সূরা কাহাফ; আয়াত ১-৬

সূরা কাহাফ; আয়াত ১-৬

সূরা আল কাহাফ পবিত্র কুরআনের ১৮তম সূরা। মক্কায় অবতীর্ণ এ সূরাটির আয়াত সংখ্যা ১১০। এ সূরার শানে নুযুলে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.)এর নবুওয়াত সঠিক কিনা তা জানার জন্য মক্কার কাফেররা দুই ব্যক্তিকে মদিনায় একজন ইহুদি পণ্ডিতের কাছে পাঠায়।

মদিনার ইহুদি পণ্ডিত তাদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর কাছে ৩টি বিষয়ে প্রশ্ন করতে বলে। বিষয়গুলো হচ্ছে- ১. আসহাবে কাহাফ, ২. যুলকারনাইন এবং ৩. রুহ বা আত্মা। ইহুদি পণ্ডিত বলেন, যদি তিনি প্রথম দু’টি বিষয়ের উত্তর দিতে পারেন এবং ৩য় প্রশ্ন অর্থাত রুহ সম্পর্কে উত্তর দিতে গিয়ে যদি থেমে যান, তাহলে মনে করবে তিনি সত্যিকারের রাসূল। আর যদি কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিতে পারেন তাহলে তিনি রাসূল নন। তারা মক্কায় ফিরে গিয়ে যখন রাসূলুল্লাহ (সা.)এর কাছে এ প্রশ্নগুলো করে, তখন সূরা কাহাফ নাজিল হয়। এ সূরায় আসহাবে কাহাফ ও যুলকারনাইনের ঘটনার পাশাপাশি হযরত মুসা (আ.) ও হযরত খিজিরের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। সূরার বিভিন্ন পর্যায়ে আমরা এসব ঘটনা জানব।

এ সূরার ১ থেকে ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন :
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَى عَبْدِهِ الْكِتَابَ وَلَمْ يَجْعَلْ لَهُ عِوَجًا (1) قَيِّمًا لِيُنْذِرَ بَأْسًا شَدِيدًا مِنْ لَدُنْهُ وَيُبَشِّرَ الْمُؤْمِنِينَ الَّذِينَ يَعْمَلُونَ الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ أَجْرًا حَسَنًا (2) مَاكِثِينَ فِيهِ أَبَدًا (3
“সব প্রশংসা আল্লাহর যিনি তাঁর বান্দার প্রতি এই কিতাব অবতীর্ণ করেছেনএবং তাতে কোন ধরনের অসঙ্গতি রাখেননি।”(১৮:১)
“তিনি একে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেনতাঁর ভয়াবহশাস্তি সম্পর্কেকাফেরদের সাবধান করতে এবং সত্‌কর্মশীল ঈমানদারদের এ সুসংবাদ দিতে যে, তাদের জন্য রয়েছে উত্তম পুরস্কার।” (১৮:২)
“(এটি হচ্ছে সেই জান্নাত) যাতে তারা চিরস্থায়ী হবে।”(১৮:৩)

রাসূল (সা.)এর ওপর কুরআন নাজিল করার কারণে আল্লাহর প্রশংসা ও তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে এ সূরা শুরু হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, আমরা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো শুধুমাত্র দুনিয়া ও আখেরাতের নেয়ামতের জন্য নয়, বরং সঠিক পথে হেদায়েতের জন্য। পবিত্র কুরআন নাজিল করে মানব জাতিকে সঠিক পথ প্রদর্শন হচ্ছে মানুষের প্রতি আল্লাহর সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ। এজন্য আমাদেরকে অবশ্যই আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে। এ হেদায়েত সুস্পষ্ট গ্রন্থ আকারে লেখা আছে, যার মধ্য কোন ধরনের সন্দেহ ও ভুল নেই। এ গ্রন্থের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে আল্লাহ তার ধর্মকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে রাখবেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন: এ ধর্ম স্থায়ী এবং এটি মানুষকে সুপ্রতিষ্ঠিত পথের দিকে হেদায়েত করে। যে ধর্মে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি বা ঔদাসিন্য নেই। রাসূল (সা.) সুসংবাদের পাশাপাশি জাহান্নামের ভয় মানুষের মধ্যে সদা জাগ্রত রেখেছেন যাতে ধর্মে ভারসাম্য বজায় থাকে।

এ তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:
১. কুরআন এত মহান ও শ্রেষ্ঠ নেয়ামত যে, এটি নাযিল করার জন্য আল্লাহ নিজেই নিজের প্রশংসা করেছেন।
২. রাসূল (সা.) কুরআনের ভিত্তিতে সুসংবাদ দান করেন, নিজের পক্ষ থেকে কিছু বলেন না। কারণ, কুরআন একটি সুস্পষ্ট ও স্থায়ী গ্রন্থ।

সূরা কাহাফের ৪ ও ৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন :
وَيُنْذِرَ الَّذِينَ قَالُوا اتَّخَذَ اللَّهُ وَلَدًا (4) مَا لَهُمْ بِهِ مِنْ عِلْمٍ وَلَا لِآَبَائِهِمْ كَبُرَتْ كَلِمَةً تَخْرُجُ مِنْ أَفْوَاهِهِمْ إِنْ يَقُولُونَ إِلَّا كَذِبًا (5)
“এবং তাদেরকে সতর্ক করার জন্য যারা বলে,আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন।” (১৮:৪)
“এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নাই এবং তাদের পিতৃপুরুষদেরও ছিল না। বক্তব্যহিসেবে ওদের মুখ থেক যা বের হয় তা কত ভয়ঙ্কর। তারা যা বলে তা মিথ্যা ছাড়া অন্য কিছু নয়।” (১৮:৫)

আগের আয়াতে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলার ব্যাপারে সার্বিকভাবে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। আর এই দুই আয়াতে কাফেররা আল্লাহ সম্পর্কে কী ধরনের অপবাদ দেয় তার একটি উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে। তারা বলে আল্লাহর সন্তান রয়েছে। আল্লাহর প্রতি এ ধরনের অপবাদ আরোপকারীদের মধ্যে রয়েছে মুশরিক, ইহুদি ও খ্রিস্টান সবাই। মুশরিকরা ফেরেশতাদেরকে ‘আল্লাহর কন্যা’ বলে মনে করত। খ্রিস্টানরা ঈসা (আ.)কে আল্লাহর সন্তান বলে দাবী করে। আর শেষ নবীর যুগের ইহুদিরা পূর্ববর্তী নবী হযরত ওযাইরকে আল্লাহর সন্তান বলে মনে করত। অথচ আসমানি গ্রন্থের বক্তব্যের সঙ্গে এই বিশ্বাসের কোনো মিল নেই। সেইসঙ্গে কোনো যুক্তির বিচারেই এ বক্তব্য ধোপে টেকে না।

এ দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:
১. মিথ্যা ও ভুল ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা নবী-রাসূলদের প্রধান দায়িত্ব। আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করা হচ্ছে সবচেয়ে ভ্রান্ত মতবাদ এবং সর্বোত্তম ধর্মবিশ্বাস হলো হল আল্লাহর একত্ববাদের উপর বিশ্বাস করা ও এর উপর অটল থাকা।
২. ধর্মবিশ্বাস গড়ে উঠতে হবে জ্ঞান ও যুক্তি-বুদ্ধির মাধ্যমে। তা না হলে ভুল পথে পরিচালিত হওয়া ও কুসংস্কারে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
৩. অজ্ঞতা ও মূর্খতার কারণে মানুষ তার প্রভুর ওপর পর্যন্ত মিথ্যা অপবাদ দেয়।

সূরা কাহাফের ৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
فَلَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَفْسَكَ عَلَى آَثَارِهِمْ إِنْ لَمْ يُؤْمِنُوا بِهَذَا الْحَدِيثِ أَسَفًا (6)
“(হে রাসূল!) এটা কি সম্ভব যে, যদি তারা এই কথা বিশ্বাস না করে, তবে তুমি সেই দুঃখে তাদের জন্য নিজের জীবন ধ্বংস করে দেবে?” (১৮:৬)

এ আয়াতে মানুষের প্রতি রাসূল (সা.)এর নিঃস্বার্থ ভালোবাসার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি যখন দেখেন কাফেররা আল্লাহর প্রতি ঈমান না এনে ইসলাম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তখন তিনি তাদের পরিণতির কথা চিন্তা করে মনে ভীষণ কষ্ট পান। রাসূল (সা.) ইসলাম প্রচারের জন্য আবির্ভূত হলেও তাদেরকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু তারপরও যখন দেখেন মানুষ ইসলাম গ্রহণ করছে না, তখন তিনি খুবই চিন্তিত ও ব্যথিত হন। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, তার জীবন নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়। তিনি শুধুমাত্র দায়িত্ব পালনের জন্য ইসলাম প্রচারে মনোনিবেশ করেননি বরং মানুষের প্রতি ভালবাসার জন্য তিনি মনেপ্রাণে চাইতেন সব মানুষ ইসলাম গ্রহণ করুক। যখন দেখলেন লাভ হচ্ছে না বরং নিজের যাদের তিনি এত ভালোবাসেন তারা ঈমান না আনার কারণে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তখন তাদের জন্য ভীষণ দুঃখ পান।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:
১. অন্যকে ভুলপথে চলতে দেখলে দুঃখ পাওয়া একটি ভাল কাজ। কারণ, এর মাধ্যমে ভুলপথে পরিচালিত ব্যক্তিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার মানসিকতা তৈরি হয়। অন্যকে সত্‌পথে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে নবী-রাসূলরা ছিলেন সবার চেয়ে অগ্রগামী।
২. ধর্মীয় নেতা ও দীনি আলেমদের উচিত্‌ মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করা। যদিও এ পথে সফলতা খুব কম পাওয়া যায় এবং বেশিরভাগ লোক তা গ্রহণ করে না।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন