সূরা কাহাফ; আয়াত ৭-১০

সূরা কাহাফ; আয়াত ৭-১০


সূরা কাহাফের ৭ ও ৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
إِنَّا جَعَلْنَا مَا عَلَى الْأَرْضِ زِينَةً لَهَا لِنَبْلُوَهُمْ أَيُّهُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا (7) وَإِنَّا لَجَاعِلُونَ مَا عَلَيْهَا صَعِيدًا جُرُزًا (8)
“পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা করা হয়েছে পৃথিবীর চাকচিক্যময় প্রদর্শনীর জন্য,যেন আমি পরীক্ষা করতে পারি মানুষের মধ্যে আচরণে কে শ্রেষ্ঠ।”(১৮:৭)
“প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর উপরে যা কিছু বিদ্যমান তা আমি (একদিন) উদ্ভিদশূন্য করে ধূলা ও মাটিতে পরিণত করব।” (১৮:৮)

আগের আসরে আমরা বলেছি, রাসূল (স.) মানুষের সঙ্গে খুবই সদয় ছিলেন। যখন মানুষ ঈমান আনত না, তখন তিনি খুবই কষ্ট পেতেন। এভাবে এক সময় অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে রাসূল (সা.)কে বলেন: তারা ঈমান না আনলে তুমি কি তাদের জন্য দুঃখ করতে করতে নিজের জীবন শেষ করে দেবে?
আর এ আয়াতে বলেন: পার্থিব বিষয়বস্তু যেমন: অর্থ-সম্পদ, ক্ষমতা, সম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তি এগুলো মানুষের জন্য এত বেশি লোভনীয় করা হয়েছে যে, বেশিরভাগ মানুষ এগুলোর প্রেমে পড়ে আল্লাহ ও আখেরাতকে ভুলে যায়। অথচ পার্থিব জীবনের এসব চাকচিক্য ঠুনকো ও ক্ষণস্থায়ী। একদিন এগুলোর কোনো কিছুরই অস্তিত্ব থাকবে না। প্রকৃতপক্ষে মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য আল্লাহ এ সব নেয়ামত দিয়েছেন। তিনি দেখতে চান এ নেয়ামতকে কে সঠিকপথে ব্যবহার করে নিজের আত্মিক উন্নতি করে, আর কে তা খারাপ পথে ব্যবহার করে ধ্বংস হয়।
অবশ্য মানুষের জীবন একভাবে চলে না, কখনও সুখ-শান্তি থাকে, আবার কখনো থাকে কষ্ট-যন্ত্রণা, যা কখনো কঠিন হয়, আবার কখনো হয় সহজ। এই অবস্থার মধ্যে আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করেন। তিনি চান এসব পরীক্ষার মাধ্যমে মানুষ তার ভেতরের চরিত্রকে প্রকাশ করে দিক এবং নিজেকে আরো ভালোভাবে চিনুক।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:
১. দুনিয়ার চাকচিক্য অস্থায়ী, এ সবের প্রতি মায়া করা উচিত নয়। সত্‌কাজ করার জন্য ইহজীবনের ভোগ্যবস্তুকে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু এ সবের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া যাবে না। কারণ, কিয়ামতের দিন এ দুনিয়ার সবকিছু মাটির সঙ্গে মিশে যাবে।
২. দুনিয়ার সব নেয়ামত মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। কারণ, আল্লাহ মানুষকে মহান দায়িত্ব দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। প্রত্যেককে তার জ্ঞান অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং ওই জ্ঞানের ভিত্তিতে কিয়ামতের দিন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
৩. সত্‌কাজ হতে হবে মানসম্পন্ন, এক্ষেত্রে পরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। আল্লাহ আমাদের কাছে থেকে ‘আহসানু আমালা’ বা সর্বোত্তম কাজ চেয়েছেন, ‘আকসারু আমালা’ বা অধিক আমল নয়।

সূরা কাহাফের ৯ ও ১০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
أَمْ حَسِبْتَ أَنَّ أَصْحَابَ الْكَهْفِ وَالرَّقِيمِ كَانُوا مِنْ آَيَاتِنَا عَجَبًا (9) إِذْ أَوَى الْفِتْيَةُ إِلَى الْكَهْفِ فَقَالُوا رَبَّنَا آَتِنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً وَهَيِّئْ لَنَا مِنْ أَمْرِنَا رَشَدًا (10)
“তুমি কি মনে কর যে, গুহাবাসী এবং রাকিম (বা উৎকীর্ণ ফলক) আমার নিদর্শনাবলীর মধ্যে বিস্ময়কর?” (১৮:৯)
“স্মরণ কর! যখন যুবকেরা গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করে বলেছিল, হে আমাদের প্রভু! তোমার পক্ষ থেকে আমাদের ওপর অনুগ্রহবর্ষণ এবং আমাদের কাজকর্ম সঠিকভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা কর।” (১৮:১০)

এ সূরার শানে নুযূলে বলা হয়, রাসূল (সা.)এর নবুওয়াত সঠিক কিনা তা জানার জন্য মক্কার কাফিররা দুই ব্যক্তিকে মদিনায় একজন ইহুদী পণ্ডিতের কাছে পাঠায়। মদিনার ইহুদী পণ্ডিত তাদেরকে রাসূল (সা.) এর কাছে তিনটি প্রশ্ন করতে বলেন। যদি তিনি প্রথম দু’টি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারেন, তাহলে মনে করবে তিনি সত্যিকারের রসূল। আর যদি উত্তর না দিতে পারেন তাহলে তিনি মিথ্যাবাদী।
মহানবীর কাছে প্রথম যে প্রশ্নটি করা হয়েছিল তা হল- অতীতের কোনো এক যুগে যে যুবকরা নিজেদের গোত্র হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, তাদের পরিণতি কী হয়েছিল? উত্তরে রাসূল (সা.) বলেন: আগামীকাল আমি তোমাদের এ প্রশ্নের উত্তর দেব। তবে তিনি সেদিন ‘ইনশাল্লাহ’ কথাটি ব্যবহার করেননি। এরপর ১৫ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর হযরত জিবরাইল এ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে রাসূলের কাছে আসেন। এদিকে, একদিনের পরিবর্তে ১৫ দিন সময় লাগার কারণে কাফিররা নানা ধরনের অপবাদ দিতে শুরু করে যা রাসূল (সা.)এর জন্য ছিল কষ্টদায়ক।

কাফিরদের প্রশ্ন ছিল আসহাবে কাহাফের সেই সব ঈমানদার যুবকদের নিয়ে যারা ধন-সম্পদ এবং প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হয়েছেন। কিন্তু তারা তাদের দ্বীনকে রক্ষা করার জন্য এসব ধন-সম্পদ ও ক্ষমতার মোহ ত্যাগ করে গুহার মধ্যে আশ্রয় নেন। সেই গুহার মধ্যে তারা বহু বছর ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেন যা নিয়ে পরবর্তী আয়াতগুলোতে আলোচনা করা হবে।

এ আয়াতে আসহাবে কাহাফের নামের সঙ্গে ‘রাকিম’ শব্দটি এসেছে। যে গুহায় ঈমানদার যুবকেরা আশ্রয় নিয়েছিলেন হয় তার নাম রাকিম অথবা আসহাবে কাহাফের অন্য নাম ছিল আসহাবে রাকিম। কারণ, পরবর্তীতে তাদের নাম লৌহফলকে খোদাই করে ওই গুহার মুখে স্থাপন করা হয়েছিল। রাকিম শব্দটি ‘রাকাম’ থেকে নেয়া হয়েছে- যার অর্থ হল লেখা। ইতিহাসে এসেছে, হযরত ঈসা(আ.) এর উর্ধ্বালোকে গমনের পরবর্তী কোনো এক সময়ে আসহাবে কাহাফের ঘটনা ঘটেছিল। ঘটনাটি রোম সাম্রাজ্যের কোনো এক স্থানে সংঘটিত হয়েছিল এবং রোমের ক্ষমতায় তখন অধিষ্ঠিত ছিল দাকিয়ানুস নামক অত্যাচারী শাসক।

নিজেদের ঈমান ও ধর্ম রক্ষার উদ্দেশ্যে যে সব যুবক জনপদ থেকে পালিয়ে পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন কুরআনে কারীমের এ দুই আয়াতে তাদেরকে ‘ফাতি’ বা সাহসি যুবক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, শুধুমাত্র যুবক নয়। ঈমাম জাফর সাদিক (আ.) এ সম্পর্কে বলেন: এসব ঈমানদারের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন বয়স্ক কিন্তু ঈমানের দৃঢ়তার কারণে তাদের সবাইকে ফাতি সাহসি যুবক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
কুরআনে কারীম, আসহাবে কাহাফের এ ঘটনাকে সাহসি যুবকদের হিজরত করে গুহায় আশ্রয় নেয়ার পরের ঘটনা বর্ণনা করেছে। হিজরতের আগে তাদের জীবন সম্পর্কে কুরআনে কোনো কিছুর উল্লেখ নেই। কিন্তু হিজরত করার সময় তাদের দোয়া করা থেকে বোঝা যায়, তারা ঈমানের দিক দিয়ে উন্নতি ও পরিপূর্ণতা চেয়েছিলেন। তারা রাজনৈতিক, পারিবারিক বা অন্য কোনো কারণে লোকালয়ের জীবন ছেড়ে গুহার মধ্য লুকিয়ে থাকেননি। তারা নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাস রক্ষার জন্য আল্লাহর কাছে মুক্তির পথ চেয়েছিলেন; যে পথ সমস্যাসঙ্কুল ও কঠিন হলেও আল্লাহর দয়া ও অনগ্রহে পরিপূর্ণ থাকবে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:
১. ধর্ম রক্ষা করা ঘর-সংসার রক্ষা করার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজন হলে হিজরত করতে হবে তাতে যত ধরনের সমস্যাই আসুক না কেন।
২. চেষ্টা ও আমলের পাশাপাশি দোয়া করতে হবে। আসহাবে কাহাফের সদস্যরা হিজরত করার পাশাপাশি আল্লাহর করুণা পাওয়ার জন্য দোয়া করেছিলেন।
৩. ধর্মীয় সংস্কৃতিতে সাহসী যুবকের অর্থ হল- দ্বীন রক্ষা করার জন্য অত্যাচারী শাসকের এলাকা ত্যাগ করা। শুধু এলাকা ত্যাগই যথেষ্ট নয় সেইসঙ্গে দুনিয়ার সব ভোগ্যসামগ্রী এমনকি ঘর-সংসার, সন্তান-সন্ততিও ত্যাগ করা।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

 

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন