সূরা হাজ্জ; আয়াত ৫২-৫৭
সূরা হাজ্জ; আয়াত ৫২-৫৭
সূরা হাজ্জের ৫২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ وَلَا نَبِيٍّ إِلَّا إِذَا تَمَنَّى أَلْقَى الشَّيْطَانُ فِي أُمْنِيَّتِهِ فَيَنْسَخُ اللَّهُ مَا يُلْقِي الشَّيْطَانُ ثُمَّ يُحْكِمُ اللَّهُ آَيَاتِهِ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ (52)
"(হে নবী!) আমরা আপনার আগে যে কোন রাসূল কিংবা নবী পাঠিয়েছি (তার ক্ষেত্রে এটা অবশ্যই ঘটেছে যে,) যখনই তারা (তাওহিদের দাওয়াত ছড়িয়ে পড়ার বা ঐশী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ) ইচ্ছা বা কামনা করত তখন শয়তান তার কামনার পথে সন্দেহ (তথা সেসব সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সন্দেহ) নিক্ষেপ করেছে; তবে শয়তান যা নিক্ষেপ করে আল্লাহ তা অপসারণ করে দেন। অতঃপর আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূহকে (সত্যরূপে) সুপ্রতিষ্ঠিত করেন; আর আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।" (২২:৫২)
আগের কয়েকটি আয়াতের আলোচনায় একত্ববাদী ধর্ম ইসলামকে ধরাপৃষ্ঠ থেকে নির্মূলের প্রচেষ্টা সম্পর্কে কথা বলেছি। এই আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, শয়তানদের ষড়যন্ত্র ও প্ররোচনা যুগে যুগে তথা সব যুগেই ছিল। এই শয়তানদের বেশিরভাগই হল মানুষ। তারা ওহি বা কুরআনের বাণীর প্রতি মুমিনদের বিশ্বাসকে দুর্বল করতে চেয়েছে এবং চেয়েছে নবী-রাসূলদের কর্মসূচীকে দুর্বল করতে। খোদায়ী ধর্মগুলোর বিকাশকেও তারা ঠেকাতে চেয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তাঁর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার ইচ্ছে করেছেন এবং একইসঙ্গে পাঠানো নবী-রাসূলদের সহায়তা দেয়ার ও স্বীকৃতি দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন।
আয়াতটির তাৎপর্য খুবই স্পষ্ট। আল্লাহর নবী-রাসূলগণের ঐকান্তিক কামনা ছিল যেন মানুষ হেদায়াত পায় এবং বেহেশত লাভ করে, কিন্তু শয়তান কামনা করে তারা যেন তার সহচর হয়ে পথভ্রষ্ট ও জাহান্নামী হয়। এ কারণে যখনই কোন নবী আগমন করতেন এবং মানুষকে হেদায়াত করার প্রচেষ্টা করতেন তখন শয়তান তাঁর হেদায়াতের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে মানুষকে পথভ্রষ্ট করত।
এই আয়াতের শিক্ষা হল:
১. আল্লাহর আয়াত বা নিদর্শনগুলোর প্রতি সন্দেহ সৃষ্টির জন্য শয়তান ও তার সহযোগীদের চক্রান্ত সব যুগেই ছিল ও থাকবে। তাই মুমিনদেরকেও পাল্টা ব্যবস্থা বা কর্মসূচী নিতে হবে।
২. আল্লাহ মিথ্যার ওপর সত্যকে বিজয়ী করার ওয়াদা দিয়েছেন। আর তাই মু'মিনরা আল্লাহর ওপর ভরসা করে বিজয় অর্জন করেন।
সূরা হাজ্জের ৫৩ ও ৫৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
لِيَجْعَلَ مَا يُلْقِي الشَّيْطَانُ فِتْنَةً لِلَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ وَالْقَاسِيَةِ قُلُوبُهُمْ وَإِنَّ الظَّالِمِينَ لَفِي شِقَاقٍ بَعِيدٍ (53) وَلِيَعْلَمَ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ أَنَّهُ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكَ فَيُؤْمِنُوا بِهِ فَتُخْبِتَ لَهُ قُلُوبُهُمْ وَإِنَّ اللَّهَ لَهَادِ الَّذِينَ آَمَنُوا إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ (54)
"এজন্য যে, শয়তানী কুমন্ত্রণা বা প্রক্ষেপণকে (সৃষ্ট সন্দেহ) তিনি তাদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ করেন যাদের অন্তর ব্যাধিগ্রস্ত এবং যাদের হৃদয় পাষাণ; নিশ্চয় অবিচারকরা ঘোর বিরোধিতায় লিপ্ত রয়েছে।" (২২:৫৩)
"এবং এ কারণে যে, যারা জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়েছে তারা যেন অবহিত হয় যে, এটা (নবীর আনীত শরীয়ত যা তিনি বাস্তবায়নের ইচ্ছে করেন) তোমার প্রতিপালকের কাছ হতে সত্য হিসেবে নাজেল হয়েছে; অতঃপর যেন তারা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং যেন তাদের হৃদয় তার প্রতি বিনীত হয়; নিশ্চয় যারা বিশ্বাসী আল্লাহ তাদের সরল পথের দিকে পরিচালিত করেন।" (২২:৫৪)
আগের কয়েকটি আয়াতের ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: ইসলামের শত্রুদের ষড়যন্ত্র মুমিন ও কাফির নির্বিশেষে সবার জন্যই পরীক্ষার ক্ষেত্র। কাফিররা চিন্তাগত দিক থেকে অসুস্থ হওয়ায় সত্যের বাণী তাদের মধ্যে কোনো প্রভাব ফেলে না, বরং তারা শয়তানের কুমন্ত্রণা বা প্রক্ষেপণকে আপন মনে করে তার অনুসরণ করে। ফলে তারা দিনকে দিন সত্য থেকে দূরে সরে যায় এবং সত্য ও তাদের মধ্যে ব্যবধান বাড়তেই থাকে।
অন্যদিকে মুমিনরা সচেতনতা ও জ্ঞানের আলোকে সত্য এবং মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন। তারা বুঝতে পারেন কোনটি খোদায়ী বক্তব্য ও কোনটি শয়তানের প্ররোচনা। মু'মিনরা মহান আল্লাহর দরবারে অত্যন্ত বিনীত থাকেন। তাই মহান আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়ার জীবনে সঠিক পথ দেখান।
এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয় যে সত্য থেকে দূরে থাকা ও সত্যের অনুসরণের ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব রয়েছে। এই প্রভাব দুনিয়ার জীবনে ও পরকালেও প্রকাশিত হবে। আর তা হল, কাফিররা যাবে দোযখে ও মু'মিনরা যাবে বেহেশতে।
এই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. গোঁড়ামি, অবাধ্যতা ও হিংসা এমন কিছু রোগ যা মানুষকে সত্য গ্রহণে বাধা দেয় এবং তাদের হৃদয় হয়ে পড়ে পাথরের মত কঠিন। ফলে এ ধরনের লোকের পক্ষে জুলুম করাও সহজ হয়ে পড়ে।
২. প্রকৃত জ্ঞান হল তা যা মানুষকে সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করতে শেখায় এবং মানুষকে সত্যের সামনে নতজানু করে।
৩. যারা সত্যের পথে অগ্রসর হয় আল্লাহ তাদেরকে বাদবাকি পথে সহায়তা করেন এবং দিক-নির্দেশনা দান করেন।
সূরা হাজ্জের ৫৫ থেকে ৫৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَلَا يَزَالُ الَّذِينَ كَفَرُوا فِي مِرْيَةٍ مِنْهُ حَتَّى تَأْتِيَهُمُ السَّاعَةُ بَغْتَةً أَوْ يَأْتِيَهُمْ عَذَابُ يَوْمٍ عَقِيمٍ (55) الْمُلْكُ يَوْمَئِذٍ لِلَّهِ يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ فَالَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فِي جَنَّاتِ النَّعِيمِ (56) وَالَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا فَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُهِينٌ (57)
"যারা অবিশ্বাসী তারা তো সব সময় এর (নবীর আনীত শরীয়ত) প্রতি সন্দিহান থাকবে; যতক্ষণ না তাদের কাছে আকস্মিকভাবে কিয়ামত এসে যাবে অথবা এক অশুভ দিনের শাস্তি উপস্থিত হবে।" (২২:৫৫)
"সেদিন স্বত্বাধিকার (সার্বভৌম কর্তৃত্ব) একমাত্র আল্লাহরই হবে; তিনি তাদের মধ্যে ফয়সালা করবেন। সুতরাং যারা বিশ্বাস করে ও সৎকর্ম করে তারা নিয়ামতে পূর্ণ উদ্যানে (বেহেশতে) থাকবে।" (২২:৫৬)
"আর যারা অবিশ্বাস করে এবং আমাদের নিদর্শনাবলীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।" (২২:৫৭)
আগের আয়াতের আলোচনার ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: কুফরি প্রবণতা ও গোঁড়ামির কারণে কাফিররা জীবনের শেষ পর্যন্ত সত্যের পথে আসে না। বরং তারা সত্যের প্রতি সব সময় সন্দিহান থাকে। আর এমন সন্দিহান অবস্থায় একদিন তারা কিয়ামত বা পুনরুত্থান দিবস প্রত্যক্ষ করে এবং ভোগ করে খোদায়ী শাস্তি। আর এ সময় পরকাল বা সত্যকে অস্বীকার করা ও সত্যের প্রতি ঈমান আনা অর্থহীন।
পুনরুত্থান বা বিচার দিবস হচ্ছে মানুষের ভাল বা মন্দ কাজের প্রতিদান দিবস। আর মহাজ্ঞানী ও ন্যায় বিচারক আল্লাহই এই দিন বিচার করবেন। সতকর্মশীল ঈমানদাররা যাবে বেহেশতে এবং কাফিররা যাবে দোযখে।
এই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. সন্দেহ যদি সত্যের ব্যাপারে গবেষণার প্রাথমিক পদক্ষেপ হয় তাহলে তা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু তা যদি জীবনের শেষ পর্যন্ত চলতে থাকে তাহলে বিপর্যয় ও বিচ্যুতি ডেকে আনে।
২. পুনরুত্থান দিবস বা কিয়ামত মৃত্যুর মতই হঠাত হাজির হবে এবং তা কখন ঘটবে আল্লাহ ছাড়া আর কেউই তা জানেন না।
৩. কিয়ামতের দিন আল্লাহ বিচার করবেন যার ভিত্তিতে তা হল মানুষ আন্তরিকভাবে ঈমানদার ছিল না কেবল মুখে মুখে ঈমানদার ছিল এবং এরই ভিত্তিতে দুনিয়ায় সতকর্ম বা অপকর্ম করেছে কিনা।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন