সূরা কাহাফ; আয়াত ১১-১৪

সূরা কাহাফ; আয়াত ১১-১৪


সূরা কাহাফের ১১ ও ১২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
فَضَرَبْنَا عَلَى آَذَانِهِمْ فِي الْكَهْفِ سِنِينَ عَدَدًا (11) ثُمَّ بَعَثْنَاهُمْ لِنَعْلَمَ أَيُّ الْحِزْبَيْنِ أَحْصَى لِمَا لَبِثُوا أَمَدًا (12)
“এরপর আমি গুহার ভেতরে তাদের কানের উপর কয়েক বছরের জন্য নিদ্রারপর্দা টেনেদিয়েছিলাম।” (১৮:১১)
“পরবর্তীতে আমিতাদের জাগিয়ে দিলাম এ পরীক্ষা করার জন্য যে,দুই দলের মধ্যে কোন্‌ দল (গুহায়) তাদের অবস্থানকাল সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারে।” (১৮:১২)

আগের আয়াতে আমরা আলোচনা করেছি, কিছু ঈমানদার লোক ঈমান রক্ষা করার জন্য নিজেদের শহর ত্যাগ করে গুহার মধ্য লুকিয়ে ছিলেন। সে সময় তারা আল্লাহর কাছে নিজেদের মুক্তির জন্য আবেদন করেন। আর এ আয়াতে বলা হচ্ছে, আল্লাহ তাদের চোখে এত গভীর ঘুম দিয়ে দেন যে, তাতে শুধু তাদের চোখই বন্ধ হয়নি, সেই সঙ্গে তাদের কানের উপরও এক ধরনের পর্দা টানা হয়েছিল যাতে কোনো শব্দ তাদের ঘুম ভাঙাতে না পারে।

এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, আল্লাহ এ কথা বলেননি যে, তাদের চোখে আমি গভীর ঘুম দিয়েছিলাম। বরং বলেছেন, তাদের কানের উপর নিদ্রার পর্দা টেনে দিয়েছিলাম। সাধারণত ঘুমের সময় মানুষের চোখ বন্ধ থাকলেও কান খোলা থাকে এবং শুনতে কোনো সমস্যা হয় না। এ কারণে বাইরের শব্দে মানুষের ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু আসহাবে কাহাফের ঈমানদার পুরুষদের ঘুম যাতে কোনো শব্দে ভেঙে না যায় সেজন্য আল্লাহ তাদের কানের উপর নিদ্রার পর্দা টেনে দিয়েছিলেন। এ দুই আয়াতের পরবর্তী অংশে আরো বলা হয়েছে: তাদেরকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়ার পর তারা ঠিক কত সময় ঘুমিয়ে ছিলেন এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। পরের আয়াতে এ বিষয়ে আলোচনা করা হবে।

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:

১. আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যদি কেউ বিদ্রোহ করে তাহলে আল্লাহ তাকে বিভিন্নভাবে দয়া ও সাহায্য করেন। এ সাহায্য পাওয়ার জন্য জেগে থাকতেই হবে এমন কোনো কথা নেই, ঘুমের মধ্যেও সে সাহায্য পৌঁছে যায়।
২. আল্লাহ সব বস্তু ও মানুষের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখেন এবং সবকিছু জানেন। যদিও মানুষ নিজের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের বহু বিষয় উপলব্ধি করতে পারে না বা সব বিষয় তার নিজের কাছেই স্পষ্ট নয়।

সূরা কাহাফের ১৩ ও ১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
نَحْنُ نَقُصُّ عَلَيْكَ نَبَأَهُمْ بِالْحَقِّ إِنَّهُمْ فِتْيَةٌ آَمَنُوا بِرَبِّهِمْ وَزِدْنَاهُمْ هُدًى (13) وَرَبَطْنَا عَلَى قُلُوبِهِمْ إِذْ قَامُوا فَقَالُوا رَبُّنَا رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ لَنْ نَدْعُوَ مِنْ دُونِهِ إِلَهًا لَقَدْ قُلْنَا إِذًا شَطَطًا (14)
“আপনার কাছে তাদের ইতিবৃত্ত সঠিকভাবে বর্ণনা করছি। তারা ছিল কয়েকজনযুবক। তারা তাদের পালনকর্তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল এবং আমি তাদেরসত্‌পথে চলার শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছিলাম।”(১৮:১৩)
“আমি তাদের মন দৃঢ় করেছিলাম,যখন তারা উঠে দাঁড়িয়েছিল (বা অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল)। অতঃপর তারা বলল:আমাদের প্রভু আসমান ও জমিনের পালনকর্তা। আমরা কখনও তার পরিবর্তে অন্য কাউকে উপাস্য বলে স্বীকার করব না। যদি করি,তবে তা হবেঅত্যন্ত গর্হিত কাজ।” (১৮:১৪)

আসহাবে কাহাফের ঘটনা সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করার পর এ আয়াতে তাদের দেশত্যাগের ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথমে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (স.)কে উদ্দেশ করে আল্লাহ বলেন: আসহাবে কাহাফের যুবকদের সম্পর্কে মানুষের মধ্যে নানা ধরনের ধারণা প্রচলিত থাকতে পারে। কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে এ সম্পর্কে যা কিছু বলা হচ্ছে তাই সত্য ও বাস্তব।

তারা কতজন ছিলেন, কতদিন গুহার মধ্যে লুকিয়ে ছিলেন এবং ইতিহাসের ঠিক কোন্‌ সময়ে এ ঘটনা ঘটেছিল তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হল তারা ঈমানদার ছিলেন এবং নিজেদের ঈমান রক্ষা করার জন্য তারা অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। এ কারণে আল্লাহ তাদেরকে বিশেষভাবে হেদায়েত করেন এবং তাদের অন্তর সুদৃঢ় করে দেন যাতে তারা যে কোনো ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে পারেন। এমনকি বস্তুগত লোভ-লালসা বা পরিবার-পরিজনের প্রতি মায়া-মমতাও তাদেরকে ঈমানের পথ থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারেনি।

সাধারণত পাপাচারে পরিপূর্ণ সমাজে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে তিনটি ভাগ লক্ষ্য করা যায়। প্রথম দলের লোকজন সমাজের সঙ্গে মিশে যায়, তারা স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে বা স্বতন্ত্র মতামত প্রকাশ করতে পারে না। দ্বিতীয় দল সমাজে প্রচলিত পাপাচার থেকে নিজেদের রক্ষা করে চলেন। কিন্তু তৃতীয় দল শুধু নিজেদেরই বাঁচিয়ে রাখেন না, সেইসঙ্গে সমাজকেও পাপমুক্ত করার জন্য আন্দোলন করেন। নবী-রাসূল ও ঈমামগণ ছিলেন এসব সমাজ সংস্কারকদের অন্যতম।

আসহাবে কাহাফের পুরুষরা ছিলেন দ্বিতীয় দলের অন্তর্ভূক্ত। তারা পাপাচারের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে না দিয়ে দ্বীন রক্ষা করতে গিয়ে কঠিন সমস্যার মধ্যে পড়েন, এমনকি নিজেদের জীবনকে বিপদে ফেলতেও তারা দ্বিধা করেননি।
অবশ্য তারা নিজেদের বিশ্বাস প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো হুমকিকে ভয় পাননি। তারা পরিষ্কার ভাষায় শিরক ও মুর্তি পূজাকে ভ্রান্তি ও মিথ্যাচার বলে ঘোষণা করতেন। সেইসঙ্গে প্রকাশ্যে আল্লাহর একত্ববাদের কথাও প্রচার করেন তারা। আল্লাহর পথ ছাড়া অন্য সব পথকে ভুল ও বাতিল বলে উল্লেখ করেন এসব ঈমানদার মানুষ।

যাই হোক, পবিত্র কুরআনের শিক্ষার অন্যতম পদ্ধতি হল- অতীত ইতিহাস তুলে ধরে তা থেকে শিক্ষা নিতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা। এ কারণে কুরআনের একটি বড় অংশ জুড়ে অতীত জাতিগুলোর ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। তবে এ ইতিহাস কাল্পনিক বা বানোয়াট কোনো গল্প নয়। বিভিন্ন দেশ ও জাতির কবি-লেখকরা কল্পনা করে যে কাহিনী লিখে থাকেন, পবিত্র কুরআনের কাহিনী তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কুরআনের এসব কাহিনীতে ইতিহাসের ঘটনা হুবহু তুলে ধরা হয়েছে।

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:
১. আল্লাহপাক মানুষকে শিক্ষা দেয়ার জন্য পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন কাহিনী বর্ণনা করেছেন। এসব কাহিনী বাস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, মনগড়া গল্প নয়।
২. কেউ ঈমানের পথে চলার চেষ্টা করলে আল্লাহ তার ঈমানকে সুদৃঢ় করে দেন। এ অবস্থায় ঈমানদার ব্যক্তি পরিপূর্ণতার দিকে ধাবিত হন।
৩. অত্যাচারী শাসক ও পথভ্রষ্টদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হলে দৃঢ় ও শক্তিশালী ঈমানের প্রয়োজন, যা আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

 

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন