমানোর সময়টি আল্লাহর ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২. আল্লাহ সৃষ্টির মালিক এবং পরিচালক। সেইসঙ্গে তিনি প্রকাশ্য ও গোপন সবকিছু জানেন। তাই তার প্রভাব বলয়ের বাইরে কোথাও পালিয়ে যাওয়া বা অন্যের কাছে আশ্রয় নেয়া সম্ভব নয়। বরং উল্টো অন্যদের অত্যাচার ও অবিচার থেকে মুক্তি পেতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় নিতে হবে এবং তার কাছে সাহায্য চাইতে হবে।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন