সূরা হাজ্জ; আয়াত ৩৯-৪৫
সূরা হাজ্জ; আয়াত ৩৯-৪৫
সূরা হাজ্জের ৩৯ ও ৪০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا وَإِنَّ اللَّهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ (39) الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ بِغَيْرِ حَقٍّ إِلَّا أَنْ يَقُولُوا رَبُّنَا اللَّهُ وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَهُدِّمَتْ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَصَلَوَاتٌ وَمَسَاجِدُ يُذْكَرُ فِيهَا اسْمُ اللَّهِ كَثِيرًا وَلَيَنْصُرَنَّ اللَّهُ مَنْ يَنْصُرُهُ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ (40)
“যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হলো তাদেরকে যারা (শত্রুদের হাতে) অন্যায়ভাবে আক্রান্ত হয়েছে। আল্লাহ অবশ্যই তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম।” (২২:৩৯)
“যাদেরকে তাদের ঘর-বাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে শুধু এই অপরাধে যে,তারা বলে আমাদের পালনকর্তা এক আল্লাহ। আল্লাহ যদি মানবজাতির কোনো কোনো দলকে অপর কোনো কোনো দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন,তবে (খ্রিস্টানদের) নির্জন গির্জা, ইবাদতখানা,(ইহুদিদের) উপাসনালয় এবং মসজিদসমূহ- যেগুলোতে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয় সেগুলো বিধ্বস্ত হয়ে যেত। আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদেরকে সাহায্য করবেন,যারা আল্লাহর দ্বীনকে সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী শক্তিধর।” (২২:৪০)
রাসূলুল্লাহ (সা.) ১৩ বছর মক্কার লোকদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং তাদেরকে মূর্তিপূজা থেকে দূরে থাকতে বলেন। বহু নারী-পুরুষ তাঁর দাওয়াতে সাড়া দিয়ে মুসলমান হন। কিন্তু তাদের ওপর কুরাইশ অধিপতিরা অকথ্য নির্যাতন করেন এবং এ নির্যাতনে বেশ কয়েকজন সাহাবী শহীদ হন।
মুশরিকদের অত্যাচার এতটা ব্যাপকতা পায় যে, বিশ্বনবী তাঁর সাহাবীদের নিয়ে জন্মভূমি মক্কা ত্যাগ করে মদীনায় হিজরতে করতে বাধ্য হন। মুসলমানরা মদীনায় হিজরত করার পর যখন ক্ষমতাশালী হন তখন আল্লাহ এ আয়াতের মাধ্যমে তাদেরকে মুশরিকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, আগ্রাসন থেকে নিজেদের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করো, আল্লাহ তোমাদের সহযোগিতা করবেন।
এ আয়াত অনুযায়ী, কাফেরদের হাত থেকে ধর্মীয় স্থান রক্ষা করা সব ঐশী ধর্মের অনুসারীদের কর্তব্য। এখানে কোন নির্দিষ্ট ধর্মের কথা বলা হয়নি। এ আয়াত অনুযায়ী, মুসলমানদেরকে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ধর্মীয় স্থানগুলোকে কাফেরদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে, যুদ্ধের সময়ও আহলে কিতাবদের ধর্মীয় স্থানগুলোতে আক্রমণ বা এসব স্থানের কোনো ক্ষতি করা যাবে না।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো:
১. জুলুম বা অত্যাচারের শিকার জাতিকে আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে অধিকার আদায় করে নেয়ার অনুমতি দিয়েছে ইসলাম।
২. আল্লাহর সাহায্য অবশ্যই আসবেই। তবে শর্ত হল মুমিনদেরকে আল্লাহর দ্বীন রক্ষার্থে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাতে হবে।
৩. দেশপ্রেম মানুষের প্রকৃতিগত অধিকার। কেউ যদি কাউকে দেশে থাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাহলে সে সুস্পষ্ট জুলুম করবে।
৪. শত্রুদের কাজ হল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা, কারণ, এসব প্রতিষ্ঠান মানুষকে আল্লাহর পথে নিয়ে যায় এবং জালিমের জুলুম থেকে রক্ষা করে।
সূরা হাজ্জের ৪১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
الَّذِينَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآَتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ (41)
“তারা এমন লোক যাদেরকে আমি পৃথিবীতে শক্তি-সামর্থ্য দান করলে তারা নামায কায়েম করবে,যাকাত দেবে এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। প্রত্যেক কর্মের পরিণাম আল্লাহর ক্ষমতার আওতায় রয়েছে।” (২২:৪১)
এ আয়াতে বিশ্বনবীর সেইসব অনুসারীর কথা বলা হয়েছে যারা দ্বীন প্রচারে তাঁকে সহযোগিতা করে। আল্লাহ বলেন: তাদের জিহাদের উদ্দেশ্য নতুন নতুন দেশ দখল ও আধিপত্য বিস্তার করা নয়, বরং আল্লাহর দ্বীন ও আহকাম প্রচার করা যার প্রথম হল নামাজ কায়েম, যাকাত আদায় ও সৎ কাজের আদেশ দেয়া। নামাজ আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক সৃষ্টি করে, যাকাত বঞ্চিতদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সেতুবন্ধন তৈরি করে আর সৎ কাজের আদেশ সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা গঠন করতে সহায়তা করে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো:
১. ক্ষমতা যদি সৎ ও মুমিন ব্যক্তির হাতে থাকে তাহলে তার সঠিক ব্যবহার হয় এবং সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়।
২. সৎ মানুষদের দ্বারা গঠিত সরকার যেমনি মানুষের আত্মিক উন্নতির জন্য চেষ্টা করে তেমনি তাদের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধান করে তাদের স্বাচ্ছন্দ্য জীবনযাপনও নিশ্চিত করে।
সূরা হাজ্জের ৪২, ৪৩ ও ৪৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَإِنْ يُكَذِّبُوكَ فَقَدْ كَذَّبَتْ قَبْلَهُمْ قَوْمُ نُوحٍ وَعَادٌ وَثَمُودُ (42) وَقَوْمُ إِبْرَاهِيمَ وَقَوْمُ لُوطٍ (43) وَأَصْحَابُ مَدْيَنَ وَكُذِّبَ مُوسَى فَأَمْلَيْتُ لِلْكَافِرِينَ ثُمَّ أَخَذْتُهُمْ فَكَيْفَ كَانَ نَكِيرِ (44)
“(হে রাসূল) তারা যদি আপনাকে অস্বীকার করে থাকে তাহলে তাদের আগে নুহ, আদ ও সামুদ জাতিও তাদের নবীদেরকে অস্বীকার করেছিল।” (২২:৪২)
“এবং ইব্রাহীম ও লুতের সম্প্রদায়ও।” (২২:৪৩)
“এবং মাদায়েনের অধিবাসীরা এবং অস্বীকার করা হয়েছিল মুসাকেও। অতঃপর আমি কাফেরদেরকে সুযোগ দিয়েছিলাম এরপর তাদেরকে পাকড়াও করেছিলাম (এখন দেখো) কি ভীষণ ছিল আমাকে অস্বীকৃতির পরিণাম।” (২২:৪৪)
জিহাদ ও আত্মরক্ষার আয়াতের পর এই আয়াতে আগের যুগের উম্মতরা তাদের নবীদের সঙ্গে কী ব্যবহার করেছিল তা বর্ণিত হয়েছে; যাতে রাসূল (সা.) ও তার অনুসারীরা সান্ত্বনা পান। তারা যেন বুঝতে পারেন, মক্কার মুশরিকরা তাদের জন্য যে ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করেছে, অতীতের নবীদের সঙ্গেও তাদের উম্মতের লোকেরা এমন ব্যবহার করেছিল। অবশ্য আল্লাহ মুমিনদেরকে সাহায্য করেছেন এবং তাদের শত্রুদেরকে পরাস্ত করেছেন। এসবই মুমিনদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের উদাহরণ, যার প্রতিশ্রুতি আল্লাহ দিয়েছেন।
হ্যাঁ, যেভাবে শত বাধা-বিপত্তি থাকা সত্ত্বেও নবী-রাসূল ও তাদের অনুসারীরা আল্লাহর পথ থেকে সরে যাননি, সেভাবে মুসলমানদের উচিত ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে অবহেলা না করে আল্লাহর পথে অটল থাকা, এমনকি আরো বেশি চেষ্টা করা। আল্লাহর রাস্তায় চেষ্টা-প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে প্রয়োজনে নিজেদের জান ও মাল কুরবানি করতেও দ্বিধা করা যাবে না।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. অতীতের জাতিগুলোর ইতিহাস থেকে ভবিষ্যত প্রজন্মগুলোকে শিক্ষা নিতে হবে।
২. আল্লাহতায়ালা জালেমদেরকে সুযোগ দেন, কিন্তু তাদেরকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছেড়ে দেন না, বরং উপযুক্ত সময়ে তাদেরকে শাস্তি দেন।
সূরা হাজ্জের ৪৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
فَكَأَيِّنْ مِنْ قَرْيَةٍ أَهْلَكْنَاهَا وَهِيَ ظَالِمَةٌ فَهِيَ خَاوِيَةٌ عَلَى عُرُوشِهَا وَبِئْرٍ مُعَطَّلَةٍ وَقَصْرٍ مَشِيدٍ (45)
“আমি ধ্বংস করেছি কত জনপদ- যাদের অধিবাসীরা ছিল সীমা লঙ্ঘনকারী, এইসব জনপদ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল এবং কত সুদৃঢ় প্রাসাদ জনমানবশূন্য হয়েছে!” (২২:৪৫)
আগের আয়াতে এ দুনিয়াতে সীমা লঙ্ঘনকারীকে শাস্তি দেয়ার বিধানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর এ আয়াতে আল্লাহ বলেন: পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে সফর করলে দেখতে পাবে অতীতের রাজা-বাদশাদের প্রাসাদগুলো পড়ে আছে। এই রাজা-বাদশাহরা অতীতে সাধারণ মানুষকে শুধু অত্যাচার করেছে। সে প্রাসাদগুলোর স্তম্ভগুলো শুধু দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু কোন ছাদ নেই। তাদের শক্তি-ক্ষমতা, শান-শওকত অত্যাচার ও জুলুম ছাড়া মানুষকে আর কিছুই দিতে পারেনি।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. অন্যের উপর জুলুম করলে পরিণতি ভাল হয় না, অত্যাচারী সমূলে ধ্বংস হয়ে যায়।
২. আল্লাহর ক্রোধের সামনে মজবুত প্রাসাদ খড়কুটোর মতোই দুর্বল। কাজেই এসব ক্ষমতা ও প্রাসাদ বা বস্তুগত সম্পদের চাকচিক্য যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে বিরত না রাখে।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন