সূরা হাজ্জ; আয়াত ৫৮-৬২

সূরা হাজ্জ; আয়াত ৫৮-৬২


সূরা হাজ্জের 58 ও ৫৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَالَّذِينَ هَاجَرُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ ثُمَّ قُتِلُوا أَوْ مَاتُوا لَيَرْزُقَنَّهُمُ اللَّهُ رِزْقًا حَسَنًا وَإِنَّ اللَّهَ لَهُوَ خَيْرُ الرَّازِقِينَ (58) لَيُدْخِلَنَّهُمْ مُدْخَلًا يَرْضَوْنَهُ وَإِنَّ اللَّهَ لَعَلِيمٌ حَلِيمٌ (59)
"যারা আল্লাহর পথে দেশ ত্যাগ করেছে, অতঃপর নিহত হয়েছে অথবা মৃত্যুবরণ করেছে, আল্লাহ অবশ্যই তাদের উৎকৃষ্ট জীবিকা দান করবেন। নিশ্চয় একমাত্র আল্লাহই সর্বোৎকৃষ্ট জীবিকাদাতা।" (২২:৫৮)
"অবশ্যই তিনি তাদের এমন স্থানে (বেহেশতে) প্রবেশ করাবেন যাতে তারা সন্তুষ্ট হবে। নিশ্চয় আল্লাহ প্রজ্ঞাময়, পরম সহনশীল।" (২৩:৫৯)

প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের মধ্যে যারা বিশ্বনবী (সা.) ও ইসলামকে সহায়তার জন্য মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেছিল তাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বাভাবিকভাবে মারা গেছেন এবং কেউ কেউ মারা গেছেন যুদ্ধে শহীদ হয়ে। একদল মানুষ কেবল শহীদদেরকেই মর্যাদা দিচ্ছিলেন, অন্য মুহাজিরদের কোনো ধরনের সম্মান দিচ্ছিলেন না। এই আয়াতে এ ধরনের আচরণের প্রতিবাদ করা হয়েছে। আল্লাহ বলছেন, যারা আল্লাহর জন্য নিজ শহর ও অঞ্চল ত্যাগ করেছে আল্লাহর কাছে তাদের রয়েছে উচ্চতর মর্যাদা এবং তারা বিচার দিবসে আল্লাহর বিশেষ নেয়ামতের অধিকারী হবেন, তা তারা শহীদ হন বা স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যু বরণ করুক।

এটা স্পষ্ট যে, তারা ইহকালের জীবনে ঈমান ও ধর্মের সুরক্ষার জন্য নিজের বাড়িঘর ও আরাম-আয়েশ ত্যাগ করেছিল। তাদের কেউ বহিষ্কৃত হয়েছিল বা নির্বাসিত হয়েছিল কিংবা নিজেই হিজরত করেছিল। মহান আল্লাহ পরকালে তাদেরকে বেহেশত দান করবেন তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও আনুগত্যের প্রতিদানে। এভাবে আল্লাহ তাদের সন্তুষ্ট করবেন।

এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষা হল:
১. আল্লাহর পথে এগিয়ে যাওয়া বা সক্রিয় থাকাটাই হল গুরুত্বপূর্ণ। এ পথে চলতে গিয়ে কেউ শহীদ হবে না স্বাভাবিক অবস্থায় মারা যাবে তা মানুষের হাতে নেই।
২. ঈমানদাররা পার্থিব জীবনে ঈমানদার হওয়ার কারণে যেসব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে মহান আল্লাহ বেহেশতের চিরস্থায়ী নেয়ামতগুলোর মাধ্যমে তা পুষিয়ে দেবেন।
৩. আল্লাহ ঈমানদারদের ওপর সংঘটিত জুলুম সম্পর্কে সচেতন, কিন্তু আল্লাহর সহনশীলতা খুব বেশি। তিনি জালিমদের শাস্তি দেয়া ও মজলুমদের পুরস্কার দেয়ার বিষয়টিকে বিচার-দিবস পর্যন্ত মুলতবী রেখেছেন।

সূরা হাজ্জের ৬০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন-
ذَلِكَ وَمَنْ عَاقَبَ بِمِثْلِ مَا عُوقِبَ بِهِ ثُمَّ بُغِيَ عَلَيْهِ لَيَنْصُرَنَّهُ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ لَعَفُوٌّ غَفُورٌ (60)
"এটাই (সঠিক), (তবে) যে ব্যক্তি যতটুকু নিপীড়িত হয়েছে ততটুকুই যেন প্রতিশোধ গ্রহণ করে, পুনরায় সে নির্যাতিত হলে আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করবেন; নিশ্চয়ই আল্লাহ গুনাহ মার্জনাকারী, ক্ষমাশীল।" (২২:৬০)

মুহাজির তথা আল্লাহর পথে হিজরতকারীদের জন্য বেহেশত অপেক্ষা করছে এই সুসংবাদ দেয়ার পর মহান আল্লাহ এই আয়াতে বলছেন, আল্লাহ দুনিয়াতেও তাদের সাহায্য করবেন এবং তাদের প্রতি আল্লাহর নানা অদৃশ্য সাহায্য অব্যাহত থাকবে। শত্রুরা যখনই মুসলমানদের ওপর হামলা চালাবে তখন আত্মরক্ষা করা ও প্রতিরোধ চালানো মুসলমানদের দায়িত্ব। অবশ্য ন্যায়বিচার বজায় রেখেই প্রতিরোধ চালাতে হবে এবং কোনো ধরনের সীমা-লঙ্ঘন করা যাবে না। কিন্তু শত্রুরা যদি আগ্রাসন অব্যাহত রাখে তাহলে আল্লাহ মু'মিনদের সাহায্য করার খোদায়ী ওয়াদা পালন করবেন।

এটা স্পষ্ট যারা জুলুমের কাছে নতিস্বীকার করে ও নিজেকে রক্ষার পদক্ষেপ নেয় না আল্লাহর এই ওয়াদা তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। কেবল দোয়া পাঠের মাধ্যমেই আল্লাহ তাদের অবস্থা বদলে দেবেন ও তাদের সাহায্য করবেন এটা ভাবা উচিত নয়।
এই আয়াতের শিক্ষা হল:
১. নিজের ও নিজের পরিবার এবং দেশের সুরক্ষা একটি স্বাভাবিক অধিকার ও ধর্মীয় দায়িত্ব।
২. ন্যায়-বিচার একটি চিরন্তন ও বিশ্বজনীন মূল্যবোধ।
৩. শাস্তির পাশাপাশি ক্ষমা ও রহমত বা দয়া খোদায়ী মূল্যবোধ।

সূরা হাজ্জের ৬১ ও ৬২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

ذَلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ يُولِجُ اللَّيْلَ فِي النَّهَارِ وَيُولِجُ النَّهَارَ فِي اللَّيْلِ وَأَنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ بَصِيرٌ (61) ذَلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ هُوَ الْحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ هُوَ الْبَاطِلُ وَأَنَّ اللَّهَ هُوَ الْعَلِيُّ الْكَبِيرُ (62)
"এ (সাহায্য) এ কারণে যে, আল্লাহ (তা করতে সক্ষম যেমনভাবে তিনি) রাতকে দিনে প্রবেশ করান এবং দিনকে রাতে প্রবেশ করান এবং নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।" (২২:৬১)
"এ কারণেও যে, আল্লাহ, তিনিই একমাত্র সত্য এবং তাঁকে ভিন্ন তারা যাকেই (উপাসনার জন্য) ডাকে বা নাম নেয় তা অসত্য; এবং নিশ্চয় একমাত্র আল্লাহই উচ্চ মর্যাদাময়, মহান।" (২২:৬২)

আগের আয়াতে আল্লাহ মু'মিনদের সহায়তা দেবেন বলে ওয়াদা করেছেন। এই আয়াতে আল্লাহ বলছেন, এই ওয়াদা এ জন্য যে, আল্লাহ সব কিছু করার ক্ষমতা রাখেন ও বিশ্ব-জগতের ব্যবস্থাপনা তার কর্তৃত্বাধীন। তিনিই পৃথিবীকে সূর্যের চারদিকে ঘুরিয়ে দিন ও রাত সৃষ্টি করেছেন এবং নির্দিষ্ট কক্ষপথ সৃষ্টি করে রাত ও দিনের কোনোটির সময় কমিয়ে দিচ্ছেন বা বাড়িয়ে দিচ্ছেন। নানা ঋতুতে দিন ও রাতের পরিমাণে পার্থক্য ঘটে। কিন্তু এই পরিবর্তন নির্দিষ্ট নিয়ম-ভিত্তিক বলে তা পরিমাপ করা যায়। আর এটা মহান আল্লাহর অসীম ক্ষমতারই এক নিদর্শন।

মহান আল্লাহ কেবল বিশ্বজগতের স্রস্টাই নন তিনি এর প্রতিপালনও করছেন। এই বিশ্বজগতে যা কিছু ঘটছে তা তিনি দেখেন ও শোনেন। এমন নয় যে তিনি বিশ্বজগত সৃষ্টি করে তাকে নিজের অবস্থার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি এমন এক মহাসত্য ও বাস্তবতা যে তিনি ছাড়া অন্য সব কিছুই ধ্বংসশীল এবং ইবাদতের যোগ্য নয়। তিনি অন্য সব কিছুর চেয়ে এত বেশি শক্তিশালী যে তা কেউ কল্পনাও করতে পারে না। তাই আল্লাহ বন্ধুকে সহায়তা ও শত্রুকে ধ্বংস করতে সক্ষম।

এ দুই আয়াতের শিক্ষা হল:
১. সৃষ্টি জগত বা অস্তিত্বের জগত আল্লাহর জ্ঞান ও শক্তির সবচেয়ে বড় প্রমাণ। তাই আমাদের উচিত কেবল আল্লাহর ওপর ভরসা করা ও কেবল তাঁরই কাছে সাহায্য চাওয়া।
২. আল্লাহই হচ্ছেন প্রকৃত সত্য ও খোদা এবং তিনি ও তাঁর কাছ থেকে যে জ্ঞান মানুষের কাছে এসেছে তা সত্যকে জানার মানদণ্ড।
৩. মহান আল্লাহ মু'মিনদের সহায়তা দেয়ার ও মিথ্যার ওপর তাদেরকে বিজয়ী করার গ্যারান্টি দিচ্ছেন। তবে শর্ত হল, মু'মিনদেরকে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন